Dr. Neem on Daraz
Victory Day

নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সুরক্ষা সামগ্রীতে সয়লাব বাজার


আগামী নিউজ | আরিফুর রহমান প্রকাশিত: জুন ৩০, ২০২০, ০৬:৩১ পিএম
নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও সুরক্ষা সামগ্রীতে সয়লাব বাজার

নকল স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রি

ঢাকা: করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার গ্লাভস, বিশেষ চশমা (গগলস), ফেসশিল্ড, পিপিইসহ বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু এসব উপকরণের বেশিরভাগই নকল ও ভেজাল থাকায় মহামারি এই ভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে পারছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব নকল পণ্য ব্যবহারের কারণে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ তো দূরের কথা, উল্টো সংক্রমণ আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যা থেকে সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়।

রাজধানীর প্রায় প্রতিটি মোড়েই হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, ফেসশিল্ডসহ নানা ধরণের সুরক্ষা সামগ্রীর পসরা সাজিয়ে বসে আছেন বিক্রেতারা। তাৎক্ষণিকভাবে আসল ও নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারের পার্থক্য বোঝার কোনও উপায় নেই। প্রতিষ্ঠানের নাম, ব্যবহৃত উপাদান সবই উল্লেখ রয়েছে এসব স্যানিটাইজারের মোড়কে। কোনটা আবার বিক্রি হচ্ছে বেনামে।

নকল স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রি

এদিকে, বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা বিভিন্ন ধরনে মাস্কের। ১০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের মাস্ক বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। এন-নাইনটি ফাইভ নামের মাস্কের কথা বলে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে এফএফসি১ এস মাস্ক। মাস্কগুলো এন-৯৫ না হলেও সেগুলোর গায়ে এন-৯৫ সিল লাগিয়ে দিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। আর সাধারণ মানুষও বুঝে না বুঝে তা কিনছেন।

রাজধানীর গ্রিন রোডের ফুটপাতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও বিভিন্ন সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রি করছেন ফরিদ। তার কাছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, গ্লাভস, লিকুইড অ্যান্টিসেপটিক সবই পাওয়া যায় অল্পদামে। বাজারে ৫০ মিলিগ্রাম হ্যান্ড স্যানিটাইজার সর্বনিম্ন দাম ৫০ টাকা করে বিক্রি হলেও তিনি বিক্রি করছেন ৪০ টাকা, ২৫০ মিলিগ্রামের দাম রাখছেন ১৪০ টাকা। এছাড়া পলিথিনের হ্যান্ডগ্লাভস বিক্রি করছেন তিনি পাঁচ টাকা জোড়া।

ফার্মেসি বা অন্যান্য দোকান থেকে কম দামে এসব সুরক্ষা সামগ্রী কিভাবে বিক্রি করছেন আগামীনিউজের এমন প্রশ্নের জবাবে ফরিদ বলেন, কোম্পানির লোক এসে আমাকে দিয়ে যায়। আমি তাদের থেকে যেই দামে কিনি তার থেকে অল্প লাভে বিক্রি করি। তার কাছে পাওয়া সব সুরক্ষা সামগ্রী ভালো বলে দাবি করেন তিনি।

রাস্তায় করোনার স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী বিক্রি

একই চিত্র দেখা মেলে পান্থপথ সিগন্যালেও। সেখানে রবিন বিক্রি করছেন বিভিন্ন ধরনের সুরক্ষা সামগ্রী। এসব সামগ্রী কোথা থেকে আনেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কোম্পানি ও কারওয়ার বাজার থেকে তিনি কিনে আনেন। তবে তিনি কোম্পানির নাম বলতে পারেননি। তাদের ফোন নাম্বার চাইলে তা দিনে অস্বীকৃতি জানান তিনি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইথানল (ইথাইল এলকোহল) এর সাথে হাইড্রোজেন পারক্সাইড, গ্লিসারল ও ঠাণ্ডাকৃত ফোটানো পানি অথবা আইসোপ্রোপাইল এ্যালকোহল (প্রোপানল) এর সাথে হাইড্রোজেন পারক্সাইড ও গ্লিসারলসহ বিভিন্ন উপাদান নির্দিষ্ট পরিমাণে মিশালে তৈরি হয় হ্যান্ড স্যানিটাইজার। নির্দিষ্ট পরিমাণের বাহিরে কেউ যদি কোন একটি উপাদান কম বেশি মেশায় বা কোন উপাদান বাদ দেওয়া হয়, তাহলে সেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার জীবাণুমুক্ত না করে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ফার্মাসি ডিপার্টমেন্টের এডভাইজার প্রফেসর ড. এস এম আব্দুর রহমান আগামীনিউজকে বলেন, হ্যান্ড স্যানিটাইজারে এলকোহলের মাত্রা সঠিক পরিমাণ না থাকলে তা জীনবাণুনাশক হবে না। এতে করে করোনাভাইরাসও ছড়াতে পারে। কেননা একজন ধারণা করছে সেতো স্যানিটাইজার ব্যবহার করেছে তার মানে সে জীবাণুমুক্ত। কিন্তু তার স্যানিটাইজারে সঠিক পরিমানে অ্যালকোহল না থাকায় তা তাকে সুরক্ষা দিতে পারবে না।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চর্ম ও যৌন রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ডা. রাশেদ মোহাম্মদ খান আগামীনিউজকে বলেন, নকল স্যানিটাইজারে এক্সিমা বা প্রদাপক, ত্বক শুষ্ক,লাল হয়ে পারে। এছাড়া ত্বকের ইনফেকশনও হতে পারে। ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশন হতে পারে।

ক্যামিকেল ইঞ্জিনিয়ার আহমেদ জাবেদ জামাল আগামীনিউজকে বলেন, স্যানিটাইজারের মূল উপাদান হলো আইসোপ্রোফাইল অ্যালকোহল। এটা যখন আপনি নির্দিষ্ট মাত্রায় ব্যবহার করবেন সেটা করোনাভাইরাসকে ডিজ ইনফেক্ট করতে পারে। আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিন্তু করোনাভাইরাসকে মেরে ফেলতে পারে না। এটা হাত পরিস্কার করে জীবাণুমুক্ত রাখে। বর্তমানে আমাদের দেশের বাজারে আইসোপ্রোফাইল অ্যালকোহলের ঘাটতি রয়েছে। তাহলে বাজারে এতো এতো স্যানিটাইজার কিভাবে আসছে। তার মানে বেশিরভাগই ভেজাল। আইসোপ্রোফাইল অ্যালকোহল আমাদের দেশে আগে ছিল ১৬০০ টাকা লিটার, এখন তিন হাজার টাকার বেশি। এতো দাম দিয়েতো জিঞ্জিরা, কেরানীগঞ্জ বা টঙ্গির সাধারণ কারখানাগুলোতো আর অর্জিনাল কিছু ব্যবহার করে না।

এদিকে, নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও জীবাণুনাশক বিক্রির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। সোমবার (২৯ জুন) চলমান করোনা ভাইরাসের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জামাদির মূল্য ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে রাজধানীতে অভিযান চালিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়াধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. মাসুম আরেফিন, বিকাশ চন্দ্র দাস ও ঢাকা জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আবদুল জব্বার মণ্ডল কর্তৃক ঢাকা মহানগরীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেট, কাওরান বাজার ও ধানমন্ডি এলাকার বিভিন্ন আড়ৎ, কাঁচা বাজার ও ফার্মেসিতে এ অভিযান চালানো হয়।

অভিযানে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন লঙ্ঘনের অপরাধে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে ১৮ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়াও মহানগরীর ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও কাওরান বাজার এলাকার ফুটপাতে নকল/ভেজাল স্যানিটাইজার, মাস্ক বিক্রয় না করার জন্য হকারদের সতর্ক করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) বাবলু কুমার সাহা ওষুধ ও স্বাস্থ্যসুরক্ষা সামগ্রীসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ধার্যকৃত ও নির্ধারিত মূল্যে বিক্রয় এবং নিয়মিতভাবে দৃশ্যমান স্থানে পণ্যের মূল্য তালিকা টানানোর জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানান।

এছাড়াও জনস্বার্থে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ঢাকাসহ সারাদেশে নিয়মিত ও বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে এবং এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

গত ২৭ জুন রাজধানীর পুরান ঢাকার আরমানিটোলা ও মিটফোর্ড এলাকায় নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার, হ্যান্ড রাব, গ্লাভসসহ নকল সুরক্ষা সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাতকরণে ১০ প্রতিষ্ঠানকে ১৮ লাখ টাকা জরিমানা করেছে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। একইসঙ্গে একটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হয়েছে। এ সময় প্রায় কোটি টাকার নকল সুরক্ষা সামগ্রী উদ্ধার করা হয়।

ওই দুপুর দেড়টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সহযোগিতায় র‌্যাব-১০ এ অভিযান চালায়। ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আখতারুজ্জামান।

ওইদিন তিনি জানান, করোনার পরিস্থিতির সুযোগে এলাকাগুলোতে নকল সুরক্ষা সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করা হচ্ছিল। মান না থাকায় এসব নকল হ্যান্ড গ্লাভস, স্যানিটাইজার বা হ্যান্ড রাব কোনো ধরনের সুরক্ষা দিতে পারে না। বরং এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এসব অভিযোগে প্রতিষ্ঠান এ জরিমানা ও একটি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করা হয়। এছাড়া একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক মোস্তফা কামলাকে তিন মাসের ও ম্যানেজার আবু কায়সারকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় কোটি টাকা মূল্যের নকল সুরক্ষা সামগ্রী।

নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বিরুদ্ধে র‌্যাবের অভিযান

এর আগে ২৫ জুন রাজধানীর রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী এলাকায় কোটি টাকার নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ মো. মুন্না কাজী, মো. শান্ত, মো. সাব্বির সরদার ও আব্দুল মান্নান মিয়া নামের চারজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই দিন বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে শুরু হয়ে রাত সাড়ে সাতটা পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করেন র‌্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু।

এ ব্যাপারে পলাশ কুমার বসু আগামীনিউজকে বলেন, আসামিরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন নামীদামি ব্রান্ডের মোড়ক ব্যবহার করে নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার উৎপাদন ও বিক্রি করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিতসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেলছে। এখান থেকে প্রায় লক্ষাধিক নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং স্যানিটাইজার তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। যার আনুমানিক মূল্য কয়েক কোটি টাকা। তাদের বিরুদ্ধে ওষুধ আইনে প্রত্যেককে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও অর্থ দণ্ড প্রদান শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

তার আগে ১৯ জুন রাজধানীর কোতোয়ালী থানার বাবুবাজার ও মিটফোর্ড এলাকায় অভিযান চালিয়ে নকল ও ভেজাল এক হাজার ৯০০ লিটার স্যাভলন এবং ৫০০ লিটার হেক্সিসল উদ্ধার করে পুলিশ। এসময় সাত জনকে গ্রেফতার করা হয়।

এ ব্যাপারে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা আগামীনিউজকে বলেন, পুলিশের সব ইউনিটকে নির্দেশনা দেয়া আছে নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন এবং বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। আমরা বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালাচ্ছি, এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
 
আগামীনিউজ/এআর/এমআর 

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে