Dr. Neem on Daraz
Victory Day
ড.নিম হাকিমের ভাবনা (দেশ ও বিশ্ব )

অর্থনীতি ও বিভিন্ন মতবাদ


আগামী নিউজ | ড.নিম হাকিম প্রকাশিত: এপ্রিল ২৩, ২০২০, ০৯:৪২ পিএম
অর্থনীতি ও বিভিন্ন মতবাদ

মহাজনরা কৃষকদের ঋণের নামে সুদে টাকা দিয়ে তাদের উপার্জিত পণ্য সামগ্রী হস্তগত করে। নামমাত্র মূল্যে পণ্য সামগ্রী খরিদ করে গুদামজাত করে এবং দাম উঠা- নামার মালিক বনে বসে। এভাবেই তারা সম্পদ কুক্ষিগত করে থাকে। মহাজনদের এ
কাজের দরুন কৃষক ও জনসাধারণ অত্যন্ত হয়রানী হয়। কোন কোন সময় চরম আর্থিক দুরবস্থার শিকার হয়ে থোকে। আর এর খারাপ পরিনতি উপমহা দেশের বাসিন্দাদের সামনে অত্যন্ত স্পষ্টরূপে বিদ্যমান।

মহাজনী প্রথার মতো নব্য মহাজনী প্রথাই চালু করেছে বর্তমান বিশ্বের ব্যাংকিং ব্যবস্থা। একদিকে অর্থ জমাকারী বিনা পরিশ্রমে শুধু ব্যাংকে তার অর্থ জমা রেখেই মুনাফা নামের মোটা অংকের সুদ পায়, অপরদিকে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে গ্রহীতারা বাধ্য হয়ে অধিক সুদ প্রদান করে থাকে। মহাজনী কারবারের চেয়ে পুজিবাদীদের সৃষ্টি করা এই লেনদেন ব্যবস্থা আরও ভয়াবহ। মহাজনরা ধার দিয়ে সুদ ভোগ করে একা আর ব্যাংকিং ব্যবস্থায় ক্ষেত্র বিশেষ এমনভাবে সুদ ধার্য করা হয় যে,আমানতকারীকে ব্যাংক যে সুদ দেয় ঋণ গ্রহীতাদের থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি সুদ আদায় করে থাকে। আমানতকারীর সাথে সাথে ঐ প্রতিষ্ঠানও লাভবান হয়। দ্বি-মুখী এই অর্থনৈতিক শোষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঋণ গ্রহীতারা।

বিশ্বের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি অংশ নারী। নারীদের কর্মশক্তিকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের গতিধারা আরও দ্রুত প্রসারের লক্ষ্যে তথাকথিত দাতা দেশগুলো দরিদ্র বিশ্বের নারীদেরকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে শরীক করার জন্য আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচিসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থ-সামাজিক কর্মসূচি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে কিছু উন্নয়ন নামক প্রতিষ্ঠান। এ সব প্রতিষ্ঠান থেকে দরিদ্র মহিলারা আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ক্ষুদ্র ব্যবসা করে থাকে। দেখা গেছে, তারা এই অর্থ ব্যবহার করে যা আয় করে তার সিংহভাগই চলে যায় উন্নয়ন সংস্থার হাতে। ফলে বাহ্যিক  ‍দৃষ্টিতে এরা লাভবান হলেও আসলে তারা মোটেও লাভবান হয় না। আর তারা যদি সত্যিকারভাবে লাভবানই হতো তবে দিন দিন দরিদ্র দেশের ভূমিহীন ও বিত্তহীনের সংখ্যা এত অধিক হারে বৃদ্ধি পেত না।বস্তু সম্পদ নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের শেষ পর্যায়ে পৌঁছার পর ধনী বিশ্বদাতা নামে,মানব সম্পদ নিয়ে ব্যবসায় নেমেছে। আর এর নাম দিয়েছে সামাজিক ব্যবসা।

শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের শ্রম শোষণের পর সমাজের নিম্নস্তরের (গ্রাস রুট লেভেলে ) মানুষের শ্রমও আজ তারা কৌশলে চুরি করছে। এভাবে তাদের শোষণ আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে  ক্যান্সারের মত ঢুকে পড়ে ধ্বংস করছে সাধারণ মানুষকে।
দরিদ্রদের সম্পদ না থাকায় তারা সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ সুবিধা না পাওয়ার কারণে বাধ্য হয় এসব বেসরকারি আর্থিক ও তথাকথিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে।ঋণের টাকা ফেরত দিতে তারা  বাধ্য ।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা কোনও আর্থিক ক্ষতির কারণে তাদের কাছে ঋণ মাফ হওয়ার প্রশ্ন নেই।এমনভাবে সিস্টেম বা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে যে, গ্রহীতারাই খেলাফি গ্রহীতার ঋণ জোর জবরদস্তি আদায় করে দেয়। প্রতিষ্ঠানের লোকদের কাবুলিওয়ালার ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন হয় না। খেলাফি ঋণের সাথে চক্র বৃদ্ধি সুদও জুড়ে দেয় তারা। অথচ লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষের সঞ্চয়ই অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধান পুঁজি। দরিদ্রদের অর্থ দিয়েই কৌশলে তারা দরিদ্রকে শোষণ করছে।

এ কথাটি দরিদ্র বিশ্বের অর্থনীতিবিদরা একবারও ভেবে দেখছেন না। ঋণ সুবিধা পাওয়ার জন্য দরিদ্রদেরকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত করে জাতীয় ঐক্য ও চেতনাকে বিনষ্ট করাও পুঁজিবাদী বিশ্বের ফর্মুলা। সামাজিক দল নাম দিয়ে বিভিন্ন দল গঠন করা হলেও এদের মধ্যে কোননেটওয়ারকিং নেই। দলের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কেও দলীয় সদস্য-সদস্যারা অবগত নয়। মূলত এ পদ্ধতি হলো অর্থনৈতিক শোষণের নব্য সংস্করণ । দলের কোন সদস্য ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে তার দায়-দায়িত্ব বহন করতে হয় সমিতি বা দলের সকল সদস্যদের। এ যেন কাটা দিয়েই কাটা তোলার শামিল।

গ্রহীতারা ক্ষতিগ্রস্ত হলে দাতাদের কিছু আসে যায় না। উন্নয়নের নামে এই শোষণমূলক ব্যবস্থা এখন আর কারও কাছে অজ্ঞাত নয় । দরিদ্র দেশের গ্রাম বাংলায় গড়ে ওঠা সামাজিক দল বা সমিতি এবং কর্মরত আর্থিক ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড দেখলেই এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। কোন বিকল্প নেই, রাষ্ট্রীয় সরকার এসব প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি উন্নয়ন-নীতির সহযোগী বা সম্পূরক ভেবে নিয়ে সার্বিক সহযোগিতা করছে। পুঁজিবাদীবিশ্বের এই নতুন ফর্মূলা আজ বাস্তবায়িত হচ্ছে দরিদ্র বিশ্বের অধিকাংশ দেশে। পুঁজিবাদী বিশ্বের সৃষ্টি করা এই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ ধরনের কর্মকাণ্ড চালাতে না দিলে নির্ভরশীল দরিদ্র দেশের ধনীদেশ থেকে পাওয়া সাহায্য সহযোগিতা বন্ধ হওয়ার হুমকী প্রদানের ইতিহাসও অবিদিত নয়।

উপায় নেই পরনির্ভরশীল জাতিগুলোর বাঁচার তাগিদেই আজ অর্থনীতির এই নীরব শোষণ মেনে নিতে হচ্ছে। তাই আজ অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয় ধর্ম, কৃষ্টি, সংস্কৃতি এমনকি মান-ইজ্জত পর্যন্ত বিসর্জন দিয়ে দাতাদের হাতের নাচের পুতুল হতে। সভ্যতার এই আধুনিক দাসরা নর্তকীর মতো বিশ্বমঞ্চে উলঙ্গ নৃত্য করছে, আর দোষ দিচ্ছে সষ্টিকর্তা বা ভাগ্য বিধাতার ।

দরিদ্র জাতিগুলোর কোন লোক যদি ভাগ্যক্রমে সুযোগ-সুবিধা পায় তবে সেও আত্মকেন্দ্রিক চিন্তা নিয়ে নিজের মঙ্গলের জন্যই কাজ করে। অথচ একবারও ভেবে দেখে না যে, জাতিকে নিদারুণ অবস্থার মুখে ফেলে রেখে একা নিজের মঙ্গল সাধন করা অমানুষিকতা ও কাপুরুষতা ছাড়া আর কি হতে পারে? যে জাতির সব সাধারণ মানুষ লাঞ্চনা, গঞ্জনা, দীনতা ও হীনতার মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করে, সে জাতির কোন লোক যদি দৈবক্রমে সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয় তাতে লাভ কি? স্বার্থপরতা যে কোন জাতির বড়দোষ এবং জাতীয় অবমাননা ও সভ্য না হওয়ার সর্ব প্রথম কারণ। প্রত্যেকেরই জাতীয় প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হওয়া উচিত। মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে যে, স্বার্থপরতা জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে। আজ দরিদ্র বিশ্বে এই স্বার্থপরতা চরম আকার ধারণ করেছে।

মানব ইতিহাসের সূচনাকাল থেকে সব সময়ই দু'টি মতবাদ কার্যকর রয়েছে-একটি ন্যায়ানুগ ব্যবস্থার মতবাদ, অপরটি পুঁজিবাদ ব্যবস্থার মতবাদ। প্রথম মতবাদের দাবি হলো, “পৃথিবীতে এমন একটি ব্যবস্থা কায়েম হবে যাতে বড় বড় কোটিপতি থাকবে না, সমাজের প্রতিটি মানুষের জীবন ধারা গড়ে উঠবে মধ্যবর্তী অবস্থায়। প্রয়োজন অনুযায়ী সবাই জীবনোপকরণ পাবে, অগ্রগতি আর সমৃদ্ধির পথ সবার জন্য মুক্ত থাকবে”।

দ্বিতীয় মতবাদের দাবী হলো “পৃথিবীর এই কারখানায় অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃতি মানব জাতিকে দু'ভাবে ভাগ করেছেন। এক ভাগ প্রভূত্ব আর কর্তৃত্ব করার জন্যে সৃষ্টি করা হয়েছে আর এক ভাগ সৃষ্টি করা হয়েছে দাসত্ব আর আজ্ঞাবহ হিসেবে কাজ করার জন্য। অনুরূপভাবে প্রকৃতির অভিপ্রায় হলো, কোন কোন মানব গোষ্ঠী সম্পদের স্থায়ী ইজারাদার হবে। বৈধ-অবৈধ পন্থায় ধন সম্পদ উপার্জন করবে এবং এই প্রাচুর্য শুধু নিজেদের ভোগবিলাসের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখবে। পক্ষান্তরে কোন কোন শ্রেণী গরিব, অভাবী ও ভিখেরি দুমুঠো খাবারের জন্য সব সময় অসহায় এবং ঘৃণিত থাকবে। মানুষের জীবন ব্যবস্থার এই গগনচুম্বী বৈষম্যকে মধ্যপন্থায় আনার কারও অধিকার নেই”।


তাদের এই মতবাদের কার্যকর সফলতার সবচেয়ে বড় ভিত্তি হল মহাজনী সুদ।এই সুদ শালীন-অশালীন পন্থায় মানুষের রক্ত চুষে খায়। ছোট একটি দলকে বিপুল ধন সম্পদের অধিকারী করে। এই ব্যবস্থা মানব জাতির মধ্যে একজনকে অপরের দাসত্বে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে। মোট কথা, অভিশপ্ত পুঁজিবাদের জন্য সুদ সব সময়ই পৃষ্ঠপোষকেতব ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে মানুষ পারস্পরিক সহযোগিতা ও প্রেম-প্রীতি পরিত্যাগ করে রক্তপিপাসু হিংস্র জন্তুর মতো একে অপরের রক্ত চোষার জন্য উদ্যত হচ্ছে।

 

আগামী নিউজ/নাঈম

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে