বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে প্রতিদিন পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি ময়লা তৈরি হচ্ছে। শহরটিতে জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে মানুষজনের তৈরি ময়লা আবর্জনাও বাড়ছে।
বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি থেকে বের হলেই দেখা যায় রাস্তা ঘাটে ময়লা আবর্জনা। কলার খোসা, কাগজ, প্লাস্টিকের ব্যাগ অথবা বোতল দেখা যাবে না ঢাকায় এমন রাস্তা বা পাড়া খুব কমই আছে। চলতে পথে খোলা কন্টেইনারের উপচে পড়া আবর্জনাকে নাকে হাত দিয়ে পাশ কাটানো অথবা ময়লা বহনকারী ট্রাক থেকে কিছু উড়ে এসে গায়ে পড়বে কিনা সেই উদ্বেগ নিয়েই রাস্তা চলতে হয় বহু পথচারীকে। "খুব বিশ্রী লাগে। এগুলো সহ্য করা যায়? কিন্তু কি করবো আমাদের গরীব দেশ। তাই সহ্য করতে হয়", বলছিলেন ঢাকার রাস্তায় একজন পথচারী।
এই প্রতিবেদনটি তৈরি করতে বাড়ি থেকে বের হয়ে ময়লা আবর্জনার স্তূপ খুঁজতে খুব বেশি দুর যেতে হয়নি। মতিঝিলের ফকিরাপুলের গা ঘেঁষে সিটি কর্পোরেশনের ময়লার রাখার ভাগাড়। দিনের বেলাতেই ট্রাক থেকে ময়লা ঢালা হচ্ছে। গন্ধ শুধু রাস্তায় নয় উঁচু বাড়ি ঘরেও। ড্রেনের পানি ময়লার কারণে রাস্তায় উপচে পড়েছে। পাশেই একটি ঝিলে এত জমে থাকা ময়লা যেন সেগুলোর উপর দিয়ে হেটে যাওয়া যায়। ভ্যানে করে ময়লা সংগ্রহ করে ট্রাকে তুলে দিচ্ছেন পাড়া ভিত্তিক আবর্জনা সংগ্রহকারীরা। বিভিন্ন এলাকায় এভাবে জলাশয় বা ঝিলকে পরিণত হতে দেখা যায় ময়লা আবর্জনার নর্দমায়।
তাদের একজন বলছেন, "আমরা মনে করেন বাসায় বাসায় যাই। বালতি কইরা ঘাড়ে কইরা ময়লা টানি। সব বিল্ডিং থেকে ময়লা আইনা গাড়িতে দিয়া দেই" সেটি করতে গিয়ে এই কর্মী আবর্জনা কন্টেইনারে ফেলার আগে তা রাস্তাতেই ফেলেছেন। আশপাশে তা থেকে বেছে বেছে বিক্রি করা যাবে এমন ময়লা রেখে দিচ্ছে কয়েকজন। সিটি কর্পোরেশনের হিসেব মতে ঢাকা শহরে চার হাজারের মতো এমন পাড়া ভিত্তিক কর্মী রয়েছেন যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা সংগ্রহ করেন। এরা সবাই ছোট ছোট বেসরকারি সংস্থা বা আবাসিক সমিতি গুলো দ্বারা পরিচালিত।
দিনের বেলাতেই তারা ময়লা সংগ্রহ করছেন। যদিও সেটি হওয়ার কথা সন্ধ্যায়। কিন্তু দিনের বেলাতেই হয়। ঢাকার বাসাবাড়িতে তৈরি হওয়া দৈনিক পাঁচ হাজার মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করে দুই সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু তৈরি হয় আরো বেশি যার হিসেব তাদের কাছে নেই। তারা ধারনা করছেন শহরে তৈরি ময়লার ৮০ শতাংশই তারা পরিষ্কার করেন।
কিন্তু ঢাকায় বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন ও তা ফেলার ক্ষেত্রেও ব্যবস্থাপনার বিষয়টি ঠিকভাবে হচ্ছে না। তার কারণ কি? দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেছেন, "যারা বাড়ি থেকে কন্টেইনারে নিয়ে যাবে তাদের জন্য আমাদের সময় বেধে দেয়া আছে। সন্ধ্যায় সাতটা থেকে নয়টার মধ্যে। কিন্তু বেশিরভাগ বাসা বাড়ি চায়না রান্না হওয়ার পর দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের বাসায় ময়লা পড়ে থাকুক" কিন্তু সেদিকে এগুতে দেখা যাচ্ছে না কর্তৃপক্ষকে।
অথচ সরকারি হিসেব মতেই ঢাকায় প্রতিদিন যে পরিমাণে বর্জ্য উৎপাদিত হয় তা থেকে ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। তবে তিনি বলছেন মানুষজনের সহায়তা ছাড়া ঢাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুরূহ ব্যাপার। তিনি একটা উদাহরণ দিয়ে বলছিলেন, "ধরুন কুরবানির ঈদের দিনই চার পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে চার থেকে পাঁচ হাজার টন যে বর্জ্য তৈরি হয় তা কিন্তু একদিনেই পরিষ্কার হয়ে যায়। তার কারণ হলো নাগরিকরা সমানভাবে সিটি কর্পোরেশনকে সহযোগিতা করে। তারা সবাই উদ্যোগী থাতে সেদিন" তবে সেদিন অন্য সময়ের থেকে সিটি কর্পোরেশনগুলোও বেশি উদ্যোগী থাকে।
যত্রতত্র ময়লায় ভাগাড়। জনসচেতনতার অভাব আর দায়িত্ববানদের অবহেলা ও কর্তৃপক্ষের চরম অব্যবস্থাপনায় গোটা রাজধানীই যেন ময়লা-আবর্জনার বৃহৎ ভাগাড়। রাস্তাঘাট, অলিগলি, আবাসিক, বাণিজ্যিক এলাকা সর্বত্রই ময়লা-আবর্জনার ছড়াছড়ি। ড্রেন-নর্দমার নোংরা তরল ময়লা-পানি ঢুকে পড়ছে বাড়িঘরেও। চারদিকের উৎকট গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকছে।
প্রতিটি বাড়ির ফাঁকে, খোলা জায়গায়, গলিপথে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। যে কারণে নগরবাসীকে নাকে মুখে রুমাল চেপে চলাফেরা করতে হয়। নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনার উৎকট গন্ধ নাগরিক জীবনকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে ফেললেও এর বিন্দুমাত্রও টের পান না নগর কর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীকে ফোন করা হয়, তিনি আগামী নিউজকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটির কোথায়ও এখন আগের মত আর ময়লা আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে না। আমাদের পরিচ্ছন্নকর্মীদের নির্দেশ দেয়া আছে, তারা যেন সকাল ৬টার মধ্যেই রাস্তা-ঘাট ও জনসমাগমের স্থানের ময়লার ডাস্টবিন থেকে ময়লা অপসারন করে নেয়। রাতের মধ্যেই যেন ট্রাকে করে এই ময়লা ঢাকার বাইরে নির্ধারিত স্থানে নিরাপদে নিয়ে ফেলতে পারে। তিনি বলেন, এর ব্যতিক্রম যেন না ঘটে সে জন্য পরিচ্ছন্নকর্মীদেরকে কাজে যথা সময়ে হাজির করতে আমরা নানা কার্যকর পদক্ষেণ গ্রহণ করেছি। ডিএসসিসিতে এখন ময়লা আবর্জনা নিয়ে আর কোন সমস্যা আছে বলে আমার মনে হয় না।
সরেজমিন দুই সিটির বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে দেখা গেছে, যেখানে-সেখানে অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত ডাস্টবিনের ছড়াছড়ি। রাজধানীর গুলিস্তান থেকে তাঁতীবাজার যেতে নাজিরাবাজার মোড়ে ওভারব্রিজের নিচে রাখা হয়েছে বড় বড় কয়েকটি ময়লার কনটেইনার। এসব কনটেইনার উপচে পড়ছে ময়লা-আবর্জনা। ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। এতে ফুট ওভারব্রিজটি হয়ে পড়েছে কার্যত পরিত্যক্ত।
এ ছাড়া অপরিকল্পিতভাবে ডিএসসিসি ও ডিএনসিসির ময়লার খোলা কনটেইনার ডাস্টবিন বসানো হয়েছে বাবুবাজার ব্রিজ, রায়সাহেব বাজার থেকে ধোলাইখালের মাঝামাঝি, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের প্রবেশপথে, দয়াগঞ্জ মোড়, দয়াগঞ্জ বাজার, জুরাইন রেলগেট, শনির আখড়া, আজিমপুর, বাসাবো, বেইলী রোড, রামপুরা, বাংলামোটর, নিউ মার্কেট, হাতিরপুল, কারওয়ান বাজার, নাখালপাড়া, মহাখালী, বনানী, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর ও ধানমন্ডি এলাকায়। আবার এসব কনটেইনার ময়লায় ভরপুর থাকায় পাশেই আবর্জনার স্তূপ জমে থাকে দিনের পর দিন। ফলে রাজধানীর বাতাসে ময়লার উৎকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে প্রতিনিয়ত।
দেখা গেছে, যত্রতত্র রেখে দেওয়া ডাস্টবিনের কারণে রাস্তার বেশির ভাগ স্থান সংকুচিত হয়ে এসেছে। যতটুকু বাকি থাকে, তা দিয়ে স্বাভাবিকভাবে যানবাহন চলাচল করতে পারে না। এতে এসব স্থানে যানজট লেগেই থাকে। এই কনটেইনারগুলোর কারণে দুর্ভোগে পড়েন পথচারীরা। রাতের বেলায় ময়লা অপসারণের কথা থাকলেও দিনের যখন তখন ময়লা অপসারনণ করতে দেখা যায়।
ফলে পথচারীদের নাক চেপে চলাফেরা করতে হয়। অথচ সিটি কর্পোরেশনের নিয়ম অনুসারে প্রতিদিনের আবর্জনা রাত ১২টার পর থেকে ভোরের মধ্যে অপসারণ করার কথা। একদিকে প্রধান সড়কের পাশের এই ডাস্টবিনগুলো সৃষ্টি করছে যানজট, অন্যদিকে অসহনীয় যানজটে মানুষের যখন নাকাল অবস্থা, তখন এসব ডাস্টবিনের দুর্গন্ধে দুর্ভোগ চরমে ওঠে সাধারণ মানুষের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের সংগৃহীত বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ ও জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব। আহরিত বর্জ্য যথাযথ পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিণত হতে পারে মূল্যবান সম্পদে। কিন্তু সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও ডাম্পিং ব্যবস্থারের অভাবে বর্জ্য আজ বোঝায় পরিণত। গৃহস্থালী বর্জ্যর পাশাপাশি রয়েছে হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্যও। রাজধানীর গৃহস্থালী বর্জ্য থেকে হাসপাতাল-ক্লিনিকের বর্জ্য আলাদা করা হয় না। এগুলো ফেলা হয় ডাস্টবিন, রাস্তাঘাটসহ যেখানে সেখানে।
নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে সিটি কর্পোরেশনের নির্দিষ্ট ময়লা ফেলার স্থান না থাকায় বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি থেকে ময়লাবাহী ভ্যানগাড়ি চালকরা ময়লা সংগ্রহ করে তা প্রধান সড়কের পাশে, কিছু আবাসিক এলাকায় বাড়িঘরের পাশে, বাসস্ট্যান্ডে, বাজারে, হাসপাতালে এমনকি স্কুলের সামনের খালি জায়গাতেও ফেলা হচ্ছে। দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। দীর্ঘদিনের এই সমস্য থেকে ঢাকাবাসীকে রক্ষা করতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে দুই সিটির সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তারা। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এর কারণ হিসেবে ময়লা ফেলার জায়গা জটিলতা ও জনবল স্বল্পতাকে দায়ী করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এম সাইদুর রহমান বলেন, ঢাকা শহরে নানা শ্রেণি পেশার মানুষের বসবাস। এখানে মেইন রোড, লেইন, বাইলেন যেকোনো রাস্তা বলেন সবখানে দোকান, মুদি দোকান, হকার চা বিক্রেতা ফল বিক্রেতা কাচা বাজার রয়েছে। তারা সারাদিন ধরে রাস্তায় ময়লা ফেলতে থাকে। বাসা বাড়ি থেকেও ফেলা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের লোকজন সকালে একবার ময়লা পরিষ্কার করে। তারপরেই সারাদিন যে যেমন ময়লা ফেলে যাচ্ছে। এভাবে কতটা পরিষ্কার রাখা যায়।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যেখানে-সেখানে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। ফলে পুরো শহরই ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, গৃহস্থালি বর্জ্যরে পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ হাসপাতাল বর্জ্যও একই সঙ্গে ফেলা হচ্ছে। এগুলো সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে মিশে সংক্রামক ও ক্ষতিকর বর্জ্যে পরিণত হচ্ছে। এর ফলে ছড়িয়ে পড়ছে হেপাটাইটিস ‘বি’, হেপাটাইটিস ‘সি’, যক্ষা, ডিপথেরিয়ার মতো রোগ।