Dr. Neem on Daraz
Victory Day

টাকার জন্য হাত-পা ভেঙে নখ উপড়ে ‘হত্যা’, কাঠগড়ায় পুলিশ


আগামী নিউজ | ডেস্ক রিপোর্ট প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২০, ০৯:১৭ পিএম
টাকার জন্য হাত-পা ভেঙে নখ উপড়ে ‘হত্যা’, কাঠগড়ায় পুলিশ

সংগৃহীত

সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার যুবক রায়হান আহমদের (৩২) বাবা মারা যান মায়ের গর্ভে থাকতেই। তার বাবা রফিকুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য। বেঁচে থাকার লড়াইয়ে স্বামীর ভাইকে বিয়ে করেন রায়হানের মা। নতুন ভাই বোনদের সঙ্গে কোনো বিবাদ নেই রায়হানের। যুক্তরাষ্ট্রে থাকা এক বোনের মাধ্যমে এ মাসেই যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা ছিল তার। দেড় বছর আগে বিয়ে করে ২ মাস আগে ছেলে সন্তানের বাবা হন। শনিবার রাতে সন্তানকে আদর করে বেরিয়েছিলেন ঘর থেকে। সেই রাতে আর ঘরে ফিরতে পারেননি তিনি। ভোররাত সাড়ে ৪টায় একটি নম্বর থেকে কল করে রায়হান জানান, টাকার জন্য বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে তাকে মারধর করা হচ্ছে। কিন্তু টাকা নিয়ে গিয়েও রায়হানকে ফিরে পায়নি পরিবারের সদস্যরা।

পরদিন বিকেল ৩টায় তার মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ। হাত-পা ভেঙে ফেলা, নখ উপড়ে ফেলা রায়হানের লাশ দেশে ক্ষোভে ফেটে পড়ে এলাকাবাসী। তারা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ জানায়। রায়হানের পরিবারের দাবি, টাকার জন্য আটকে রেখে নির্মম অত্যাচার করে রায়হানকে মেরে ফেলেছে সিলেট মহানগর পুলিশ (এসএমপি) বন্দরবাজার ফাঁড়ির সদস্যরা। এ ঘটনায় রোববার দিবাগত রাতে নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে কোতোয়ালী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় তার স্বামীকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে আটকে রেখে ১০ হাজার টাকা দাবি ও দাবিকৃত টাকা না পেয়ে নির্যাতন করে মেরে ফেলার অভিযোগ করেন তিনি।

এদিকে ঘটনার দুদিনেও নিহতের পরিবারের অভিযোগের বিপরীতে কোনো যুক্তি প্রমাণ হাজির করতে পারেনি পুলিশ। শুরুতে কাষ্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে দাবি করলেও সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পুলিশ এখন বলছে, রায়হানের মৃত্যুর সঠিক কারণ তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জসহ ৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মরদেহ দাফনের আগে স্বজনরা নিহত রায়হানের শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ক্যামেরাবন্দী করে রাখেন। এতে দেখা যায়, তার হাতের দুটি নখ উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছে। পায়ের হাঁটুর নিচে আঘাত করে পা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এছাড়া হাত ও পায়ের বিভিন্ন অংশে লাঠির আঘাতের চিহ্নও রয়েছে।

মিথ্যাচারেই ধরা পড়ল পুলিশ

রায়হানের মৃত্যুর পর একের পর এক মিথ্যাচারে নিজেরাই ফেঁসে যায় পুলিশ। প্রথমে দাবি করা হয়, সিলেট নগরীর মাদক জোন হিসেবে পরিচিত কাষ্টঘর এলাকায় শনিবার রাতে ছিনতাই করতে গিয়ে গণপিটুনির শিকার হন রায়হান। পরে বলা হয়, রায়হান নিজেও ছিনতাইকারী, ভাগবাটোয়ারা নিয়ে অন্য গ্রুপ তাকে নির্যাতন করলে পুলিশ মুমুর্ষু অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু দুটি ঘটনাই মিথ্যা প্রমাণিত হয় সিসি ক্যামেরায় ফুটেজ পর্যবেক্ষণে।

হরিজন সম্প্রদায়ের বসবাসের এলাকা কাষ্টঘরে অনেক বনেদি পরিবারও বসবাস করেন। পুরো এলাকাই সিসি ক্যামেরা দ্বারা বেষ্টিত। এসব ক্যামেরা মনিটর করা হয় ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজারুল ইসলাম মুনিমের কার্যালয় থেকে। শনিবার রাত ২টা থেকে রোববার সকাল ৭টা পর্যন্ত সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়েনি এমন কোনো দৃশ্য।

নগরীর ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম মুনিম বলেন, ‘পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী  গণপিটুনির যে স্থান ও সময়ের কথা বলা হয়েছে ওই স্থানে থাকা দুটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুজেটের চিত্র আমরা দেখেছি। সেদিন রাত ১০টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত এই ফুজেটে গণপিটুনির কোনো ঘটনা দেখা যায়নি। এছাড়া আমি স্থানীয় অনেকের সাথে কথা বলেছি, কেউই গণপিটুনির বিষয়টি জানেন না।‘

পুলিশের মস্তিষ্কপ্রসূত এই নাটক আরও একবার মার খায় আহতকে দ্রুত হাসপাতালের পাঠানোর প্রশ্নে এসে। পুলিশের দাবি মোতাবেক ভোর সাড়ে ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে উদ্ধার বা আটক করা হয় রায়হানকে। সাড়ে ৪টায় রায়হান ফাঁড়ি থেকে কল দিয়ে টাকা নিয়ে এসে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কথা জানায় তার পরিবারকে। সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে জানা যায় সকাল সাড়ে ৬টার দিকে হাসপাতালে নেওয়া হয় রায়হানকে। ৮টার দিকে মারা যান তিনি। সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত কোথায় রাখা হয়েছিল রায়হানকে? সরাসরি হাসপাতালে নেওয়া হলো না কেন? এর কোনো জবাব নেই পুলিশের কাছে।

ফাঁড়িতে ধরে এনে টাকার জন্য নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর থেকে রোববার রাত পর্যন্ত পুলিশ দাবি করছিল রায়হানকে ফাঁড়িতে আনাই হয়নি। তবে সোমবার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ আলোচনায় আসলে এ ব্যাপারে আর কোনো বক্তব্য দিচ্ছে না তারা।

পুলিশ বরখাস্ত, ৩ জন ক্লোজড

গোমর ফাঁস হওয়ার পর ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিলে সোমবার বিকেলে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ ৭ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে এসএমপি।

মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোর্তিময় সরকার জানান, বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভুইয়াসহ ফাঁড়ির কনস্টেবল হারুনুর রশিদ, তৌহিদ মিয়া ও টিটু চন্দ্র দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এছাড়া এএসআই আশেক এলাহী, এএসআই কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজিব হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

রোববার আকবর হোসেন ভূইয়া দাবি করেছিলেন, শনিবার রাতে এএসআই আশেক এলাহির নেতৃত্বেই উদ্ধার করা হয় রায়হানকে।

মোবাইল নম্বরটি কার?

পুলিশ ফাঁড়ি থেকে রায়হানের পরিবারে কল করে টাকা নিয়ে আসার কথা বলা মোবাইল নম্বরটি এখন আলোচনায়। নিহতের পরিবারের দাবি- ভোররাত ৪টা ২০ মিনিটে মা সালমা বেগমের মোবাইলে একটি কল আসে ০১৭৮৩৫৬১১১১ নম্বর থেকে। ফোনটি ধরেন রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ। অপরপ্রান্ত থেকে তখন কাতরকণ্ঠে রায়হান জানান তাকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ধরে এনে নির্যাতন করা হচ্ছে। ১০ হাজার টাকা দিলে তাকে ছাড়া হবে। কল পেয়ে টাকা নিয়ে ফাঁড়িতে গেলেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি রায়হানের সঙ্গে।

মোবাইল নাম্বারটি কার? এমন প্রশ্নে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ কমিশনার (উত্তর) আজবাহার আলী শেখ জানান, সেটি শনাক্তের চেষ্টা চলছে। তবে একাধিক সূত্র দাবি করেছে, নম্বরটি কনস্টেবল তৌহিদ মিয়ার।

রাস্তায় বসে বিচার চাইলেন মা

দেড় বছর আগে বিয়ে, দু মাস হলো সন্তানের মুখ দেখেছেন রায়হানের স্ত্রী। তার আগামীর স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছে একটি দুঃস্বপ্নের রাত। বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন তিনি। ছেলেহারা সোমবার তপ্তরোদে রাজপথে বসে ছেলেহত্যার বিচার চাইলেন। রায়হান আহমদকে হত্যার প্রতিবাদে বিকেল ৩টার দিকে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের আখালিয়া এলাকায় মানববন্ধন ও টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা।

এ সময় কাঁদতে কাঁদাতে এসে রাস্তায় বসে পড়েন রায়হানের মা। চিৎকার করে ছেলে হত্যার বিচার দাবি করেন তিনি। আহাজারি করে বলেন, ‘পুলিশ মানুষের রক্ষক, কিন্তু সেই পুলিশই আজ আমার ছেলেকে হত্যা করলো। ঘুষের টাকার জন্য পুলিশ আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। রায়হানের দুই মাস ২১ দিনের একটিমাত্র সন্তান রয়েছে। সে বড় হলে তাকে আমি কী সান্ত্বানা দেব, আর আমি কীভাবে এটি সহ্য করবো?’

মানববন্ধনে কয়েকশ লোক উপস্থিত হয়ে রায়হান হত্যার প্রতিবাদ করেন এবং পুলিশবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। নেহারিপাড়া সমাজকল্যাণ সংস্থা ও আখালিয়া নবাবী মসজিদ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মিসবাহ উর রহমান জানান,  ছেলে হিসেবে রায়হান শান্তশিষ্ট। এলাকায় কখনো কোনো ঝামেলায় দেখা যায়নি তাকে।

স্থানীয় কাউন্সিলর মখলিসুর রহমান কামরান সিলেট বলেন, ‘আমার বাসার পাশেই তার বাসা। ব্যক্তিগতভাবেই তাকে চিনি। ছিনতাই করার মতো ছেলে সে না।’

আগামীনিউজ/এএস

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে