Dr. Neem on Daraz
Victory Day

কার্ল মার্ক্স : আজও প্রাসঙ্গিক


আগামী নিউজ | সাইফুস সালেহীন প্রকাশিত: মার্চ ৬, ২০২১, ১২:৫৯ পিএম
কার্ল মার্ক্স : আজও প্রাসঙ্গিক

ছবি: সংগ্রহীত

ঢাকা: আদিম সাম্যবাদী সমাজ থেকে আজকের আধুনিক বুর্জোয়া সমাজ পর্যন্ত মানুষের অগ্রযাত্রার যে ইতিহাস তা কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। প্রতিনিয়ত বিরুদ্ধ পরিবেশের সাথে লড়াই করে করে মানুষ নির্মাণ করে চলেছে সভ্যতার ইতিহাস। ইতিহাসের এই মহাযাত্রায় কেউ কেউ এমন অবদান রাখেন যা ইতিহাসকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করে; মানুষের চিন্তাজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। এমনই একজন চিন্তাবিদ হলেন মহামতি কার্ল মার্ক্স। একাধারে যিনি দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও সমাজ বিপ্লবী হিসেবে পরিচিত। 
শোষণ, বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে মুক্ত মানবের মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সংবেদনশীল মানুষ মাত্রই দেখে থাকেন। মার্ক্সের আগে অনেক ভাবুক, দার্শনিক সাম্যবাদী সমাজের চিন্তা করেছেন। গ্রিক দার্শনিক প্লেটো সাম্যবাদী সমাজ নির্মাণের একটি কাঠামো নির্দেশ করেছিলেন।

একইভাবে টমাস মুর’সহ আরও অনেকেই সমতার সমাজ কল্পনা করেছেন। তারা ভাবনার ক্ষেত্রে আন্তরিক হলেও কাক্সিক্ষত ওই সমাজ নির্মাণের সুনির্দিষ্ট কোন তত্ত্ব বা পদ্ধতি নির্দেশ করতে পারেন নি। যা পেরেছেন কার্ল মার্ক্স। অন্যান্য দার্শনিক থেকে মার্ক্স এখানেই বিশিষ্ট। তিনিই প্রথম সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার দার্শনিক ভিত্তি নির্মাণ করেন। এটা করতে গিয়ে মার্ক্স সমকালীন অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন যেমন পড়েছেন তেমনই ধ্রুপদী অর্থনীতি, দর্শন, নৃবিজ্ঞানসহ মানবজ্ঞানের প্রায় সকল শাখায় ব্যাপক অধ্যয়ন করেছেন। এই ব্যাপক অধ্যয়ন ও শোষিত শ্রমজীবী মানুষে প্রতি
গভীর মমতাই মার্ক্সকে বিপ্লবী দার্শনিকে পরিণত করে। 

এ যাবতকালে দার্শনিকরা জগতকে কেবল ব্যাখ্যা করে গেছেন কিন্তু ‘জগৎটা পাল্টানোর’ বাস্তব কোনো উদ্যোগ নেন নি। এই উপলব্ধি থেকেই মার্ক্স জগৎ পাল্টানোর বাস্তব ও সুনির্দিষ্ট দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক রূপরেখা তৈরি করতে মনোযোগী হন। তরুণ বয়সেই মার্ক্স জার্মান দার্শনিক হেগেলের জীবন ও জগতকে ব্যাখ্যার দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির প্রতি আকৃষ্ট হন। তবে নিজের দার্শনিক পর্যবেক্ষণ দিয়ে খুব দ্রুতই তিনি হেগেলীয় দর্শনের সীমাবদ্ধতা আবিষ্কার করে দেখান, হেগেলীয় দর্শন জগতকে দ্বান্দ্বিকভাবে ব্যাখ্যা করলেও এর চূড়ান্ত গন্তব্য পরম এক ‘ভাব’। যা জগত ও জীবন বোঝার ক্ষেত্রে এক গোলকধাঁধার সৃষ্টি করে। ফলে তিনি হেগেলের দ্বন্দ্ব তত্ত্ব গ্রহণ করলেও একে ‘ভাববাদ’ থেকে মুক্ত করে এর সাথে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করে নতুন তত্ত্ব নির্মাণ করেন, যা ‘দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ’ হিসেবে পরিচিত। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে মার্ক্স দেখালেন জগত ও জীবনের বিকাশ কখনো একরৈখিক বা সরল পথে হয় না।

জগতের সব কিছুতেই রয়েছে বিপরীতধর্মিতা, কিন্তু পরস্পর সংঘর্ষ যুক্ত উপাদান। বিপরীতধর্মী এই উপাদানের সংঘর্ষের ফলে বস্তুও ভেতরে ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে এবং ওই পরিবর্তন একটা নির্দিষ্ট মাত্রায় পৌঁছলে বস্তুটির গুণগত পরিবর্তন হয়ে নতুন একটি বস্তুতে রুপান্তর ঘটে। এভাবেই জগতের সকল কিছু বিকশিত হয়ে চলেছে। মার্ক্স এই পদ্ধতি শুধু প্রকৃতির ক্ষেত্রেই নয়, মানবসমাজ বিকাশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য বলে মনে করেন। আর এই পদ্ধতিতে সমাজের ইতিহাস পর্যালোচনা করতে গিয়ে তিনি ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্ব নির্মাণ করেন। এই তত্ত্বের আলোকে মার্ক্স দেখান মানবসমাজ আদিম সাম্যবাদী অবস্থা থেকে দ্বান্দ্বিকভাবে বিকশিত হতে হতে দাস সমাজ, সামন্তবাদী সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ হয়ে আধুনিক সাম্যবাদী সমাজের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দাস সমাজ থেকে পুঁজিবাদী সমাজ এই প্রতিটি স্তরে পরস্পরবিরোধী দুটি শ্রেণি বিদ্যমান যারা ইচ্ছা নিরপেক্ষভাবে পরস্পর সংগ্রামে লিপ্ত থাকে। এই শ্রেণিসংগ্রামের ফলে সমাজের ভেতর পরিমাণগত পরিবর্তন হতে হতে একসময় গুণগত পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ সমাজ বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং নতুন এক সমাজ তৈরি হয়। এভাবেই মানবসমাজ আজকের এই পুঁজিবাদী স্তরে এসে উপনীত হয়েছে। 

রক্ষণশীল সমাজ চিন্তাবিদরা এ পর্যন্ত প্রায়শই মার্ক্সের সাথে একমত পোষণ করলেও এরপর আর এগোতে চান না। তারা মনে করেন পুঁজিবাদ ইতিহাসের শেষ কথা। বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর তারা ঘোষণা দিয়ে বলেছেন ‘ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে গেছে’। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়াহীন আজকের পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা কি মানুষকে মুক্তি দিতে পেরেছে? আজকে পুরো পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যায় একদিকে মুষ্টিমেয় কিছু ধনকুবের পাহাড়সম সম্পত্তি কুক্ষিগত করে রেখেছে অপরদিকে কোটি কোটি নিরন্ন মানুষ সভ্যতার এই স্বর্ণযুগে অনাহারে, অপুষ্টিতে ভুগে করুণ মৃত্যু বরণ করছে। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় এটিই হওয়ার কথা। কার্ল মার্ক্স তাঁর ‘পুঁজি’ গ্রন্থসহ অন্যান্য গ্রন্থে পুঁজিবাদী অর্থনীতির ব্যবচ্ছেদ করে এই কথাই বলেছেন, শ্রমিকের শ্রম শোষণ ছাড়া পুঁজির বিকাশ, নিরাপত্তা ও মুনাফা বৃদ্ধি সম্ভব নয়। পুঁজিবাদী অর্থনীতি অন্তর্গতভাবেই মুনাফানির্ভর আর মুনাফার একমাত্র উৎস শ্রম শোষণ। এটি কোনো ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার নয়। নেহায়েত ব্যবস্থাগত ব্যাপার। ফলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে শ্রমিক শ্রেণি তথা সমাজের ৯৯ ভাগ মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়। এর বাস্তব উদাহরণ আমরা আজকের পৃথিবীতে প্রত্যক্ষ করছি। খোদ আমেরিকাতে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্ট সংগঠিত হয়েছে। যার একটি মূল স্লোগান ছিল ‘১ ভাগ বনাম আমরা ৯৯ ভাগ’। 

সারা পৃথিবীজুড়ে আজ শোষিত বঞ্চিত ৯৯ ভাগ মানুষ পুঁজিবাদী অর্থনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষও এর বাইরে নয়। বর্তমান করোনা সংকট মোকাবিলায় পুঁজিবাদী বিশ্বের চরম ব্যর্থতা এটি প্রমাণ করে দিয়েছে মুনাফা তাড়িত পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা মানুষের সর্বাধিক কল্যাণ তথা সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না। এখানেই কার্ল মার্ক্সের চিন্তা ও দর্শনের প্রাসঙ্গিকতা। মার্ক্স তাঁর সারা জীবনের তত্ত্বচর্চা ও বিপ্লবী সংগ্রামের মাধ্যমে এটিই বলতে চেয়েছেন, মানুষ অদ্যাবধি যা কিছু অর্জন করেছে তার সবটুকু অর্জিত হয়েছে মানুষের যূথবদ্ধ সৃজনশীল শ্রমের মাধ্যমে। কিন্তু আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ এটি অস্বীকার করে মানুষের ওই সৃজনশীল শ্রমের ওপর পুঁজির একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে অল্প কিছু পুঁজিপতির মুনাফার যুপকাষ্ঠে বলি দিচ্ছে পুরো মানবজাতিকে। পুঁজিবাদের এই প্রলয়ংকরী ধ্বংসলীলা থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করতে হলে আমাদের মহামতি কার্ল মার্ক্সের জীবন, দর্শন ও তাঁর নির্দেশিত সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদের পথেই অগ্রসর হতে হবে। 

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, সিপিবি, গফরগাঁও-পাগলা আঞ্চলিক কমিটি, ময়মনসিংহ

আগামীনিউজ/প্রভাত

 

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে