Dr. Neem on Daraz
Victory Day

শারদীয় দূর্গাপুজার ইতিহাস


আগামী নিউজ | অভিষেক সেনগুপ্ত (সংগৃহিত) প্রকাশিত: অক্টোবর ২৫, ২০২০, ০১:৫৩ পিএম
শারদীয় দূর্গাপুজার ইতিহাস

ছবি: সংগৃহীত

আজ মহানবমী, শারদীয় দূর্গোৎসবের ৪র্থ দিন। চন্দ্রের নবমী তিথিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আজ পালন করবেন মহা নবমী কল্পারম্ভ ও বিহিত পূজা। পুরাণ মতে, রামায়ণ যুগের অবতার শ্রীরামচন্দ্র লঙ্কা অধিপতি রাবণ বধের পর নবমী তিথীতে দুর্গার পূজা করেছিলেন ১০৮টি নীলপদ্মে। তাই দুর্গোৎসবের মহানবমীতে ষোড়শ উপাচারের সঙ্গে ১০৮টি নীলপদ্মে পূজিত হবেন দেবী দুর্গা। অন্য মতে, আজ নীলকণ্ঠ, নীল অপরাজিতা ফুল ও যজ্ঞের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে নবমী বিহিত পূজা। নবমী পূজায় যজ্ঞের মাধ্যমে দেবী দুর্গার কাছে আহুতি দেওয়া হয়। ১০৮টি বেল পাতা, আম কাঠ, ঘি দিয়ে এই যজ্ঞ করা হয়। জানা যায়, মহা অষ্টমীতে কুমারী পূজার পর নবমী সন্ধিক্ষণে অনুষ্ঠিত হয়েছে সন্ধিপূজা। মহিষাসুর নিধনের সময় দেবী দুর্গা প্রচন্ড ক্রোধে কৃষ্ণবর্ণ রূপ ধারণ করেছিলেন। তাই পূজার এই আচারের সময় দেবীকে চামুন্ডা রূপে পূজা করা হয়েছে, অর্থাৎ যিনি চন্ড ও মুণ্ডের বিনাশিনী। নানা আচারের মধ্যদিয়ে মহা নবমীর পূজা শেষে যথারীতি থাকবে অঞ্জলি নিবেদন ও প্রসাদ বিতরণ। মূলত আজই পূজার শেষ দিন। তবে বিজয়া দশমীর দিনেও বেশকিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে। আগামীকাল বিজয়া দশমীতে দুর্গাদেবীর দশমী বিহিত পূজা সমাপন ও দর্পণ বিসর্জন অনুষ্ঠিত হবে। এদিনই প্রতিমা বিসর্জনের মধ্যদিয়ে শেষ হবে শারদীয় দুর্গোৎসব।​ তাই কিছুটা হলেও এই দিন থেকেই সকলের মনে আনন্দের সাথে এক বিষণ্ণতাও থাকে।

"ঔঁ জয়ন্তি মঙ্গলা কালী, ভদ্র কালী কপালিনী,দূর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী, স্বাহা স্বধা নমস্তুতে।
এস স্ব চন্দন পুষ্প বিল্ব পত্রাঞ্জলী নম ভগবতী দূর্গা দেবী নমহ্।"

দেবী দূর্গার উৎপত্তি বেদ পরবর্তী যুগে।বেদের পাতায় কোথাও দূর্গার নাম নেই।দুর্গাকে আমরা পাই নারায়ণ উপনিষদে- তৈত্তিরিয় আরণ্যকের পাতায়।তবে ধর্মগুরুদের মতে দুর্গার পূজা বহুকাল আগে থেকেই এ উপমহাদেশের লোকেরা করে আসছে।তবে ভিন্ন নামে, ভিন্ন রুপে।

প্রাক-আর্য সমাজে কৃষিজ উৎপাদনের উৎস রূপে মাতা পৃথিবী পরবর্তী আর্য সমাজে অম্বিকারূপী দূর্গাতে পরিণত হয়েছেন। বৈদিকযুগের পর যখন এশিয়া মাইনর এলাকা থেকে যাযাবর মেষপালক গোষ্ঠী স্থায়ী বসতি গড়ে পাঞ্জাবে, তখন থেকেই অনার্যদের সাথে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ও মিথষ্ক্রিয়া তৈরি হয়।যার ফলে অনার্যদের লোকায়ত স্তরের কিছু দেব- দেবীর আর্যীকরণ ঘটে।দেবী দুর্গার কোন জন্ম ইতিহাস পাওয়া যায় না।দুর্গার তাৎক্ষণিকভাবে অসুরবধের উদ্দেশ্যে উৎপত্তির গল্প ছাড়া। আর্যদের আগেকার সভ্যতা মহেঞ্জোদারো মাতৃরূপী দেবীমূর্তির সন্ধান পাওয়া গেলেও সিংহবাহিনী ও অসুরনিধনকারিনী রণদেবী রূপে দুর্গার জন্ম সম্ভবত প্রথম খ্রিষ্টাব্দের আগে হয়নি।

আনুমানিক খৃঃ পূঃ দ্বিতীয় শতক থেকে তৃতীয় খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগ পর্যন্ত পারস্যের সাথে ব্যবসা আর ভাবের আদান প্রদানের কারণেই সিংহবাহিনী দুর্গার জন্ম।তবে দুর্গার সবচেয়ে বেশি প্রতাপশালী বর্ণনা পাওয়া যায় মার্কণ্ডেয় পুরাণ আর শ্রী শ্রী চন্ডীতে।চতুর্থ- পঞ্চম শতাব্দীতে মার্কন্ডেয় চন্ডী রচনার সময়েই মহাভারতের শেষভাগ রচিত হয়। মহাভারতে দুর্গা যশোদার কন্যা, কংসধ্বংসকারিনী, কুমারী ও মদমাংসপ্রিয়া।মহাভারতেই পাওয়া যায় অর্জুন আর যুধিষ্টিরের দুর্গার অরাধনা।তবে মহাভারতের এই পর্ব দ্বাদশ শতকে পুণর্লিখিত।

ত্রয়োদশ আর চতুর্দশ শতকের দেবী পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ, বৃহন্নান্দিকেশ্বর পুরাণ ও দেবী ভাগবত সহ আরো কয়েকটি পুরাণে বিভিন্ন যজ্ঞের পরিবর্তে দুর্গাপূজার বিধান পাওয়া যায়।তবে উপমহাদেশে দুর্গাপূজার ইতিহাস খুঁজতে চলে যেতে হয় সুলতানি যুগের দ্বারে। এখন যে পূজার চল তা শুরু হয় ইসলামী শাসনের সময়ে।হিন্দুদের নবজাগরণের জন্য ষোড়শ শতকের পন্ডিত রঘুনন্দন দুর্গাপুজার একটি রূপরেখা তৈরি করেন দূর্গাপূজা তরঙ্গিনী বইয়ে।এ সময়ে পুরোন পুরাণগুলো আবার নতুন করে পরিবর্ধন আর পরিমার্জন করা হয়।এরই ধারাবাহিকতায় কৃত্তিবাসী রামায়ণে যুক্ত হয় অকালবোধন।যে পুজা আমরা এখন করে থাকি।

কৃত্তিবাসী রামায়ণে ব্রক্ষ্মার নির্দেশে রাম শরৎকালে দুর্গাপূজা করে রাবণ বধের জন্য প্রস্তুত হন।আর চতুর্থ শতকের বাল্মিকী রামায়ণে তিনি সূর্যের পূজা করেন।তবে কথিত আছে বসন্তকালে যে স্বাভাবিক পূজা হয় সে পূজাও তিনি করেছিলেন। দুর্গাপূজার প্রথম ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণসহ যে বিবরণ পাওয়া যায়, তা কংসনারায়ণের দুর্গাপূজার।গৌড়ের রাজা কংসনারায়ণ পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে বা ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে সর্বপ্রথম মাটির প্রতিমায় দুর্গাপূজার প্রচলন করেন।মূলত সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য।সে আমলে প্রায় আট লক্ষ টাকা দিয়ে শারদীয়া দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।একই বছরে রাজশাহীর আরেক ভূ-স্বামী রাজা জগৎনারায়ণ প্রায় নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করে বাসন্তী দুর্গাপূজার আয়োজন করেন।শরৎকালে কেন এ পূজা, এর কারণ খুঁজতে যেতে হবে অথর্ববেদে।অথর্ববেদে শরৎকে নতুন বর্ষের প্রথম মাস হিসেবে গণনা করা হত।তাই আবার কোন পন্ডিতের মতে প্রাচীন নববর্ষের স্মারক হিসেবেই শরৎকালে এ পূজা হয়।


বাংলায় দুর্গাপূজা বলতে ১৬১০ সালের লক্ষীকান্ত মজুমদারের পূজাকেই বোঝায়।কলকাতার এ পূজায় ভক্তির চেয়ে বেশি ছিল বিলাস ব্যসন।এ সময়ে প্রভাবশালী জমিদার, সামন্তরাজরা ইংরেজদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্য এ পূজার চল করেন।আঠার উনিশ শতকের পূজা মূলত জমিদারদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।দেবী দুর্গা ঢাকায় ঠিক কবে এসেছিলেন তা বলা বেশ শক্ত। ইতিহাস বলে বল্লাল সেন চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি করেন ঢাকেশ্বরী মন্দির।অর্থাৎ দেবী দূর্গা সে আমলে ঢাকায় অপরিচিত ছিলেন না।আবার ফাঁক রয়ে যায়, বল্লাল সেনের ঢাকেশ্বরী মন্দির তৈরির ঘটনাও এখনো প্রমাণিত নয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রাচীন যে কাঠামো এখনো দাড়িয়ে তা কোনভাবেই কোম্পানি আমলের আগেকার নয়।

ঢাকার দুর্গাপূজার সবচেয়ে পুরোন তথ্য পাওয়া যায় অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্তের আত্মজীবনী থেকে।১৮৩০ সালের সূত্রাপুরের একটি পূজার উল্লেখ করেছেন তিনি।প্রায় দোতলা উঁচু ছিল দুর্গা প্রতিমাটি।সে সময়ে নন্দলাল বাবুর মৈসুন্ডির বাড়িতে পূজাটি হয়েছিল।তবে এরপর আর কোন বিস্তারিত বর্ণনা নেই সে পূজার। এছাড়াও ইতিহাস বলে ঢাকার রামকৃষ্ঞ মিশনের পূজাও এক সময়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।সে সময়ে গোটা বাংলাতেই ব্রাক্ষ্মণদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যেত।তবে কিছুকাল পরেই অন্যান্য শ্রেণীর মানুষের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে ব্রাক্ষ্মণদের আধিপত্য। অনেকে পুরোহিত ছাড়াই শুরু করে দেন পূজা।তবে সেটাও যে খুব একটা প্রচলিত রীতি ছিল তা নয়। ঢাকায় দুর্গাপূজা সাধারণ্যে আসতে প্রচুর সময়ের প্রয়োজন পড়ে।এর প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকায় সময় কাটানো বিভিন্ন মানুষের আত্মজীবনী থেকেই।হৃদয়নাথ, গণিউর রাজা, বুদ্ধদেব বসুসহ গত শতকের শুরুর দিকে যারা ঢাকায় সময় কাটিয়েছেন, তাদের কারো লেখাতেই আসেনি দুর্গাপূজার প্রসঙ্গ।

দুর্গাপূজা বিংশ শতকের শুরুতেও ছিল পারিবারিক, অভিজাতদের মাঝে।অভিজাতদের বাইরে কেবল এর সার্বজনীনতা অর্থাৎ এখন যে ধরণের পূজা প্রচলিত, তা শুরু হতে গত শতকের তিরিশের দশক লেগে যায়। তবে সার্বজনীন পূজা ব্যাপক আকারে শুরু হয় ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর।দেশ ভাগের পর এককভাবে পূজা করাটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে।এর ফলে ব্রাক্ষ্মণ-অব্রাক্ষ্মণ নির্বিশেষে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু হয়।তবে এখনো পারিবারিক পূজার চল রয়ে গেছে পুরোন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায়।৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিংবদন্তীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুরু হয় দেশের কেন্দ্রীয় দুর্গা পূজা। প্রথমদিকে যেহেতু কেবল বাবুগিরি আর ইংরেজদের সাথে সদ্ভাব বজায় রাখার জন্যই পালিত হত এ উৎসব, সে কারণেই ধর্মীয়ভাবের চেয়ে সেখানে বেশি প্রাধান্য পেত আমোদ-প্রমোদ।কিন্তু বিত্তবান বাবুরা দুর্গোৎসবের যে জোয়ার আনতে চেষ্টা করেছিলেন তাতে পাঁক ও আবর্জনাই ছিল বেশি। বাবুদের অর্থকৌলিন্য প্রকাশের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা লাভের উপায়ও ছিল এ উৎসব।

কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নক্সায় দুর্গাপূজার বর্ণনায় এসেছে বাঈজি নাচ, খেমটা নাচ, কবিগান, কীর্তনের।পূজায় ইংরেজদের আপ্যায়ণের জন্য প্রস্তুত থাকত ব্র্যান্ডি, শেরি, শ্যাম্পেন। হাকিম হাবিবুর রহমানের ঢাকা পচাস বারাস পেহলে বইতে উল্লেখ আছে যেকোন হিন্দু উৎসবে বাঈজি, খেমটা, সং আর গাঁজার আসর বসতই।আর নেশার চল এমনই ছিল যে, চুরুট তামাক ও চরসের ধোঁয়ায় প্রতিমাই ঢাকা পড়ে যেত।এখন পূজা অনেক ভদ্রস্থ।মূলত পুরোন ঢাকার শাঁখারি বাজার এলাকায় মেলা বসে।প্রবেশ পথেই থাকে বেশ কিছু গজা, মুরালি, সন্দেশের মত মিষ্টান্নের দোকান। নাগরদোলা তো যেকোন মেলার প্রাণ।আর শাঁখারি বাজার, তাঁতী বাজার, সূত্রাপুর এলাকা ভরে যায় মন্ডপে।এলাকার মন্দিরগুলোও সাজানো হয়। তবে প্রতিমার স্থান সঙ্কুলান না হওয়ায় প্রায়ই প্রতিমাগুলোকে রাস্তায় উঁচু মঞ্চের উপর বসানো হয়। নিচ দিয়ে মানুষের ভীড়।মন্দিরগুলোতে পুরুত ঠাকুর বসে প্রণামী নেন, প্রসাদ দেন দেবী-ভক্তদের।এর বাইরে ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি সার্বজনীন পূজার আসর করা হয়।তবে সার্বজনীন পূজার আরো একটি সম্ভ্রান্ত রূপ এখন দেখা যায় বনানী মাঠে।বনানী মাঠে এ পূজার চল বেশিদিন আগের নয়। সনাতন ধর্মের অনুসারী সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের পদচারণায়, তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালায় এ পূজা এখন অন্যতম আকর্ষণ ঢাকার।

মূলত গুলশান, বনানী, উত্তরার হিন্দুরাই এ মেলার মূল আয়োজক। পুরোন ঢাকার পূজামন্ডপে যেমন পাওয়া যায় ঐতিহ্যের আর ইতিহাসের, সেখানে বনানী মাঠেরটিতে খোঁজ মিলে আধুনিকতার।তবে এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে দুর্গাপূজা একটি অন্যতম অনুসঙ্গ। দুর্গোৎসব বাঙালি হিন্দুদের সর্বশ্রেষ্ঠ পূজা। বিভিন্ন পুরাণশাস্ত্রে দুর্গাদেবীর আদ্যাশক্তি মহামায়া, চণ্ডী, উমা, ভগবতী, পার্বতী প্রভৃতি নামে পূজিতা।ব্রক্ষবৈবর্তপুরাণ, কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ, দেবী ভগবত প্রভৃতি গ্রন্থে দেবী দুর্গার কাহিনী, কাঠামো ও লীলার বর্ণনা পাওয়া যায়।সেখানে কিছু কিছু পার্থক্য দেখা যায়।শরতের দুর্গাপূজা শারদীয়-দুর্গোৎসব মূলত মার্কন্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত শ্রী শ্রী চণ্ডীগ্রন্থ অনুসারে হয়ে থাকে। চণ্ডীগ্রন্থ খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত এবং যা ভাগবত পুরাণের পূর্বে রচিত হয়। মার্কন্ডেয় পুরাণের মূল অংশ চণ্ডী। কেউ কেউ মনে করেন, ভারতের নর্মদা অঞ্চল অথবা উজ্জয়িনীতে চণ্ডীর উৎপত্তি।অনেক গবেষক মনে করেন, চট্টগ্রাম করালডালা পাহাড় শ্রী চণ্ডীর আবির্ভাব স্থল।বৈদিক যুগ থেকেই দুর্গা নাম প্রচলিত।

ঋগবেদে বিশ্বদুর্গা, সিন্ধুদুর্গা, অগ্নিদুর্গা এই তিনটি নাম পাওয়া যায়।দুর্গাপূজা কেবল শাক্ত সমাজেই নয়, প্রাচীন বৈষ্ণব সমাজেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। মহাপ্রভু চৈতন্যদেব চণ্ডীমণ্ডপেই চতুষ্পটি চালু করেন। প্রাচীন বৈষ্ণব কবি চণ্ডীদাস, বৈষ্ণবাচার্য্য নিত্যান্দজীও দুর্গাদেবীর ভক্ত ছিলেন।মার্কন্ডেয় পুরাণ মতে, সত্য যুগের রাজা সুরথ, সমাধি বৈশ্য দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি গড়ে পূজা আরম্ভ করেছিলেন।কৃত্তিবাস রামায়ণ থেকে জানা যায়, ত্রেতা যুগে লঙ্কার রাজা রাবণ দেবীপূজার আয়োজন করে দেবীর আশীর্বাদধন্য হয়েছিলেন। অন্যদিকে রাবণ বধ এবং জানকীকে উদ্ধার করার জন্য শ্রী রামচন্দ্র বসন্তকালের পূর্বে শরৎকালে দেবীপূজা করেছিলেন।

উল্লেখ্য, শ্রী রামচন্দ্র দেবী ভগবতীকে অকালে বোধন করেছিলেন।মূলত দেবীর পূজা বসন্তকালে হয়ে থাকে।আর সেই থেকে শরতে দেবীপূজা অকালবোধন নামে পরিচিত। শরতের এই পূজাই আমাদের দুর্গোৎসব।শরতের সঙ্গে সঙ্গে হেমন্তে কাত্যায়নী দুর্গা, বসন্তে বাসন্তী পূজারও প্রচলন আছে। বাল্মীকি রামায়ণে দেখা যায়, রামের জয়লাভের জন্য স্বয়ং ব্রহ্মা দুর্গার স্তব করেছিলেন।মহাভারতে পাওয়া যায়, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদেশে অর্জুন দুর্গার স্তব করেছিলেন।দেবী দুর্গা দেবতাদের ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। সবচেয়ে প্রাচীন মহিষমর্র্দিনীর মূর্তিটি পাওয়া যায় পঞ্চম শতাব্দীতে। জানা যায়, প্রথম শতকে কুষান যুগে, পঞ্চম শতকে গুপ্ত যুগে, সপ্তম শতকে পল্লব যুগে এবং ১১-১২ শতকে সেন বংশের আমলে দেবী মহিষমর্দিনীরূপে পূজিত হয়েছেন।কুষান যুগে দুর্গা ছিলেন লাল পাথরের তৈরি।পাল যুগে অর্থাৎ ১২৮৯ সালে দেবী ত্রিনয়নী এবং চারহাত বিশিষ্ট। দশভুজা দুর্গার আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৮ শতকে।

বাংলাদেশে প্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন হয় মোগল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে, ষোড়শ শতাব্দীতে।মোগল সম্রাট বিদূষক কুল্লুকভট্টের পিতা উদয়নারায়ণের পৌত্র অর্থাৎ কুল্লুকভট্টের পুত্র তাহিরপুরের রাজা (বর্তমান রাজশাহী) কংসনারায়ণ রায় প্রায় সাড়ে আট লাখ টাকা ব্যয় করে প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসবে আয়োজন করেন।পড়ে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাদুরিয়ার (রাজশাহী) রাজা জয় জগৎ নারায়ণ প্রায় ৯ লাখ টাকা ব্যয় করে বাসন্তী দুর্গোৎসব করেন। তারপর থেকে রাজা ভুঁইয়ারা নিয়মিতভাবে দুর্গাপূজা আরম্ভ করেন। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিপ্লবের সময় বিক্রমপুর পরগনায় ভাগ্যকুল জমিদার বাড়ির রাজা ব্রাদার্স এস্টেটের এবং সাটুরিয়া থানার বালিহাটির জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজা আয়োজনের ব্যাপকতা কিংবদন্তি হয়ে আছে। ঢাকা শহরে সর্বপ্রথম দুর্গাপূজার প্রচলন ঘটে নবাব সলিমুল্লাহর আমলে।সে সময় সিদ্ধেশ্বরী জমিদার বাড়ি ও বিক্রমপুর হাউসে জাঁকজমকপূর্ণ পূজা হতো। ১৯২২-২৩ সালে আরমানিটোলার জমিদার ছিলেন বিক্রমপুরের রাজা ব্রাদার্সের বাবা শ্রীনাথ রায়।তার বাড়ির পূজাও সে সময় বিখ্যাত ছিল।লালবাগ থানার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পূজাও অনেক পুরনো। শত শত বছর ধরে এখানে নিয়মিত পূজা হয়ে আসছে।কিংবদন্তি আছে, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজিতা দুর্গার আরেক রূপ দেবী ঢাকেশ্বরীর নামেই ঢাকার নামকরণ।সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের অবদান এ পূজাকে সর্বজনীন করে তুলেছে।দুর্গাপূজাতেই ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে এক হয়ে যাই সবাই।সবার প্রাণের উৎসবে পরিণত হয় দুর্গাপূজা। দেবীর মূর্তি দেখা যায় না। দেবীর হাতের অস্ত্রগুলিও ভুল ভাবে দেবীকে প্রদান করা হয়।দেবীর মস্তকে জটা ও বামে অর্ধচন্দ্র থাকে।অধিকাংশ মূর্তিতে এটা দেখাই যায় না। আর দেবীর তিন কল্পে তিনবার মহিষ মর্দন করেন।

প্রথম কল্পে অষ্টাভুজা ভগবতী, দ্বিতীয় কল্পে ভদ্রকালীর হাতে মহিষের মুণ্ড মর্দিত হয়, তৃতীয় কল্পে দশভুজা রূপে মহিষ মর্দন করেন। মা দুর্গার আবির্ভাব হয়েছিলো দানব বিনাশের জন্য। মা দুর্গা অষ্টমীর ও নবমীর সন্ধিক্ষণে ভয়ানক উগ্রা রূপে চামুণ্ডা মূর্তি ধারন করেন। এই সময় তিনি ভয়ানক অট্টহাস্য দ্বারা চণ্ড ও মুণ্ড নামক দুই অসুরের শিরোচ্ছেদ করেন। এই সময়ে জপ করলে, দুর্গা নাম স্মরণ করলে দেবী প্রসন্না হন।এই সময় দেবীর তেজ এত ভয়ানক হয় যে পুরোহিত অতি পবিত্র, ভক্তিচিত্ত ও শাস্ত্র বিধানে পূজা ও বলি দান করেন।দেবীর চামুণ্ডা রূপের কথা চণ্ডীতে আছে।দানব নিধন কালে মায়ের মধ্যে থেকে মাতৃত্ব রূপ সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে বিনাশকারিনী রূপ দেখা যায়।তিনি অসুর নিধন করেন দাবানলের মতো।দুর্গা দেবীর অতিশয় ক্রোধা, কারন তিনি অসুর নিধনে লিপ্তা। এমনকি যখন তিনি মহিষের বুকে শূল বিদ্ধ করেন- তখন তার স্বরূপ অতিশয় উগ্রা ও ভয়ঙ্করী হয়।কিন্তু এই রকম মূর্তি বর্তমানে উধাও। অধিকাংশ মানুষ ভাবে মা দুর্গা শূল বিদ্ধ করে মহিষ বধ করেন- এটা ভুল। তিনি দশভুজা রূপে শূলবিদ্ধ করে তারপর চতুর্ভুজা চণ্ডী মূর্তিতে আবির্ভূতা হয়ে মহিষের মস্তক ছেদন করে বধ করেন।মা দুর্গা অষ্টমীর ও নবমীর সন্ধিক্ষণে ভয়ানক উগ্রা রূপে চামুণ্ডা মূর্তি ধারন করেন।এই সময় তিনি ভয়ানক অট্টহাস্য দ্বারা চণ্ড ও মুণ্ড নামক দুই অসুরের শিরোচ্ছেদ করেন।এই সময়ে জপ করলে, দুর্গা নাম স্মরণ করলে দেবী প্রসন্না হন। এই সময় দেবীর তেজ এত ভয়ানক হয় যে পুরোহিত অতি পবিত্র, ভক্তিচিত্ত ও শাস্ত্র বিধানে পূজা ও বলি দান করেন।দেবীর চামুণ্ডা রূপের কথা চণ্ডীতে আছে।

দেবী দুর্গার পরিচয় দিতে গিয়ে সুধীরচন্দ্র সরকার লিখেছেন, পরমাপ্রকৃতি, বিশ্বের আদি কারণ ও শিবপত্নী। এই বাক্যটিতে যেন দেবী দুর্গার প্রকৃত পরিচয় অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে রূপসী মাতৃদেবী বাংলায় পূজিত হন শরৎকালে, যখন নীলাভ আকাশে ফুরফুরে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় সাদা সাদা মেঘের ভেলা, নদীর ধারে উজ্জ্বল রোদে ফুটে থাকে বাতাসে দোল খাওয়া সাদা সাদা কাশের ফুল আর গ্রামীণ জনপদে দেবীর আগমনী ঘোষণায় উন্মাতাল ঢাকের শব্দে বাঙালির আদিম রক্তস্রোতে জেগে ওঠে এক আদিম মাতৃভক্ত নিষাদ। শরৎকাল থেকে বসন্ত কাল পর্যন্ত বাঙালির পূজার সময়; শারদীয়া দুর্গা পূজা দিয়ে এই বাৎসরিক মাতৃপূজার শুভ সূচনা। মনে রাখতে হবে-প্রাচীন বৈদিক আর্যরা করত যজ্ঞ। সে যজ্ঞে পশুবলি হত।

বাংলা, প্রাচীনকাল থেকেই যজ্ঞ না করে করত পূজা। পূজা শব্দটি অস্ট্রিক ভাষার শব্দ, যে ভাষায় প্রাচীন বাংলার অধিবাসীরা কথা বলত এবং এ কারণেই ভাষাটি অনার্য।

প্রাচীন ভারতে এক আশ্চর্য মানবিক ঘটনা ঘটেছিল..বুদ্ধ-মহাবীর প্রমূখ অহিংসপন্থীদের প্রবল আন্দোলনের ফলে রক্তস্নাত বীভৎস যজ্ঞ পরিণত হয়েছিল পবিত্র তীর্থে। প্রাচীন মানুষের মন যজ্ঞ থেকে তীর্থে ঘুরে গিয়েছিল। প্রাচীন বাংলায় জৈন ও বুদ্ধ ধর্মের ভারি সম্মান ছিল। পুন্ড্রনগর হয়ে উঠেছিল জৈন ও বুদ্ধ ধর্মের প্রধান কেন্দ্র। এতে করে অহিংস বাঙালি মনের পরিচয় পাওয়া যায়। দেবী মায়ের পূজার জন্য নয়নাভিরাম শরৎকালই বেছে নিয়েছে প্রকৃতিপ্রেমিক শিল্পরসিক বাঙালি বাংলা অবৈদিক আর অনার্য বলেই চিরকালই ছিল পূজা-অর্চনার দেশ। বাঙালি সুপ্রাচীন কাল থেকেই বহু লোকায়ত দেবদেবীর পূর্জা-অর্চনা করত। গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর "বাংলার লৌকিক দেবতা" বইটি থেকে আমরা প্রায় পঁয়ত্রিশজন লৌকিক দেব-দেবীর নাম জানতে পারি। এরা আসলে ছিল বৌদ্ধধর্মের দেবদেবী, বাংলায় বৌদ্ধযুগের অবসানকালে শিবের পক্ষভুক্ত হয়ে যায়। অস্ট্রিকভাষী নিষাদেরা প্রাচীন বাংলার গভীর অরণ্যে ‘বোঙ্গা’ দেবতার পূজা করত। কোনও কোনও পন্ডিতের ধারণা ওই বোঙ্গা থেকেই বাংলা শব্দের উদ্ভব। বাংলার লোকায়ত দেব-দেবীর রূপ কিন্তু কালের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে, সেই সঙ্গে বদলেছে পূজা-অর্চনার ধরন-ধারণও।

তবে সে পরিবর্তিত রূপের মধ্যেও যেন বিশ্বের আদি কারণরূপী এক মহামাতৃদেবীকে পাওয়া যায় তিনিই শিবপত্নী দুর্গা শিব। দুর্গার এক পরিচয়-তিনি শিবপত্নী। শিবই সর্বভারতীয় প্রধান দেবতা। শিবের ইতিহাস কম বিস্ময়কর নয়। কেননা, শিব অনার্য দেবতা, বৈদিক দেবতা নন; ব্রহ্মা, বিষ্ণু-প্রমূখ বৈদিক দেবতাকে অপসারণ করে শিবের সর্বভারতীয় দেবতায় মর্যাদা লাভ যেন ভারতীয় অনার্য ভূমিপুত্রদের বিজয়েরই প্রতীক। শিবের স্ত্রী হিসেবে কল্পনা করা হয়েছে পার্বতী উমা গঙ্গা দুর্গা ও কালীকে। শিবের পুত্র- গনেশ ও কার্তিক।কন্যা-মনসা ও লক্ষী।দেবী দুর্গার অতি পরিচিত এই প্রতিমাটির ব্যাখ্যা দেওয়া দরকার। তবে এ ব্যাখ্যা বাংলার নয়, যদিও ব্যাখ্যাটি বাংলায় গৃহীত হয়েছে ব্যাখ্যাটি পৌরাণিক আর্যদের ...একবার মহিষাসুরের (মহিষ+অসুর=মহিষাসুর) ধারণা হল সে কোনও দেবতা তাকে বধ করতে পারবে না; এই অহংকারে মহিষাসুর দেবতা ইন্দ্রকে সর্তক করে দেয় যে সে স্বর্গ জয় করে নেবে। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ইন্দ্র ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণুর আশ্রয় নেয়। দেবতারা ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন এবং তাদের পবিত্র দেহ থেকে স্বর্গীয় সুষমায় আচ্ছন্ন অপূর্ব সুন্দরী এক নারীর জন্ম হয় ইনিই দুর্গা!

একজন দেবতা দুর্গাকে অস্ত্র দিলেন, অন্যজন দিলেন বাহন..সিংহ, এরপর যুদ্ধে দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেন। পৌরাণিক আর্যদের ব্যাখ্যায় দুর্গা কিছুটা উগ্র, স্বাধীন ও কারও স্ত্রী নন।

 

লেখকঃ অভিষেক সেনগুপ্ত

(সংগৃহিত)

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে