Dr. Neem on Daraz
Victory Day

নজরদারিতে তৎপর উগ্রপন্থিরা


আগামী নিউজ | ডেস্ক রিপোর্ট প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২০, ০৮:৫৬ এএম
নজরদারিতে তৎপর উগ্রপন্থিরা

ছবি সংগৃহীত

ঢাকাঃ ভাস্কর্য ইস্যু নিয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে উগ্রপন্থিরা। অনলাইন থেকে প্রকাশ্যে সবখানেই তাদের তৎপরতা বেড়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুসূদন স্মৃতি ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন ভাস্কর্য ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাড়তি সতর্কতায় রয়েছে। গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক উগ্রপন্থিদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে পুলিশ।

পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) মো. সোহেল রানা  বলেন, ধর্মীয় ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া জানানোর ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হতে হবে। ধর্মীয় কোনো বিষয়ে তাৎক্ষণিক উত্তেজনা ছড়ায়, এমন কিছুর প্রচার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে নিষিদ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষের ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থা রয়েছে। এ সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে কিছু অপরাধমনস্ক মানুষ ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ নানা বিষয়ে মিথ্যাচার করে, গুজব ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা চালায়। এসব গুজব ও বিশৃঙ্খল সৃষ্টিকারীদের বিষয়ে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সত্যতা যাচাই না করে হুজুগে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানো, লাইক, কমেন্ট কিংবা কোনো কিছু শেয়ার করা থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে।

পুলিশের একাধিক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্থাপিত ভাস্কর্য নিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠা উগ্রপন্থিদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে অর্ধশত ব্যক্তিকে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

গত বুধবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে স্থাপিত ‘মধুসূদন দে স্মৃতি ভাস্কর্য’র একটি কান ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুক ও ইউটিউবসহ অনলাইনের বিভিন্ন মাধ্যমে ভাস্কর্যবিরোধী নানা ধরনের তৎপরতায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে উগ্রপন্থিরা। যদিও এসব উগ্রপন্থির সঙ্গে দেশের নিষিদ্ধঘোষিত কোনো জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি জঙ্গিবাদ ও জঙ্গি কর্মকাণ্ড অনুসরণকারী ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি)।

সিটিটিসির উপকমিশনার (ডিসি) সাইফুল ইসলাম বলেন, ভাস্কর্য ইস্যুতে যারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে নিষিদ্ধ কোনো জঙ্গি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে বিষয়টি নজরদারির মধ্যে রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা  বলেন, নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের উগ্রপন্থিরা মধুসূদন স্মৃতি ভাস্কর্যের কান ভেঙে ফেলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন। তবে বিষয়টি তদন্তের পর খোলাসা হবে বলেও জানান তিনি। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ভাস্কর্য ইস্যুতে সক্রিয় হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের নেপথ্যে নিশ্চয়ই কোনো বড় গোষ্ঠী রয়েছে। এজন্যই তাদের প্রকৃত পরিচয় শনাক্তের জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। ইতিমধ্যে ধর্মীয় ইস্যুতে উসকানিমূলক প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় ভাস্কর্য ভাঙচুরের পরিকল্পনার তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই তথ্যানুযায়ী রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের অন্তত অর্ধশত ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন জেলার এলাকাভিত্তিক উগ্রপন্থিদের তালিকা করে তাদের সবাইকে গোয়েন্দা নজরদারির আওতায় আনা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় পুলিশ কোনো ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। তাই অতি গোপনে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি এইসব উগ্রপন্থি ব্যক্তিকে শনাক্তের কাজ চলছে। যাতে দেশে বিশৃঙ্খলা ঘটানোর আগেই তাদের আইনের আওতায় আনা যায়।

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, মুসল্লি পুড়িয়ে হত্যা ও ফরাসি প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ঘিরে দেশে ধর্মীয় উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের পর থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সারা দেশের উগ্রপন্থিদের তালিকা তৈরির কাজ হাতে নেয়। সেটি এখনো চলমান রয়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুসূদন স্মৃতি ভাস্কর্য ভাঙচুরকারীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার সম্ভাব্য ভাঙচুরকারী ও উগ্রপন্থিদের তালিকা করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় বিভিন্ন ভাস্কর্যকেন্দ্রিক গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, ধর্মীয়সহ যেকোনো ইস্যুতে কেউ যদি কোনো ধরনের নাশকতা কর্মকা- পরিচালনা করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে র‌্যাবের কঠোর অবস্থান রয়েছে। সারা দেশের ১৫টি ব্যাটালিয়নের মাধ্যমে গোয়েন্দা ও অভিযানিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ধর্মীয় যেকোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয়ে ওঠে কিছু গোষ্ঠী বা ব্যক্তি। এবারও বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনায় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা র‌্যাব, সিআইডি, পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি), কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ও অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) সারা দেশেই গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করেছে।

সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা জানান, লালমনিরহাটের পাটগ্রামে ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক গ্রন্থাগারিক শহীদুন্নবীকে পুড়িয়ে হত্যার পর থেকে ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে উগ্রপন্থিরা সক্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। যদিও ওই ঘটনায় এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যাদের বিষয়ে সিআইডি তদন্ত করছে। ওই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। তারপরই ভাস্কর্য ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করে। এরই মধ্যে মধুসূদন স্মৃতি ভাস্কর্য ভাঙচুরের মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে একটি গোষ্ঠী।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, যারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সোচ্চার, তাদের সবাই সন্দেহভাজন অপরাধী নয়। তাদের সিংহভাগই আবেগের স্রোতে গা ভাসিয়েছে। এই আবেগপ্রবণ মানুষদের কারা ব্যবহার করছে, সেটাই সাইবার পুলিশ নজরদারি করছে এবং নিয়মিত ঊর্ধ্বতন কর্র্তৃপক্ষকে অবহিত করছে। তালিকাটা খুব দীর্ঘ নয়, ২০ থেকে ২৫ জন। তাদের প্রত্যেকের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারা আরও জানান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা অনলাইনে পোস্ট প্রদানকারীদের মাধ্যমে আইন ভঙ্গ হচ্ছে কি না তা যাছাই করে ফেইসবুক বা ইউটিউব কর্র্তৃপক্ষকে অবহিত করা হচ্ছে। এছাড়া বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কর্র্তৃপক্ষের (বিটিআরসি) সহযোগিতা নিয়ে বেশকিছু পোস্ট সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের বিশেষ সুপার এসএম আশরাফুল আলম  বলেন, ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে অনলাইনে যারা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন, উসকানি দিচ্ছেন তাদের সবাইকে কঠোর নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। তাদের সবার পরিচয় শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ চলছে।

বেশ কিছুদিন ধরেই দেশের সব ভাস্কর্য ভাঙার দাবি তুলে আসছিলেন কওমি বা দেওবন্দি হিসেবে পরিচিতদের একটি অংশ। প্রথম দিকে তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও ধীরে ধীরে দেশের সব ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার দাবি তোলেন। এছাড়া নতুন কোনো ভাস্কর্য স্থাপন করা যাবে না বলেও হুমকি দেন এসব সংগঠনের নেতারা। ২০০৮ সালে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গোল চত্বরে লালনের ভাস্কর্য নির্মাণের সময় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর আপত্তির মুখে সরিয়ে ফেলা হয়। ২০১৭ সালে একই গোষ্ঠীর দাবির মুখে হাইকোর্ট এলাকা থেকে গ্রিকদেবীর ভাস্কর্য সরিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকেই ভাস্কর্যবিরোধী উগ্রপন্থিদের সংখ্যা বাড়তে থাকে।

আগামীনিউজ/এএইচ  

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে