ডিসেম্বর ১৬,১৯৭১ বিজয় ঘোষিত বাঙ্গালির। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ পুনঃগঠনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তিনি। এক দিকে সংবিধান তৈরির কাজ, ত্রান বিতরন, মুক্তিযোদ্দাদের অস্ত্র সমারপন, মন্ত্রীপরিষদ গঠন, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়, ভারতীয় সেনা বিদায় অর্থাৎ দেশ পুনঃগঠনে যা যা করা দরকার তাই করছিলেন ।তার কিছু কাছের মানুষ তাকে যে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবে তা তিনি কখনো কল্পনা করেন নাই।
দুঃখ করে বললেন - ’সাতকোটি মানুষ আট কোটি কম্বল, আমারটা কোথায় ? স্বাধীন দেশে মানুষ পায় সোনার খনি আর আমি পেয়েছি চোরের খনি’। একদিকে ত্রান সামগ্রী নিয়ে বিব্রতকর অবস্থা অন্য দিকে ষড়যন্ত্রের জাল বুন্তে থাকল জাতিয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুরা । বাংলাদেশ স্বাধীন হোক যারা চায়নি তারা দেশের সুবিধবাদিদের দিয়ে ইহুদিবাদী কার্ল মার্কসের মূলমন্ত্র লেলিনের সমাজতন্ত্রে বৈজ্ঞানিক শব্দ জুড়ে দিয়ে শুরু করল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। মাত্র জন্ম নেয়া একটি শিশু রাষ্ট্রর বিরুদ্ধে গঠন করল গনবাহিনী। মগজ ধুলাই করে দেশের শিক্ষিত যুব সমাজ কে শামিল করল তাতে।
আর একজন শুরু করল নাস্তিক মাও সেতুং এর সাম্য বাদি বা পিকিং পন্থি রাজনিতি। গড়ে তুলল আন্ডার গ্রাউন্ড আর এক বাহিনী যার নাম সর্বহারা । এছাড়াও নামে-বেনামে আর কত সশস্ত্র গ্রুপ গড়ে উঠল দেশে। নিরীহ মানুষের ঘুম হারাম করে দিল তারা। দেশে চরম অশান্তি সৃষ্টি করল ।
এর সাথে শুরু হল আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র । খাদ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিল বিদেশীরা । সদ্য স্বাধীন দেশে শুরু হল চরম দুর্ভিক্ষ। সব কিছু মিলে বঙ্গবন্ধু যখন অসুস্থিতে তখন একদল বিপথগামী সেনা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। বিদেশী মদদে জাতীয় বেঈমানরা শামিল হল তাতে। অবশেষে ১৫ আগস্ট,১৯৭৫ নির্মম ভাবে সপরিবারে হত্যা করল তাকে। শুরু হল এক কালো অধ্যায় ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনে দেয়া ২০টি উক্তি বিশ্লেষণ করলে বুঝা যায় তিনি কত বড় মাপের নেতা ও দেশপ্রেমিক ছিলেন। বাঙালি জাতিকে তিনি কত ভাল্ বাসতেন, তাদের কত বিশ্বাস করতেন।তিনি কখন ও ভাবতেও পারেন নাই যে, বাঙালী জাতী তার বুকে গুলি চালাবে।
১. এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম!
২. গণআন্দোলন ছাড়া, গণবিপ্লব ছাড়া বিপ্লব হয় না।
৩. অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোন দিন একসাথে হয়ে দেশের কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।
৪. আমার সবচেয়ে বড় শক্তি আমার দেশের মানুষকে ভালবাসি, সবচেয়ে বড় দূর্বলতা আমি তাদেরকে খুব বেশী ভালবাসি।
৫. যে মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তত, কেউ তাকে মারতে পারে না।
৬. যখন তুমি কোন ভদ্রলোকের সাথে খেলবে তখন তোমাকে ভদ্রলোক হতে হবে, যখন তুমি কোন বেজন্মার সাথে খেলবে তখন অবশ্যই তোমাকে তার চাইতে বড় বেজন্মা হতে হবে। নচেত পরাজয় নিশ্চিত।
৭. প্রধানমন্ত্রী হবার কোন ইচ্ছা আমার নেই। প্রধানমন্ত্রী আসে এবং যায়। কিন্তু, যে ভালোবাসা ও সম্মান দেশবাসী আমাকে দিয়েছেন, তা আমি সারাজীবন মনে রাখবো।
৮. সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচারা দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাধা দিতে পারবে না।
৯. সাত কোটি বাঙ্গালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।
১০. দেশ থেকে সর্বপ্রকার অন্যায়, অবিচার ও শোষণ উচ্ছেদ করার জন্য দরকার হলে আমি আমার জীবন উৎসর্গ করব।
১১. এ স্বাধীনতা আমার ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না খায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি এদেশের মানুষ যারা আমার যুবক শ্রেণী আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।
১২. ভিক্ষুক জাতির ইজ্জত থাকে না। বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে এনে দেশকে গড়া যাবে না। দেশের মধ্যেই পয়সা করতে হবে।
১৩. যিনি যেখানে রয়েছেন, তিনি সেখানে আপন কর্তব্য পালন করলে দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে না।
১৪. সরকারী কর্মচারীদের জনগণের সাথে মিশে যেতে হবে। তারা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তারা জনগণের বাপ, জনগণের ছেলে, জনগণের সন্তান। তাদের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।
১৫. সমস্ত সরকারী কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন।
১৬. গরীবের উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে।
১৭. জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সাথে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন?
১৮. দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজও দুঃখী, যারা আজও নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি।
১৯. বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।
২০. বাংলার মাটিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই।
সব কিছু চাক্ষুষ দেখে এবং সত্য অনুভব করে আমার মনে হয়, আমরা একটা অকৃতজ্ঞ জাতী, বঙ্গবন্ধু এখনও অপ্রকাশিত এবং স্বাধীনতা অরক্ষিত !