ফাইল ছবি
গর্ভবতী মায়ের গর্ভকালীন বা গর্ভ ধারনের ৫ মাস পরে অনেকের উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। তাকে গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ বলি। নিয়মিত চিকিৎসকের তত্বাবধানে না থাকলে এই প্রেশার বিপদজনক হতে পারে, যাহাকে প্রি একলামশিয়া বলে।
প্রি একলামশিয়া হলো প্রেশারের কারণে গর্ভবতী মায়েদের একাধিক অঙ্গের স্বাভাবিক কাজের বিঘ্ন ঘটা সাথে পা ফুলে যাওয়া ও প্রোটিনিউরিয়া (Multi system disorder).
প্রি একলামশিয়ার কারন- প্রি একলামশিয়ার বেসিক প্যাথলজি হলো রক্ত নালীর সংকোচন। প্রেগ্ন্যাসিতে রক্ত নালীর এন্ডোথেলিয়াম থেকে বিভিন্ন রকম প্রস্টাগ্লান্ডিন নিসৃত হয়। এর কিছু প্রস্টাগ্লান্ডিন রক্ত নালী সংকোচন করে আর কিছু প্রস্টাগ্লান্ডিন রক্ত নালী প্রসারণ করে। প্রি একলামশিয়ায় যে সকল প্রস্টাগ্লান্ডিন রক্ত নালী সংকোচন করে তার পরিমাণ বেড়ে যায় আর যে সকল প্রস্টাগ্লান্ডিন রক্ত নালী প্রসারণ করে তার পরিমাণ কমে যায়। তাছাড়া রক্তে নাইট্রিক অক্সাইড কমে যায় ফলে প্রেশার বেড়ে যায়। এন্ডোথেলিয়াম থেকে এন্ডোথেলিন প্রোডাকশন বেড়ে যায় ফলে ভাসকুলার সংকোচন হয় ও প্রেশার বেড়ে যায়। প্রেগ্ন্যাসিতে টেরাটোজেনিক ইফেক্ট আছে বলে সকল এন্টি হাইপারটেনসিভ ব্যবহার করা যায় না। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়েই ওষুধ খেতে হবে।
একলামশিয়া (ইংরেজি: Eclampsia) প্রি-একলামসিয়ায় আক্রান্তগর্ভবতী মহিলাদের খিঁচুনি হওয়াকে একলামসিয়া বলে। প্রি-এক্লাম্পসিয়া হলোগর্ভবতী মহিলাদের এমন এক রোগ যেখানে রক্তচাপ বেড়ে যায় এবং হয় প্রস্রাবেরসাথে প্রচুর প্রোটিন নির্গত হয় নতুবা অন্যান্য অঙ্গের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়। একলামশিয়া একটি ইমারজেন্সি কন্ডিশন। একলামশিয়া হলে রোগীর আত্মীয়রা যেমন উদ্বিগ্ন হন, এক একটা খিঁচুনি উঠলে মনে হয় এই বুঝি রোগীর প্রাণ গেল। তাই চিকিৎসকরাও চিকিৎসা দিতে সাহস করেন না ও তেমন সাপোর্ট পান না। কারণ একলামশিয়ায় মৃত্যু হার অনেক বেশী (৩০%)। একারণে রোগীর মৃত্যু হলে আত্মীয় স্বজনরা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেন না।
এসব প্রি একলামশিয়া রোগীকে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না দিলে নিম্নের যে কোন কম্প্লিকেশন দেখা দিতে পারে- খিঁচুনি, হার্ট ফেইলিউর, ব্রেইন স্ট্রোক, হেল্প সিন্ড্রোম, রেনাল ফেইলিউর, গর্ভের বাচ্চা মারা যাওয়া এমন কি রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
একলামশিয়ার চিকিৎসা- যত দ্রুত সম্ভব একলামশিয়া রোগীকে এন্টি কন্ভালসেন্ট দিতে হবে। যথাসম্ভব সেকেন্ডারি/টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতালে রেফার করতে হবে। একলামশিয়ার ক্ষেত্রে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট একটি যুগান্তকারী ঔষধ। হাজারো রোগীর জীবন বাঁচিয়েছে এই ম্যাগনেসিয়াম সালফেট। প্রি একলামশিয়া রোগীকে এই ম্যাগনেসিয়াম সালফেট প্রয়োগ করলে অনেক ক্ষেত্রে খিঁচুনি এরানো সম্ভব। একই সাথে এন্টি হাইপারটেনশিভ দিতে হয়। ইমারজেন্সি কন্ডিশনে ইঞ্জেকট্যাবল (শিরা পথে) এন্টি হাইপারটেনশিভ দিতে হয়। সিভিয়ার প্রি একলামশিয়ায় লোডিং ডোজ ম্যাগনেসিয়াম সালফেট দেয়া যায়।
সিভিয়ার প্রি একলামশিয়া বা একলামশিয়ার মেইন চিকিৎসা প্রেগন্যান্সি টারমিনেশন। বেবি টারমিনেট করলে ও যথাযথ চিকিৎসা পেলে ৯০% ক্ষেত্রে ২৪ ঘন্টার মধ্যে প্রেশার নেমে আসে, যার ফলে রোগী দ্রুত ইম্প্রুভ হয়।
দেশের বেশিরভাগ নারী গর্ভকালীন সময়ে ঠিকমতো চেকআপ করান না। স্বাস্থ্যের অবনতির দিকটাকেও যথাযথ গুরুত্ব দেন না। এদের ক্ষেত্রে প্রি-একলামশিয়া ঘটার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। যা মা ও বাচ্চা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। এ সময় কিছু লক্ষণ দেখা যেতে পারে যেমন মুখ, হাত-পা বা সারা শরীর ফুলে যাওয়া, প্রচণ্ড মাথা ধরা, চোখে ঝাপসা দেখা। এসব ক্ষেত্রে মাকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিতে হবে। যথাসময়ে চিকিৎসা না হলে খিঁচুনি বা একলামশিয়াতে রূপ নিতে পারে যা খুবই বিপজ্জনক। এতে মায়ের প্রচুর রক্তক্ষরণ, গুরুত্বপূর্ণ অর্গান ফেইলিওরসহ জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এমনকি মা ও বাচ্চা উভয়েরই মৃত্যুঝুঁকি থাকে।
তাই প্রি-একলামশিয়া প্রতিরোধ করতে নিয়মিত গর্ভবতী মায়ের চেকআপ করাতে হবে। গর্ভাবস্থায় শতকরা ২ থেকে ৮ ভাগ রোগী প্রি-একলামশিয়ার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। এতে মায়ের যেমন ক্ষতি তেমনি গর্ভের বাচ্চাও পরিপূর্ণ পুষ্টি লাভ করতে পারে না। তাই মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে ও তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে প্রি-একলামশিয়া প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সবাইকে সচেতন হতে হবে। মা ও শিশুর সুস্থতার জন্য গর্ভাবস্থায় নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরামর্শ দিলেন এই চিকিৎসক।
উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হাসপাতালে ১০০ এর উপরে একলামশিয়া রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছেন ডা. রনজিৎ বিশ্বাস। এখন পর্যন্ত কোনো রোগীর দুর্ঘটনা ঘটেনি বা কোন রোগীকে রেফারও করতে হয়নি। সকল রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে।
( বিঃ দ্রঃ নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় ডা. রনজিত বিশ্বাসের মা খিঁচুনিতে "টিটানাস" মারা যায়। তখন থেকে তার স্বপ্ন ছিল মুমূর্ষু মায়েদের সেবা দেওয়ার।)
লেখক-
ডা. রনজিৎ বিশ্বাস
সহকারী অধ্যাপক, গাইনী বিভাগ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজ এন্ড হাসপাতাল।