ছবিঃ সংগৃহীত
ঢাকাঃ মুক্তিযুদ্ধ ও তাঁর পূর্ববর্তী আন্দোলন-সংগ্রামের ক্ষেত্রে ঝালকাঠি রয়েছে এক অসামান্য গৌরবময় ইতিহাস,যার বিবরণ সংক্ষিপ্ত পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়।কারণ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা পর্যন্ত সময়ের মধ্যবর্তী আন্দোলনসূমহ, যেমনঃ ৫২,৬৪,৬৬,৬৯,৭০ এর ইতিহাস খুবই দীর্ঘ।এসব আন্দোলনে পশ্চিম পাকিস্থানি সামরিক স্বৈরশাকদের বিরুদ্ধে এখানের সচেতন জনতার পাশাপাশি ছাত্র সমাজের ত্যাগ ও দুঃসাহসী ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় নির্বিচারে বাঙালী নিধন ও বাংলার নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর।সারদেশের ন্যায় অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে ঝালকাঠি।
মুলত ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনামুলক ভাষণের পর পরই এখানের ছাত্র- জনতার দলমত নির্বেশেষে এক কাতারে শামিল হয়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশনার আলোকে স্বাধীনতাযুদ্ধেও প্রাথমিক প্রস্তুতি চালিয়ে যায়। ক্রমেই স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের অংশগ্রহণ এতোটাই বেড়ে যায়,যার ফলে তৎকালীন সংগ্রাম কমিটির নেতৃবৃন্দকে তা সামাল দিতে বেশ বেগ পেতে হয়। এরই এক পর্যায়ে অর্থাৎ ২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তাটি স্থানীয় সংগ্রাম কমিটির নেতা তথা আওয়ামীলীগ সভাপতি ডাঃ এম এ রফিক ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলি খানের হাতে এসে পৌছায় এবং মূহর্তে এ খবর সাড়া শহরে ছড়িয়ে পরে।খন্ড খন্ড মিছিল আর জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা শহর ও সংলগ্ন এলাকা সূমহ। এরপর শুধু প্রশিক্ষণ দেয়া নেয়ার পালা। এ প্রক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামীলীগ নেতা ডাঃ এম এ রফিক, মোহাম্মদ আলী খান, মোঃ বেলায়েত হোসেন, মৌজে আলী সরদার, শামসুল ইসলাম চাঁদ, শামসুল আক্কাস, আব্দুল বারী(ন্যাপ), মুজিবুল হক মেহেদী(সর্বহারা পার্ঠি), সৈয়দ শামসুল আলম, মোবারক হোসেন মল্লিক, ফয়জুল হক মিলু, দিলীপ বসু, সঞ্জীব বসু, শান্তি শাহা, দুলাল সাহা(প্রবন্ধকর),মোস্তফা কামাল খান, চিত্তরঞ্জন দত্ত, দেলোয়ার হোসেন, রতন হাওলাদার ,শহীদ ইমাম পাশা, আনোয়ার হোসেন, গৌর নিতাই সাহা, আব্দুস সালাম, জাহাঙ্গীর হোসেন, শামসুল হুদা রানা(তারা),শামসুল আলম লাল, শামসুল আজিম সোনা প্রমুখ।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পূর্বেই একুশে মার্চ ঝালকাঠি থানার সেকেন্ড অফিসার শফি সাহেবের সহয়তায় থানার অস্ত্রাগার থেকে ১১ টি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল মুক্তিবাহিনী ও সংগ্রাম পরিষদের নেতারা লুটে নেন। এছাড়া ২৬ মার্চ বরিশাল পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে লুণ্ঠিত ২৫ টি রাইফেল আমির হোসেন আমু (বর্তমান শিল্পমন্ত্রী),ঝালকাঠি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি সরদার শামসুল হক আক্কাস- এর হাতে তুলে দিয়ে শত্রু ঘায়েলের কিছু কৌশলী দিক নির্দেশনা দিয়ে যান।এদিয়েই পুরাতন স্টেডিয়াম ও গার্লস স্কুল মাঠে মোহাম্মদ আলী খান, সেকেন্ড অফিসার শফি সাহেব, একজন সেপাহী এবং আঃ রশিদ ফকির শতাধিক যুবককে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন। এরপর থেকে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশনায় স্থানীয় সকল সরকারি কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে টানা ২৭ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত বলবৎ ছিলো। এরপর বিকেলে ঝালকাঠি নেমে আসে এক মহাবিপর্যয়।
২৫ এপ্রিল স্থানীয় লঞ্চঘাটে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আদম আলী নামে এক পদলেহীর মৃত্যুর খবর ২৬ এপ্রিল বরিশাল পাক ক্যাম্পে পৌঁছালে ২৭ এপ্রিল গান বোটে এসে স্থানীয় সুগন্ধা নদী থেকে মুহুর্মুহু মর্টার সেল নিক্ষেপ করলে মুহূর্তেই শহর প্রায় জনশূন্য হয়ে পরে।ওদের ভারী অস্ত্রের সাথে টিকতে না পেরে মুক্তিযোদ্ধারাও দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ সুযোগে হানাদার বাহিনী প্রায় দেড়’শ বছরের ঐতিহ্যের বাণিজ্য বন্দর ঝালকাঠিকে আগুনে পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। মহোৎসব চালায় হত্যা, লুট ও ধর্ষণের। আর ওই সব কুকর্মে সহায়তা করে স্থানীয় মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীসহ স্বাধীনতা বিরোধী পাক দোসররা। পাক সেনাদের দেয়া আগুনের লেলিহান শিখা ১২-১৫ মাইল দূর থেকে দেখা গেছে।এ আগুন জ্বলে ৩/৪ দিন পর্যন্ত।
এদিকে শহর ছাড়ার সময় পালবাড়িস্থ খাদ্যগুদাম খুলে উন্মুক্ত করে দিলে সাধারণ মানুষ যে যতটা পেরেছে চাল নিয়ে গ্রামে চলে যায়। আর মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্রসহ বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে শহরের উত্তরাঞ্চলে পেয়ারাগানসহ বিভিন্ন গ্রামে চলে যায়। বেশাইনখান গ্রামে রেজাউল করীম আজাদ ওরফে মানিকের নেতৃত্বে ঢাকা থেকে আসা একদল যুবক পাকবাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য পূর্বেই সংগঠিত ছিলেন। কিন্তু পাকবাহিনীর ভারী অস্ত্রের অপারেশন শুধু হাতে গোনা ক’টি রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধের চেষ্টাও ছিল বিপদ ত্বরান্বিত করা। অগত্যা আওয়ামীলীগ নেতা সরাজ পাল,মোহাম্মদ আলী খান, মোঃ বেলায়েত হোসেন,দারোগা শফি সাহেব প্রমূখ ব্যক্তিরা কির্ত্তীপাশা সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে যুবকদের গেরিলা কলাকৌশল প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছিলেন।এরই মধ্যে ঝালকাঠিতে রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী গঠিত হয়। এরা মুসলিম লীগ, জামায়াত, এনএসএফ,” “শান্তিকমিটি” ও পাক দালালদের প্রত্যক্ষ মদদ এবং সহযোগিতায় কালীবাড়ি, হিন্দুদের বাড়ী-ঘর লুটপাট, ধর্ষণ, মালাউন(হিন্দু) সহ আও্যামীলীগ নেতাদের পাকড়াও অভিযান শুরু করে। এই দালাল গোষ্ঠীই কির্ত্তীপাশা ও সংলগ্ন এলাকাসমূহে আত্নগোপনে থাকা নেতৃবৃন্দ ও মুক্তিবাহিনীর অবস্থান এবং ঝালকাঠি থানার অস্ত্রলুটের খবর সেনাক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। এরপর জুন মাসের ১৯/২০ তারিখে কির্ত্তীপাশার বেশাইখান গ্রামের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করলে “মানিক বাহিনীর”র ২৪ সদস্যের দলটি মরণপণ প্রতিরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় এবং সকলেই শহীদ হন। এ সময় থেকে মুক্তিবাহিনীর কিছু কিছু সদস্য ভারতে চলে যেতে থাকে। সেখানে বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ঢুকে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়। যার মধ্যে ঝালকাঠি সদর সহ এর আওতাধীন অনেকাঞ্চলেরই ছাত্র-জনতা ছিলো। ঝালকাঠির সব অপকর্মের হোতা ছিল তৎকালীন সিআই শাহ আলম, ওসি সেকেন্দার আলী, মুসলিম লীগ জামায়াত ও পাকিস্থানি দালালরা। এদের পরামর্শে পেয়ারা বাগানসমূহে বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চলের আত্বগোপনে থাকা মানুষদের হত্যা এবং জ্যান্ত ধরে এনে স্থানীয় বধ্যভুমিতে(বর্তমান পৌর খেয়াঘাট) গুলি করে হত্যা করা ছিলো নিত্যদিনের ঘটনা।
প্রতিদিন ডজন ডজন নারী পুরুষ ধরে এনে যুবতী ও গৃহবধুদের নির্বিচারে ধর্ষণ করে বেয়নেট দিয়ে স্তন এবং যৌনাজ্ঞ ক্ষতবিক্ষত করে মেরে ফেলতো,আর পুরুষদের সারারাত হাজতে রেখে ভোরের আজানের সময় একসাথে পিছমোড়া দড়ি বেঁধে সুগন্ধা পাড়ের বধ্যভূমিতেফ নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হতো।এই লাশগুলোর কিছু অংশ নদীতে ভেসে যেত আর বাকিগুলো মাটির নিচে গর্তে পুঁতে ফেলতো। প্রসঙ্গত,১৯৭২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বংঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নৌ-পথে দক্ষিণাঞ্চল সফর শেষে ঢাকায় ফেরার পথে লঞ্চ থেকে ঝালকাঠির বধ্যভূমিতে নামেন।সেখানে পুঁতে ফেলা কিছু লাশের অংশ বিশেষ কঙ্কাল একটি কাঠের বাক্সে নিয়ে যান জাদুঘরে সংরক্ষণের জন্য। বাকি অংশের কঙ্কাল তুলে শহীদের স্মৃতি রক্ষায় নির্দেশ দিয়ে যান, যা দিয়ে স্থানীয় পুরাতন স্টেডিয়ামের দক্ষিণে প্রান্তে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়।
পরিশেষেঃ মুক্তিযুদ্ধে ঝালকাঠির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও কলেবর বৃদ্ধির শঙ্কা মাথায় রেখে একটি খন্ডিত চিত্র তুলে ধরার এটি প্রয়াস মাত্র। শেষ করার আগে ঝালকাঠির মুক্তিযুদ্ধে ক’জন দঃসাহসী বীর যোদ্ধার নাম স্মরণ না করলেই নয়ঃ মেজর এম.এ. জলিল, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, সিরাজ সিকদার,সেলিম শাহ নেওয়াজ,মুজিবুল হক মেহেদী,মিলু,মজিদ,আনোয়ার,বিপ্লব,আসাদ,শশাংক পাল,আব্দুল আউয়াল,সুলতান মাস্টার, আবুল কালাম আজাদ,সেকেন্দার আলী, আবুল বাশার প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য যুদ্ধঃ চাচৈর যুদ্ধ, ভীমরুল যুদ্ধ, মাদ্রার যুদ্ধ, দরগাবাড়ির যুদ্ধ, রাজাপুরের যুদ্ধ প্রভূতি। পাঠক, যেহেতু পরিসরের সীমাবদ্ধতার কারণে খন্ডিত এ লেখায় কাহিনী, বিষয়, ব্যক্তি ও স্থান বাদ পড়েছে, তা আমার অনিইচ্ছাকৃত ত্রুটি। এজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
সকলের প্রত্যশাঃ আর দেরি ও শৈথিল্য নয়। অচিরেই ঝালকাঠি জেলার সকল বধ্যভুমিতে সরকারি উদ্যেগে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এখন সময়ের দাবি।।
আগামীনিউজ/নাসির