রক্তচোষা ড্রাগনের কবলে বৈশ্বিক অর্থনীতি

মিথুন মুৎসুদ্দী সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২০, ০৬:০৬ পিএম
সংগৃহীত ছবি

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম ধরা পড়ে প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস। এরপর বিশ্বের অন্তত ২০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস- রূপ নিয়েছে মহামারি হয়ে। বিশ্বজুড়ে তাণ্ডব সৃষ্টি করে চলা নোভেল করোনা ভাইরাস কি সত্যিই প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি, নাকি এটাকে চীনের ল্যাবে তৈরি করা হয়েছে? এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু থেকেই উঠছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও ইরান দাবি করেছে, করোনা কোন ভাইরাস নয়, এটা চীনের উহানের ল্যাবে তৈরি মারাত্মক জৈব রাসায়নিক বোমা। তবে চীন জোর গলায় এটাকে 'ষড়যন্ত্র তত্ব' আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে।

দ্য ব্লিজ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক কালে প্রকাশ্যে আসা বেশ কয়েকটি নতুন প্রমাণ এই ইঙ্গিত দেয় যে ভাইরাসটি চীনের উহান শহরে একটি ভাইরোলজি ল্যাবেই তৈরি করা হয়েছিল। ন্যাশনাল রিভিউয়ের সিনিয়র সংবাদদাতা জিম জেরাঘাটির লেখা একটি দীর্ঘ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। করোনা নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের জন্য তিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং ইউটিউবার ম্যাথু টাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ দিন চীনে অবস্থান করেছেন। বিশদভাবে তদন্ত করেছেন। সম্প্রতি তিনি ইউটিউবে বেশকিছু ভিডিও আপলোড করেছেন, সেখানে ভাইরাসটির উৎস সনাক্ত করতে পেরেছেন বলে দাবি করা হয়েছে। সামনে আসে আরো একটি প্রমাণও, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি কর্তৃক গত বছরের শেষের দিকে কাকতালীয়ভাবে দুটি সন্দেহজনক চাকরির অফার পোস্ট করা হয়। যাতে বলা হয় ভাইরোলজিস্ট নিয়োগের কথা। তবে কি চীন বায়োলজিক্যাল উইপন অর্থাৎ জীবাণু অস্ত্র বানাতেই করোনাভাইরাসটি তৈরি করছিল? প্রশ্ন আসে এরকমই ভয়ংকর কিছু। 

কিন্তু, আমাদের মূল আলোচনার মোড়টা একটু ভিন্ন। তা হল, চীনের জাতিগতভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আগ্রাসন।

সারা বিশ্বে চীন যে আতঙ্কের নাম- সেটা কেবলই করোনা ভাইরাসের জন্যে নয়। বন্ধুরূপে চীন তাদের জাতীয় প্রতীক ড্রাগনের মতই ভয়ংকর রক্তচোষা। চীনের হত্যালীলা নতুন কিছু কি? - প্রসঙ্গ উঠতেই এসে পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের ভূমিকার কথাও। ১৯৩৭ - ১৯৪৫ সালে শিনো - জাপান যুদ্ধে মারা যায় প্রায় ২,৮৫০,০০০ জন মানুুষ। যার মধ্যে রেড স্টার ওভার চায়নার অগ্রপথিক চেয়ারম্যান মাও জে ডং এর সময়েই মারা যায় ১০,০০০ মানুষ। শুধু কি মাও জে ডং কিংবা চিয়াং কাইশেকই গণহত্যাকারী ছিলেন! ইতিহাস বলে গল্প আছে আরো- সাম্রাজ্যবাদী চায়না অর্থাৎ, ১৯১২ সালের পূর্ব পর্যন্ত (৭৬০- ১৯০০) চায়না কতৃর্ক গণহত্যা হয় ১১ টি। তাতে, মারা যায় আনুমানিক ২,৩১৪,৫৯৬ জন মানুষ। ১৯১২ - ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত গণহত্যা হয় ৫টি। আর তাতে, মারা যায় আনুমানিক  ১,০০৪,০০০ জন মানুষ। ১৯৪৫-১৯৪৯ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ৫০১৯ জন মানুষ এবং ১৯৫৯ সালে তিব্বতে মারা যায় আনুমানিক ৮৭০০০ জন মানুষ। (সূত্রঃ উইকিপিডিয়া ) এত বিপুল পরিমান গণহত্যা করে চায়নিজ ড্রাগনেরা কোন রিপু দমন করতে চায়, তা ভাবার বিষয়। চীনের গণহত্যার কথা মাথায় আসলেই স্বাভাবিকভাবেই আসে উইঘুরিদের কথাও। প্রশ্ন জাগে শিনজিয়াং প্রদেশ নিয়ে। 

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক একটি কমিটি ২০১৮ সালের অগাস্ট মাসে জানতে পারে যে চীন সরকার উইঘুরিদের স্বায়ত্তশাসিত এলাকাকে মূলত একটি বন্দী শিবিরে পরিণত করেছে। সেখানে ১০ লাখের মতো মানুষকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এসব তথ্যের সাথে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অভিযোগের মিল পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, যেসব লোকজনের ২৬টি তথাকথিত 'স্পর্শকাতর দেশের' আত্মীয় স্বজন আছেন তাদেরকে এসব ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান এবং তুরস্কসহ আরো কিছু দেশ। সেখানকার আঞ্চলিক রাজধানী উরুমকিতে ২০০৯ সালের দাঙ্গায় প্রাণ হারিয়েছে কমপক্ষে ২০০ জন। তাদের বেশিরভাগই চীনা হান। ২০১৪ সালে এরকম কিছু হামলায় নিহত হয়েছে ৯৬ জন। জেনেভায় ২০১৮ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের এক অধিবেশনে চীনা কর্মকর্তা বলছেন, ১০ লাখ উইঘুরিকে বন্দী শিবিরে আটকের রাখার খবর 'সম্পূর্ণ মিথ্যা।'

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে ২০১৮ সালের শুরুর দিকে চীন সফরে যাওয়ার আগে শিনজিয়াং প্রদেশে মুসলিমদের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে চীন বিষয়ক কংগ্রেসের একটি কমিটির পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি আহবান জানানো হয়েছে শিনজিয়াং-এ যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্যে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাশেলেটও দাবি করেছিলেন শিনজিয়াং-এর পরিস্থিতি দেখতে পর্যবেক্ষকদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্যে। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখায় বেইজিং সরকার।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন করোনাবাইরাস নিয়ে সতর্কতা জারি করেছিল, তারই মধ্যে চিনের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছিল উইঘুরি মুসলিমদের বন্দি শিবির। উইঘুরি বন্দি শিবিরে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত প্রসঙ্গে সম্প্রতি মার্কিন সংবাদ মাধ্যম এক রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীনের অন্যান্য এলাকার তুলনায় উইঘুরি মুসলিমরা করোনার গ্রাস থেকে অনেকটাই রেহাই পাচ্ছেন। তার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, উইঘুরি মুসলিমরা যেহেতু হালাল খাদ্য খেয়ে থাকেন, সেটা তাদেরকে করোনা ভাইরাস থেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখেছে। যদিও করোনাভাইরাস যেহেতু সংক্রামক, তাই তাতে উইঘুরিরা আক্রমণের শিকার হবেন না এ কথা হলফ করে বলা যাবে না। আশঙ্কা থেকেই যায়। কিন্তু তারা যে এখনো করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত সেকথা স্পষ্ট জানিয়েছে সিএনএন।

এতকিছুর পরও চীনা সরকার বন্ধ করেনি বন্যপ্রাণীর বাজার। ইউ.এন. কনভেনশন অব বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি’র এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি, এলিজাবেথ মারুমা ম্রেমা বিশ্বের দরবারে আর্জি জানিয়েছেন যে, বিভিন্ন দেশে চলা বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত ব্যবসা গুলি বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে। বিশেষত চিনের উহান সিটির মত জায়গা গুলিতে চলে আসা বন্যপ্রাণ এবং বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত ব্যবসা গুলি, যাতে ভবিষ্যতে এই রকমের কোন মহামারী সেখান থেকে ছড়িয়ে না পড়ে।

তথ্য অনুযায়ী চীনে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়া মাত্র এই ধরণের সমস্ত বাজার চীনের সরকার বন্ধ করে দেয়। যদিও সাম্প্রতিক খবর অনুযায়ী, চীন করোনার প্রকোপ সামলে উঠেই, ফের এই বাজারগুলি ব্যবসার জন্যে খুঁজে দিয়েছে। নেকড়ে বাঘের ছানা থেকে শুরু করে পেঙ্গুইন প্রায় সব কিছুরই বিকিকিনি চলেছে খাঁচায় ভরে। এই বাজারের মাধ্যমেই  চীনে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। শুধু তাই নয়, অনেক গবেষকও বার বার চিন সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়েছিলেন এই বাজারগুলি যাতে সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ইসরায়েলের এক প্রযুক্তি কোম্পানির সূত্র অনুযায়ী করোনা সংকটের জের ধরে টুইটারে চীন ও সে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে ‘হেট স্পিচ' প্রায় ৯০০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ সার্বিকভাবে গোটা বিশ্বে চীনা বা পূর্ব এশীয় বংশোদ্ভূত মানুষও এই বিদ্বেষের শিকার। টুইটারে এমন বিদ্বেষ আরও দ্রুত ছড়িয়ে দিতে অনেকে ‘কুংফ্লু', ‘চাইনিজভাইরাস' ইত্যাদি হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে৷ রিপোর্ট অনুযায়ী বিদ্বেষ ছড়ায় এমন ‘হেট সাইট' দেখার হারও প্রায় ২০০ শতাংশ বেড়ে গেছে৷ অস্ট্রেলিয়ার স্কাই নিউজ চ্যানেলের এক ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে, যে চীন ইচ্ছাকৃতভাবে গোটা বিশ্বে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে৷ এমন প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যমের ভিডিও বলে সেই বার্তা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েেই। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটে চীনা অর্থনৈতিক উথানের সুত্র ধরেই।

এবার দেখা যাক, এই চীনা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক আগ্রাসনটা কেমন? 

মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকাসহ বিশ্বের বড় অর্থনৈতিক বাজার এখন চিনের দখলে। বৈদেশিক বিনিয়োগ, অস্ত্র বাণিজ্য সহ আমদানি- রপ্তানি বাণিজ্যের বড় অংশই এখন চীনে হাতে। পুঁজিকে তারা ব্যবহার করেছে এই করোনা সংকট কালীন অস্ত্র হিসেবে। স্বয়ং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চীন থেকে নিয়েছে ট্রিলিয়ন ডলার ঋণ। চীন হয়েছে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ ও দরিদ্র দেশগুলোর বড় অংশীদার, দখল করে নিছে তাদের শেয়ারবাজার ও কর্মসংস্থান বাজারগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে গড়ে তুলেছে নকল করোনা কিটের বাজারও। পাকিস্থান, ভারত, বাংলাদেশে ছড়িয়েছে কে-৯৫ এর নকল মাস্কও! নকল হ্যান্ড গ্ল্যাভসের বাজার নিয়ে প্রশ্নের তাক এখন চীন। ক্রুটিযুক্ত বিমানের যন্ত্রাংশ, কৃত্রিম নকল ডিম, ভেজাল পণ্য, নিম্নমানের চামড়া, টক্সিক ক্যামিকেল, নকল ব্র্যান্ডের মোবাইল, চশমার ফ্রেম, ক্রুটিযুক্ত মেডিক্যাল যন্ত্রাদির বাজার তারা ছড়িয়ে দিয়েছে সারা বিশ্বে। 

চীনের রপ্তানিকৃত ভেজাল কৃষিপণ্য ক্ষতিগ্রস্থ করেছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যকে। বৈধ ও অবৈধ ভাবে আসা স্বল্পমূল্যের এসব পণ্য ধবংস করছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অসাধু সরকারী কর্মকর্তাদের অসাধুতার সুযোগেই করছে এই বাণিজ্য। এক গবেষণায় দেখা গেছে চীনের রপ্তানি করা নকল যন্ত্রাদির ব্যবহারের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিবহন ১-২ বছরের মধ্যেই বিকল হয়ে যায়।

বিশ্বে বায়োলজিক্যাল যুদ্ধের শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। এছাড়া প্রভাবশালী দেশগুলোতে এই অস্ত্র তৈরির ইতিহাসও বেশ পুরনো। এ ধরনের যুদ্ধে অ্যানথ্রাক্স, ব্রুসেলোসিস, কলেরা, নিউমোনিক প্লেগ, টুলারেমিয়া, স্মলক্স, গ্ল্যান্ডার্সের মতো নানা ধরনের প্রাণঘাতী ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে।

ফলে, সন্দেহের তীর তীব্রতা পায় - চীনের করোনা ভাইরাস কি সেই বায়োলজিক্যাল যুদ্ধের রূপ। যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে চীনকে আরো আগ্রাসী করছে? বিশ্বের অর্থনীতিকে ফেলে দিচ্ছে রক্তচোষা, মানুষখেকো ড্রাগনের সামনে?

আগামীনিউজ/মিথুন