স্কুল-কলেজ এখনই খোলা ঠিক নয়

ডেস্ক রিপোর্ট নভেম্বর ১০, ২০২০, ১২:৩১ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর খোলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শ্রেণিকক্ষে পাঠ নেওয়ার অপেক্ষায় আছে কয়েক কোটি শিক্ষার্থী। এদিকে শীত অনুভূত হওয়ার পাশাপাশি চলতি মাসের শুরু থেকেই দেশে বাড়তে শুরু করেছে নভেল করোনাভাইরাস। এ মুহূর্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা কতটা সময়োপযোগী হবে এবং কী করে পাঠদান হবে, সে নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আছে নানামত।

করোনার কারণে ১৪ নভেম্বরের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে খোলা হবে নাকি ছুটি আরো বাড়বে সে সিদ্ধান্ত দু-এক দিনের মধ্যে জানা যাবে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। গতকাল সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান।

তবে গত ২৯ অক্টোবর এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, সীমিত পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চিন্তাভাবনা চলছে। কিন্তু সবকিছু নির্ভর করছে পরিবেশ-পরিস্থিতির ওপর। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে কি না গতকল এমন প্রশ্নের জবাবে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, দেখেন উনারা (শিক্ষা মন্ত্রণালয়) কাল-পরশুই জানাবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিপক্ষে মত দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস এখন বৈশ্বিক সমস্যা। আবার তা বাড়তে শুরু করেছে। এ অবস্থায় আগামী ১২ নভেম্বর আমার এক আত্মীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে আসার টিকিট কেটেও তিনি তা বাতিল করেছেন। করোনার কারণে বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষাও বাতিল করা হয়েছে।

এই শিক্ষাবিদ আরো বলেন, ‘যতই বলা হোক, নতুন স্বাভাবিকতায় আমাদের অভ্যস্ত হতে হবে। আমাদের সন্তানরা ঘরে বন্দি, তা দেখে খারাপ লাগে; কিন্তু হঠাৎ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও সন্তানদের শ্রেণিকক্ষে পাঠাব না। আমাদের উচিত হবে এই অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলা।’

বিশেষ ব্যবস্থা ও বিবেচনাসাপেক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পক্ষে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক আহমেদ। তিনি জানান, সবকিছু যেহেতু খুলে গেছে, তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও খোলা দরকার। এ ক্ষেত্রে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুলে পাইলট প্রোগ্রামের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে খোলার পক্ষে তিনি। এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, প্রথমে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক সুবিধা আছে, সেখান থেকে শুরু করা যেতে পারে। একই কক্ষে গাদাগাদি করে না বসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শিক্ষার্থীদের বসাতে হবে। শিক্ষক স্বল্পতা থাকলে প্রয়োজনে ভলান্টিয়ার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া যেতে হবে। শিক্ষার্থীরা ৪-৫ জন করে এক সঙ্গে চলবে। এ ছাড়া হলেও তারা এক রুমে থাকবেন ও একই টয়লেট ব্যবহার করবেন। তাতে তাদের একজন করোনা আক্রান্ত হলে তার ৫ জনের বেশি সংক্রমিত করবে না। তাদের দ্রুত আইসোলেশনে নেওয়া যাবে।

ডা. মুশতাক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় খুললে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়েই আইসোলেশনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ কার্যক্রম সফল হলে তবেই ক্রমে কলেজ, মাধ্যমিক স্কুল ও পরে প্রাথমিক বিদ্যালয় খুলে দেওয়ার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শ্রেণিকক্ষে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বাতাসে ভাইরাসের ঘনত্ব কমে যায়। এজন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও ভবন প্রকৌশলীদের সঙ্গে আলাপ করার পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞের।

গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এক বিবৃতিতে দেশে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গ টেনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রধান টেড্রুস গ্যাব্রিয়েসুস কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শিশুদের নিরাপদ রাখার দায়িত্ব কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নয়, সরকার বা পরিবারের নয়, এটা আমাদের সবার দায়িত্ব। এখনো ঝুঁকি কেটে যায়নি, বরং মহামারি এখনো প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে। তাই শিশুদের শিক্ষা দিতে হবে কীভাবে তারা নিরাপদ থাকবে, কীভাবে তারা মেনে চলবে স্বাস্থ্যবিধি।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশের মোট শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ে প্রায় পৌনে দুই কোটি ছেলেমেয়ে। আর মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সোয়া কোটির কিছু বেশি। বাকিরা অন্যান্য স্তরে পড়ছেন। এমন অবস্থায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের জিজ্ঞাসা ছিল ছুটি কি আরো বাড়বে, নাকি খুলে দেওয়া হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

এদিকে করোনার বাস্তবতায় দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থীর পড়াশোনা অত্যন্ত ঝুঁকিতে পড়েছে। করোনার কারণে বন্ধ থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট বাড়ছে। বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো পড়ছে আর্থিক সংকটে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে স্কুল পর্যায়ে টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে ক্লাস প্রচার এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন ক্লাসে গুরুত্ব দেওয়া হলেও সেই অর্থে তা কার্যকর হয়নি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সময়ের বিবৃতি ও তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসের ৮ তারিখে প্রথম করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর ১৬ মার্চ সরকার ঘোষণা দেয়, ১৭ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত স্কুল, কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি কমাতে প্রথমবার ২৬ মার্চ থেকে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ওই ছুটির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সাধারণ ছুটি আরো ১ সপ্তাহ বাড়িয়ে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত করা হয়। এরপর ১২ ও ১৩ এপ্রিল সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে ১৪ এপ্রিল বাংলা নববর্ষের নির্বাহী আদেশের ছুটিকেও এর সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এরমধ্যেও করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে ১৫ এপ্রিল থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। ২৪ ও ২৫ এপ্রিল যথাক্রমে শুক্র ও শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় এই দুই দিনকেও সংযুক্ত করা হয় সাধারণ ছুটির সঙ্গে। সে হিসাবে ২৫ এপ্রিল শেষ হতো এ আগের ঘোষিত সাধারণ ছুটির মেয়াদ। পরে ২৩ এপ্রিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আরেক প্রজ্ঞাপনে ৫ মে পর্যন্ত এবং সর্বশেষ ১৬ মে পর্যন্ত এই ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে ইতোমধ্যে রোজা ও ঈদের ছুটি শুরু হয়ে যাওয়ায় আগামী ৩০ মে পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি থাকবে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এদিকে টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির পর ৩১ মে থেকে সীমিত পরিসরে অফিস খুলে যানবাহন চলাচল শুরু হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধই থাকে। ১ জুন স্বাস্থ্যবিধি মানার শর্তে রাজধানীতে গণপরিবহন চালুর অনুমতি দেয় সরকার। পরবর্তী ঘোষণায় ১৫ জুন পর্যন্ত সাধারণ ছুটি চলাকালে সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।

১৫ জুন এক ঘোষণায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি ৬ আগস্ট পর্যন্ত বাড়ান হয়। এই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ২৯ জুলাই আরেক ঘোষণায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি ৩১ আগস্ট পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। তবে ২৭ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। এ সময়ে দেশের সব রকমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। পরে ১ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল খায়ের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ছুটি বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ গত ২৯ অক্টোবর এক ঘোষণায় তা বাড়িয়ে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত করে মন্ত্রণালয়।

এরমধ্যে ৭ অক্টোবর ঘোষণা দেওয়া হয়, এ বছরের উচ্চমাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষাও হচ্ছে না। এরপর মাধ্যমিক স্তরের বার্ষিক পরীক্ষাও না নেওয়ার ঘোষণা আসে। পরীক্ষা ছাড়াই সব শিক্ষার্থী ওপরের ক্লাসে উঠবে। এর আগে করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষা এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা বাতিল করা হয়।

আগামীনিউজ/এএইচ