পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানব ও ধর্ম

নিজস্ব প্রতিবেদক ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১, ০৭:১৪ পিএম
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানবঃ

পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুহাম্মাদ (সা.) । কুরআন এবং মুসলিম উম্মাহই কেবল তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দেয়নি, দিয়েছেন অমুসলিম মনীষীরাও এমনকি অন্যান্য ধর্মগন্থও। ‘মাইকেল হার্ট’ যিনি বিশ্বের সর্বকালের সবচাইতে প্রভাবশালী একশত সেরা মনীষীর জীবনী লিখেছেন, তিনি সেই জীবনী তালিকায় প্রথমেই মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে স্থান দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “মুহাম্মদ (সা.) এর সাফল্যের মধ্যে জাগতিক ও ধর্মীয় উভয় বিধ প্রভাবের এক অতুলনীয় সংমিশ্রণ ঘটেছে। এজন্য সংগতভাবেই তাঁকে ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।” -(দ্যা হ্যান্ড্রেড) 

সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই রবিউল আউয়াল মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা। দুনিয়ায় আসার পুর্বেই পিতা আব্দুল্লাহ মারা যান। আবার ছয় বছর বয়সে মা আমিনাও মারা যান। পিতা-মাতা উভয়কে হারিয়ে মহানবী (সা.) অসহায় ও এতিম হয়ে পড়েন। মায়ের মৃত্যুর পর তিনি দাদা আবদুল মুত্তালিব এর আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন। কিন্তু আট বছর বয়সে দাদাকেও হারান।  এরপর চাচা আবু তালিবের স্নেহে লালিত পালিত হন। বয়স যখন কৈশোরে তখন একটি সত্য ও সুন্দর সমাজ গঠনের লক্ষ্যে শান্তিকামী যুবকদের নিয়ে তিনি গঠন করেন ‘হিলফুল ফুযুল’ অর্থাৎ শান্তিসংঘ। হিলফুল ফুযুলের উদ্দেশ্য ছিল, আর্তমানবতার সেবা করা। অত্যাচারীকে প্রতিরোধ করা। শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা।  তিনি আরব সমাজের সব অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে তাঁর সমবয়সী কিছু যুবককে নিয়ে এ শান্তিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ সংঘের প্রতিটি কর্মসূচি থেকে যুবসমাজের জন্য বহু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।

‘হিলফুল ফুজুল’র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য-

  • মজলুম ও অসহায়দের সাহায্য করা।
  • সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
  • বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী ও প্রীতির সম্পর্ক স্থাপন করা।
  • পথিক ও মুসাফিরের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
  • কোনো জালেমকে মক্কায় প্রবেশ করতে না দেয়া এবং দুষ্কৃতকারীদের অন্যায় আগ্রাসন প্রতিরোধ করা।

ইতিহাস বলে, তৎকালীন আরব সমাজ থেকে অন্যায়, অপরাধ দূরীকরণে এ সংগঠনের অবদান ছিল অসামান্য। শুধু তাই নয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে মৈত্রী ও প্রীতির সম্পর্ক স্থাপনেও এই সংগঠনের ভূমিকা ছিল অনন্য।

যখন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) -এর প্রজ্ঞা ও যোগ্যতার সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে তখন খুওয়াইলিদ কন্যা খাদিজা লোক মারফত মহানবী (সা.)-কে তাঁর ব্যবসায়ে নিযুক্ত করার প্রস্তাব করেন। চাচা আবু তালিবের সাথে আলোচনা করে মহানবী (সা.) তাতে রাজী হলেন। সততা ও চারিত্রিক মাধুর্যতা দেখে মক্কার সম্পদশালী মহিলা খাদিজা (রা:) নিজ ব্যবসার সম্পূর্ণ দায়িত্ব মহানবী (সা.) এর ওপর অর্পন করেন। অতি কম সময়ে খাদিজার ব্যবসা পরিচালনায় মহানবী (সা.) সততার অনন্য নজির স্থাপন করেন। খাদিজা মহানবী (সা.) এর বিশ্বস্ততা ও কর্মদক্ষতায় অভিভূত হন। মুগ্ধ হন। তারপরই খাদিজা নিজেই মহানবী (সা.) এর সঙ্গে বিবাহের প্রস্তাব পাঠান। চাচা আবু তালিবের সম্মতিতে খাদিজার সঙ্গে মহানবী (সা.) এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। এ সময় তাঁর বয়স পচিশ বছর হলেও খাদিজার বয়স ছিল চল্লিশ বছর।

যখন নবুয়ত প্রাপ্তির সময় খুব কাছাকাছি তখন মহানবী হযরত মোহাম্মদ  (সা.) যেন পূর্বাপেক্ষা আরও বেশী নির্জনতাপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এসময় তাঁর বয়স চল্লিশ বছর পূর্ণ হয়ে যায়। হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় একাধারে কয়েকদিন আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকেন। হঠাৎ এক রাতে জিবরাইল (আ:) তাঁর কাছে ওহী (আল্লাহর বাণী) নিয়ে আসেন। জিবরাইল (আ:) কুরআনের আয়াত পাঠ করে শুনালেন- “পড় তোমার প্রভূর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” তখন তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন।

নবুওয়ত পেয়ে মহানবী (সা.) মানুষদের আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার দাওয়াত দেন। এতে মূর্তিপূজারী লোকজন তাঁর দাওয়াতের বিরোধিতা শুরু করে। তাঁর ওপর নানারকম নির্যাতন চালাতে থাকে। তারা মহানবী (সা.)-কে সমাজের নেতা বানানোর প্রলোভন দেখায়। ধন-সম্পদের লোভ দেখায়। মহানবী (সা.) তাদের বলেন, “আমার এক হাতে সূর্য ও অন্য হাতে চাঁদ এনে দিলেও আমি ইসলাম প্রচার থেকে বিরত হবো না।” মহানবী (সা.) এর ওপর মক্কার কাফেররা ভীষণ ক্ষেপে ওঠে। অত্যাচার শুরু করে। তাঁর সাথে করে দুর্ব্যবহার। তাদের দুর্ব্যবহারে মহানবী (সা.) অনেক কষ্ট পান। একসময় জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে তিনি মদীনায় চলে যান। মদীনাকে ইসলাম প্রচারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। তিনি সেখানে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদিসহ সব স¤প্রদায়ের লোকের পরস্পরের মধ্যে শান্তি, সম্প্রীতি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য ‘মদীনা সনদ’ সম্পাদন করেন। এ মদীনা সনদই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত চুক্তি বা সংবিধান। এ সনদের ফলে মুসলমান আর অমুসলমানদের মধ্যে এক অপূর্ব সম্প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠে। মানুষের জানমালের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয়। নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।

মদিনা সনদে সর্বমোট ৬১টি ধারা-উপধারা রয়েছে।  এর উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো ছিল এ রকম: 

কুরাইশ ও ইয়াসরিবের (মদিনা) মুমিন মুসলিমরা ও যারা তাদের অনুগামী হয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং তাদের সঙ্গে মিলে দেশের প্রতিরক্ষা করবে, তাদের মধ্যে তারা অভিন্ন একটি জাতি বলে পরিগণিত হবে। কুরাইশদের মধ্য থেকে যারা মুহাজির, তারা তাদের পূর্বাবস্থায় বহাল থাকবে; তারা মুমিনদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করবে। বনু আওফ, বনু হারেস (বনু খাযরাজ), বনু সায়েদাহ, বনু জুশাম, বনু নাজ্জার, বনু আমর ইবন আওফ, বনু নাবিত, বনু আওস—সবাই তাদের মধ্যে বিদ্যমান পূর্ব দায় আদায় করবে এবং সব সম্প্রদায় নিজ নিজ পণ স্বেচ্ছায় প্রদান করবে এবং মুমিনদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ করবে। মুমিনরা তাদের কাউকে দায়গ্রস্ত ফেলে রাখবে না, বরং তাদের মুক্তিপণ বা রক্তপণ স্বেচ্ছাদানে আদায় করে দেবে। কোনো মুমিন অন্য মুমিনের অনুমতি ছাড়া তার বন্ধুর সঙ্গে মিত্রতা করবে না। মুমিন মুত্তাকিদের কারও ওপর কোনো সন্ত্রাসী হামলা হলে অথবা জুলুমের থাবা বিস্তার করতে চাইলে অথবা কোনো অন্যায় বা সীমা লঙ্ঘন করতে চাইলে অথবা মুমিনদের মধ্যে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চাইলে সবাই সম্মিলিতভাবে তার প্রতিকার করবে, যদি সে তাদের কারও সন্তানও হয়। কোনো মুমিন কারও পক্ষ নিয়ে অন্য কাউকে হত্যা করবে না এবং কোনো মুমিনের বিপক্ষে কাউকে সাহায্য করবে না। আল্লাহর নিরাপত্তা জিম্মাদারি সবার জন্য একই সমান, একজন সাধারণ লোকও যে কাউকে নিরাপত্তা আশ্রয় দিতে পারবে। মুমিনরা স্বতন্ত্রভাবে পরস্পরের মিত্র। তবে ইহুদিদের মধ্যে যারা এই চুক্তির অনুগামী হবে, তাদের জন্য সাহায্য ও মর্যাদার অধিকার থাকবে। যুদ্ধ অবস্থায় ইহুদিরাও মুমিনদের সঙ্গে ব্যয়ভার বহন করবে। তাদের প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না এবং তাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করা হবে না। মুমিনদের প্রদত্ত শান্তি ও নিরাপত্তা হবে অভিন্ন, আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধের সময় এক মুমিনকে ছেড়ে অন্য মুমিন নিরাপত্তা চুক্তি করতে পারবে না, বরং পারস্পরিক সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক চুক্তিই গৃহীত হবে। রক্তপাতের আশঙ্কা দেখা দিলে মুমিনরা একে অন্যের পক্ষে তা প্রতিহত করবে। নিশ্চয়ই ধর্মনিষ্ঠ মুমিনরা উত্তম ও সুষ্ঠুতম হিদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কোনো মুমিন, যে এই চুক্তিপত্রে বিদ্যমান বিষয় স্বীকার করে নিয়েছে এবং আল্লাহ ও আখিরাতে ইমান এনেছে, তার জন্য কোনো চুক্তি ভঙ্গকারীকে সাহায্য করা বা আশ্রয় দেওয়া বৈধ নয়। যে এমন কাউকে সাহায্য করবে অথবা আশ্রয় দেবে, তার ওপর রোজ কিয়ামতে আল্লাহর লানত ও ক্রোধ নিপতিত হবে। সেদিন তার কাছ থেকে টাকাপয়সা গ্রহণ করা হবে না।

বনু আওফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই জাতি হিসেবে গণ্য হবে: ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম। বনু নাজ্জার, বনু হারেস, বনু সায়েদাহ, বনু জুশাম, বনু আওস, বনু সালাবাহ—সব গোত্রের ইহুদিরা বনু আওফের অনুরূপ অধিকার পাবে। তারা এবং তাদের মিত্ররা অভিন্ন অবস্থানে থাকবে। তবে যে জুলুম করবে এবং অপরাধে লিপ্ত হবে, সে বস্তুত নিজেকে ও নিজ পরিজনকেই ধ্বংস করবে। বনু সালাবাহ গোত্রের উপগোত্র জুফনা সালাবাহের মতোই গণ্য হবে। বনু শুতাইবাহের জন্য আওফের অনুরূপ অধিকার থাকবে। অবশ্যই অঙ্গীকার পূর্ণ করতে হবে, তা ভঙ্গ করা যাবে না; এবং সালাবাহ গোত্রের মিত্ররা তাদেরই মতো। নিশ্চয়ই ইহুদিদের আন্তরিক মিত্ররা তাদেরই মতো গণ্য হবে। অধিকারবঞ্চিত ব্যক্তিকে প্রাপ্য গ্রহণে বাধা দেওয়া যাবে না। যে ব্যক্তি কোনো অপরাধ সংঘটন করবে, সে ও সেই-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার জন্য দায়ী হবে। তবে যদি কেউ মজলুম হয়, তাহলে সে নিজের প্রতিরক্ষা করতে পারবে। এই চুক্তিপত্রের পক্ষগুলোর বিরুদ্ধে কেউ লড়াই করলে পক্ষগুলোর পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে তা প্রতিহত করবে। এবং পক্ষগুলোর নিজেদের মধ্যে পরামর্শ ও কল্যাণকামিতা বজায় রাখবে। প্রতিশ্রুতি পূরণ করবে, তা ভঙ্গ করবে না। কোনো ব্যক্তি তার মিত্রের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবে না এবং মজলুমকে সবাই সাহায্য করবে। যুদ্ধ অবস্থায় ইহুদিরাও মুমিনদের সঙ্গে ব্যয়ভার বহন করবে। ইহুদিদের ব্যয়ভার তারা বহন করবে এবং মুসলিমরা তাদের ব্যয়ভার বহন করবে। এই চুক্তির পক্ষগুলোর জন্য ইয়াসরিব (মদিনা) একটি সংরক্ষিত ও পবিত্র নগরী হিসেবে বিবেচিত হবে। প্রতিবেশীকে নিজের মতোই গণ্য করতে হবে। তার কোনো ÿক্ষতি বা তার প্রতি কোনো অপরাধ সংঘটন করা যাবে না। কোনো নারীকে তার পরিবারের অনুমতি ছাড়া আশ্রয় দেওয়া যাবে না। (মদিনার প্রতিপক্ষ মক্কার) কুরাইশ ও তাদের সাহায্যকারীদের কোনো আশ্রয় দেওয়া যাবে না। ইয়াসরিবকে (মদিনা) কেউ আক্রমণ করলে চুক্তির সব পক্ষ পারস্পরিক সাহায্যের মাধ্যমে তা প্রতিহত করবে। যখন তাদের সঙ্গে ইহুদিদের কোনো সন্ধি করতে এবং সংশ্লিষ্ট হতে আহ্বান করা হবে, তারা সেই সন্ধি করবে এবং দায়ভার গ্রহণ করবে। যদি তারা অনুরূপ সন্ধির পক্ষে যায়, তখন মুমিনের ওপরও তাদের দাবি আছে। তবে যদি ইহুদিরা ধর্মকে আঘাতকারী কারও সঙ্গে সন্ধি করতে চায়, তা মুমিনরা মেনে নেবে না। আওস গোত্রীয় ইহুদি তাদের মিত্ররা এবং তাদের নিজেদের এই চুক্তিপত্রের পক্ষগুলোর অনুরূপ গণ্য করা হবে। এই চুক্তিপত্রের পক্ষগুলো থেকে তারা বিশ্বস্ত ও কল্যাণকামী আচরণ পাবে। নিশ্চয়ই অঙ্গীকার রক্ষা করতে হবে, ভঙ্গ করা যাবে না। কেউ কোনো বিরূপ কর্মতৎপরতায় জড়িত হলে তা তার ওপরই বর্তাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ এই চুক্তিপত্রের বিষয়াদির সত্যনিষ্ঠ বাস্তবায়ন ও প্রতিশ্রুতির প্রতিপালনকারীদের সঙ্গে আছেন। এই সনদ কোনো জালেম বা অপরাধীকে রক্ষা করবে না। মদিনা থেকে যে বাইরে যাবে, সে নিরাপদ এবং যে এর অভ্যন্তরে অবস্থান করবে, সে–ও নিরাপদ। তবে যে জুলুম করবে এবং অপরাধ করবে, সে নয়। যে ব্যক্তি এই চুক্তির প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে, আল্লাহ তার সাহায্য করবেন। এই চুক্তিপত্রের উত্তম হেফাজতকারী ও প্রতিশ্রুতি রক্ষাকারীর ওপর আল্লাহ (সাক্ষী) আছেন। চুক্তিবদ্ধ পক্ষগুলোর কেউ হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর অনুমোদন ছাড়া যুদ্ধের উদ্দেশ্যে বের হতে পারবে না। কোনো বিষয়ে যখনই মতানৈক্য হবে, তখন তা আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর সমীপে সোপর্দ করতে হবে। শান্তির জন্য চাই সত্যনিষ্ঠা ও সংযম। তাই মদিনা সনদের সর্বশেষে লেখা হয়: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও হজরত মুহাম্মদ (সা.) সে ব্যক্তির সাহায্যকারী, যে সত্যনিষ্ঠ ও সংযত।’ (সীরাতুন নবী, ইবনে হিশাম)। প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ না করে সন্ধিতে আবদ্ধ হওয়া মহানবী (সা.)–এর শান্তিকামিতার একটি উৎকৃষ্ট প্রমাণ। তিনি শান্তি স্থাপনের জন্য হুদাইবিয়ার সন্ধি ছাড়াও আরও বহু সন্ধিতে আবদ্ধ হয়েছেন। বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) সারা জীবন এই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর কাজের মূলনীতিসমূহের প্রথম মূলনীতি ছিল সব ধরনের অশান্তি ও অরাজকতা দূর করা।

মদীনায় যাওয়ার আট বছর পর অর্থাৎ অষ্টম হিজরির (মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার পর) রামাদ্বান মাসে দশ হাজার সাহাবী (অনুসারী বা সঙ্গী) নিয়ে মহানবী (সা.) আবার নিজের জন্মভূমি মক্কায় ফিরে আসেন। মহানবী (সা.) এর বিশাল সৈন্যবাহিনী দেখে মক্কার অমুসলিমরা ভীষণ ভয় পায়। প্রতিরোধ করার সাহস তারা হারিয়ে ফেলে। মহানবী (সা.)-কে যারা তিলে তিলে কষ্ট দিয়েছে, জানে মেরে ফেলতে চেয়েছে, প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে এবং স্বদেশ ত্যাগ করার পরও স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। মক্কা বিজয়ের দিন ইচ্ছা করলে মহানবী (সা.) প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। ভীতসন্ত্রস্ত কোরায়েশদের লক্ষ্য করে তিনি বলেন, “তোমরা সকলেই মুক্ত। আজ তোমাদের প্রতি কোন কঠোরতা নেই। নেই কোন প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধ স্পৃহা। তোমাদের সকলকে ক্ষমা করে দিলাম। মহানবী সা. এর অনুপম আচরণ ও দুর্ধর্ষ আরব কোরায়েশদের পাষাণ হৃদয় মুহুর্তে দ্রবীভূত হয়ে যায়। চারিদিকে আকাশে বাতাশে ধ্বনিত হয় “মারহাবা ইয়া রাসূলুল্লাহ- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।”

ইসলামের বিজয়, বিস্তার এবং সমগ্র আরবের একত্রিকরণে মক্কা বিজয়ের প্রয়োজনীয়তা ছিলো অপরিহার্য। জয়ের সমস্ত ইতিহাসে মক্কা বিজয় ছিলো অতুলনীয়। মক্কা বিজয় ছিলো রক্তপাতহীন এক মহা বিজয়। এ বিজয়ে কোন হানাহানি, ধ্বংস বা বিভীষিকা নয়, এ বিজয় ছিলো প্রেম, ক্ষমা, মহত্ত ও পুণ্যের। মক্কা বিজয়ের পর ইসলামের কাজ দ্রুত প্রসার লাভ করে। মহানবী (সা.) এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন গোত্র থেকে দলে দলে মানুষ ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে।

এককথায়, মহানবী (সা.) এর সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক জীবন ছিলো একেবারে স্বচ্ছ, ঝকঝকে তকতকে অনাবিল। তাঁর স্ত্রীরা সবাই তাঁর স্বচ্ছতার সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। পরিবারের গোলাম ও সেবকসহ সকলেই তাঁর অনাবিল সুন্দর চরিত্র, মধুর ব্যবহার এবং দয়া ও সহানুভূতির দ্বারা পরম মুগ্ধ ছিলেন। আট বছর বয়স থেকে প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আনাস (রা:) তাঁর সেবক হিসেবে ছিলেন। তিনি দশ বছর মহানবী (সা.) এর সেবা করেন। তিনি বলেন, মহানবী (সা.) কখনো আমাকে ধমক দেননি। কখনো বলেননি এমনটি করলে কেন? অমনটি করলে না কেন? তিনি কখনো কাউকে মারেননি। নির্যাতন করেননি। তাড়িয়ে দেননি। অপমান করেননি। অনাদর করেননি। কারো সাথে রুঢ় আচরণ করেননি। অমায়িক ব্যবহারে ঘর এবং বাহিরের সবাই ছিলো তাঁর প্রতি চুম্বকের মতো আকৃষ্ট ও মুগ্ধ।

হযরত আনাস (রা:) আরো বলেন, মহানবী (সা.) কখনো কাউকেও অশ্লীল-অশালীন কথা বলতেন না। অভিশাপ দিতেন না এবং গালাগাল করতেন না। কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হলে শুধু এতটুকু বলতেন: তার কি হলো, তার কপাল ধুলোমলিন হোক! -(সহীহ বুখারী)

মহানবী (সা.) নারী, পুরুষ ও শিশুসহ যার সাথেই দেখা হতো, তাকেই তিনি সালাম দিতেন। নিজেই আগে সালাম দেয়ার চেষ্টা করতেন। কেউ তাঁকে আগে সালাম দিয়ে দিলে উত্তমভাবে তার জবাব দিতেন। হযরত আনাস (রা:) বলেন, মহানবী (সা.) ছিলেন সবচেয়ে ভদ্র কোমল ও অমায়িক মানুষ। তিনি সবার সাথে মিলেমিশে থাকতেন। সবার সাংসারিক খোঁজ খবর নিতেন। শিশু কিশোরদের সাথে হাস্যরস করতেন। শিশুদের আদর করে কোলে তুলে বসাতেন। ছোটবড় সকলের দাওয়াত তিনি কবুল করতেন। দূরে হলেও রুগ্ন ব্যক্তির খোঁজ খবর নিতেন। তিনি মানুষের ওযর কবুল করতেন। -(মিশকাত)

মহানবী (সা.) বাজে এবং অনর্থক কথা বলতেন না। প্রয়োজনীয় কথা বলতেন। অর্থবহ কথা বলতেন এবং কম কথা বলতেন। দীর্ঘ সময় কথা না বলে নীরব থাকতেন। জাবির ইবনে সামুরা (রা:) বলেছেন, মহানবী মুহাম্মাদ (স:) দীর্ঘ সময় ধরে নীরব থাকতেন। -(মিশকাত)

‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’

ইসলামের ইতিহাসে তথা বিশ্বের ইতিহাসে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ এক যুগান্তকারী ঘটনা। বিশ্বের ইতিহাসে এ সন্ধি এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। এ সন্ধিতে সাক্ষর করে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এক অসাধারণ রাজনৈতিক প্রতিভা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেন। তাই ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ মহানবী (সাঃ) এর জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।

মহানবী (সা.)কে অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে কুরাইশরা এক পর্যায়ে তাঁকে মদিনায় হিজরতে বাধ্য করেছিল। হিজরতের পরেও মহানবী (সা.) ও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য তারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। বদর, ওহুদ, খন্দকের মতো যুদ্ধ মহানবী (সা.) ও ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করার অভিপ্রায়েই কুরাইশরা সংঘটিত করেছিল। আর এ উদ্দেশ্যে ইহুদি-খ্রিস্টানদের সহযোগিতা পেয়েও মুসলমানদের অগ্রযাত্রাকে রুখতে পরেনি। এক সময় তাদের সাথেই হুদায়বিয়ার সন্ধিতে বসতে হয়েছে। আর সন্ধির সুযোগে মহানবী (সা.) দেশে-বিদেশে ইসলামের আহ্বান পৌঁছিয়ে ইসলামের দ্রুত বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হন।

হুদায়বিয়ার সন্ধির পটভূমি :

দীর্ঘদিন মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে এসে মহানবী (সা.)-এর প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। কাবা শরীফ জিয়ারত করবার মহান আল্লাহ তায়ালার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পেয়ে মহানবী (সা.) ৬ষ্ঠ হিজরীতে জিলকদ মাসে পবিত্র উমরাহ পালনের সিদ্ধান্ত নেন। এ উদ্দেশ্যে মহানবী (সা.) তাঁর চৌদ্দশত সাহাবীসহ শান্তিপূর্ণভাবে উমরাহ সম্পন্ন করার জন্য মদিনা থেকে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। মুসলমানদের বিরুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের শত্রুতা তখনো শেষ হয়নি। তারা মুসলমানদের প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে রইল। খুযায়া গোত্রের সর্দার বুদাইলের মাধ্যমে কুরাইশদের এই মনোভাবের কথা মহানবী (সা.) জানতে পারলেন। মহানবী (সা.) বুদাইলের মাধ্যমে কুরাইশদের এই মর্মে সংবাদ দিলেন যে, মুসলমানরা কোনো যুদ্ধের জন্য নয়, বরং শান্তিপূর্ণভাবে কাবা শরীফে উমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। কিন্তু মুসলমানদের বাধা দেবার জন্য কুরাইশরা ছিল সংকল্পবদ্ধ। মহানবী (সা.) হুদায়বিয়া নামক স্থানে যাত্রাবিরতি করে তাঁর পাঠানো সংবাদের উত্তর জানার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। কুরাইশদের মধ্যে কিছু বিজ্ঞ ব্যক্তি মহানবী (সা.)-এর শান্তিপূর্ণ প্রস্তাব গ্রহণ করতে চাইল। তারা জানতো যে, মুহম্মদ (সা.)কে যদি উমরাহ পালন করতে দেয়া না হয় তাহলে এর ফলে যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। তাছাড়া মহানবী (সা.) এর সাথে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে মক্কার কুরাইশরা সিরিয়ার সাথে তাদের বাণিজ্য সম্পর্ক পুনঃচালু করতে পারবে। কারণ মদিনার উপর দিয়ে যাওয়া এই বাণিজ্য পথটি মুসলমানদের দখলে রয়েছে। অতএব, কুরাইশরা তাদের মুখপাত্র হিসেবে উরওয়া ইবনে মাসউদকে মহানবী (সা.) এর নিকট এই সন্ধিচুক্তির শর্ত নির্ধারণের জন্য প্রেরণ করলেন। উরওয়া মহানবী (সা.) এর নিকট আসলো। কিন্তু উভয় পক্ষের আলোচনাকালে মহানবী (সা.)-এর অনুসারীদের সম্পর্কে তার অপ্রীতিকর ও শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে চুক্তি সম্পন্ন সফল হননি। তবে উরওয়া মহানবী (সা.) এর উপর সাহাবীদের প্রগাঢ় ভক্তি, ভালোবাসা ও আস্থা লক্ষ্য করে এবং মক্কায় ফিরে গিয়ে কুরাইশদের তা অবহিত করে। মহানবী (সা.) দ্বিতীয়বার কুরাইশদের নিকট খিরাস ইবনে উমাইয়া নামক একজন দূতকে প্রেরণ করলেন, কিন্তু কুরাইশরা তার সাথে দুর্ব্যবহার করে এবং তার উটের পায়ের রগ কেটে দেয়। কুরাইশরা মহানবী (সা.) ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে খুবই শত্রুতামূলক আচরণ করে। তারা মুসলমানদের হত্যা করার জন্য একটি ক্ষুদ্র দলকেও পাঠায়। কুরাইশদের এ সমস্ত লোক আক্রমণ করতে এসে নিজেরাই মুসলমানদের হাতে বন্দী হয়। কিন্তু মহানবী (সা.) তাদের সবাইকে  ক্ষমা করে দেন এবং মক্কার পবিত্র কাবা ঘরের আওতার মধ্যে রক্তপাত করতে নিষেধ করেন। অতপর মহানবী (সা.) হজরত ওসমান (রা.)কে শান্তির জন্য কুরাইশদের নিকট প্রেরণ করেন। হজরত ওসমান (রা.) মক্কায় পৌঁছলে কুরাইশরা তাঁকে বন্দী করে। মুসলিম শিবিরে এরূপ গুজব রটে যে, কুরাইশরা হজরত ওসমান (রা.)কে হত্যা করেছে। মহানবী (সা.) এই খবরে খুবই মর্মাহত হলেন। পবিত্র কাবা শরীফের এলাকার মধ্যে পবিত্র মাসে কোনো আরব গোত্র প্রধানকে হত্যা করা ইসলামপূর্ব আমলেও আরবদের জন্য জঘন্য অপরাধ বলে বিবেচিত হতো।

মহানবী (সা.) তাঁর সাহাবীদের ডেকে নতুন করে শপথ নেয়ার জন্য বললেন যে, তাদের ধর্ম ও ঈমানের জন্য শেষ পর্যন্ত তাঁরা যুদ্ধ করবে। একটি গাছের নিচে এই শপথ নেয় হয়। ইতিহাসে এই শপথকে ‘বাইয়াতুর রিদওয়ান’ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘মু’মিনরা যখন বৃক্ষতলে তোমার নিকট বাইয়াত গ্রহণ করলো তখন আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হলেন। তাদের অন্তরে যা ছিল, তা তিনি অবগত ছিলেন। তাদেরকে তিনি দান করলেন প্রশান্তি এবং তাদেরকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয়।’

সকল সাহাবীর শপথ গ্রহণ শেষ হলে রাসূল (সা.) তাঁর ডান হাত বাম হাতের উপর দিয়ে হজরত ওসমানের প্রতিশোধ গ্রহণ কল্পে নিজে শপথ নিলেন। পরে অবশ্য হজরত ওসমান (রা.) নিরাপদে মুসলিম শিবিরে ফিরে আসেন।

কুরাইশরা বুঝতে পারলো যে, এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বিস্ময়করভাবে একান্ত অনুগত ভক্ত সমন্বয়ে গঠিত এই দলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা সফলকাম হতে পারবে না। তাদের অবিস্মরণীয় অতীত ও শোচনীয় পরাজয়ের স্মৃতি তখনো তাদের মনে স্পষ্ট হয়ে আছে। তাই তারা সুহাইল ইবনে আমরকে মুসলমানদের নিকট সন্ধি করার জন্য দূত করে পাঠালো। তার সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উভয় পক্ষে একটি যুদ্ধ বিরতিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়। ইতিহাসে এটিই ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’ নামে খ্যাত।
কি আছে ‘হুদায়বিয়ার সন্ধি’তে :

হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপ :

  • এ বছর পবিত্র কাবায় ওমরা পালন না করেই মুসলমানগণ মদিনায় ফিরে যাবে।
  •  মুসলমানরা পরের বছর উমরা করতে পারবে। কিন্তু তিনদিনের বেশি মক্কায় অবস্থান করতে পারবে না।
  • অস্ত্রশস্ত্র ছাড়াই তারা পরবর্তী বছর পবিত্র নগরীতে আসবে। এ সময় কেবলমাত্র কোষবদ্ধ তরবারী  সঙ্গে আনা যাবে।
  • মক্কায় বসবাসরত কোনো মুসলমানদের তারা সাথে করে মদিনায় নিয়ে যেতে পারবে না, আবার   কোনো মুসলমান যদি মক্কায় যেতে চায় তাকেও তারা বাধা দিতে পারবে না।
  • যদি কোনো মক্কাবাসী মদিনায় চলে যায় তবে তাদেরকে হস্তান্তর করতে হবে, আর যদি কোনো মুসলমান মক্কায় আসে তবে মক্কাবাসীরা তাকে হস্তান্তর করবে না।
  • আরবের অন্যান্য গোত্র স্বাধীনভাবে যে কোনো পক্ষের মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবে।
  • এই চুক্তির মেয়াদ হবে দশ বছর।

যদিও সাধারণভাবে মুসলমানগণ শর্তাবলীতে খুশি হতে পারেনি। চুক্তির শর্তগুলো ছিল বড় বেশি একতরফা। সন্ধিচুক্তির শর্তাবলী নিয়ে আলাপ-আলোচনাকালে কুরাইশদের একগুঁয়ে আচরণ মুসলমানদেরকে ভেতরে ভেতরে ক্রোধান্বিত করে তোলে, কিন্তু মহানবী (সা.) এর মনঃতুষ্টির জন্য তারা শান্ত থাকে।

ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’:

ইসলামের ইতিহাসে ‘হুদাইবিয়ার সন্ধি’ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ষষ্ঠ হিজরিতে মুসলমানরা হজ করতে গেলে মক্কার কোরাইশরা তাতে বাধা দেয়। এ অবস্থায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয় মুসলমানরা। এ পরিস্থিতিতে কোরাইশরা সন্ধি করতে প্রস্তুত হলো এবং এ সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য সুহাইল বিন আমরকে দূত বানিয়ে পাঠাল। তার সঙ্গে দীর্ঘ সময়ব্যাপী আলোচনা হলো এবং শেষ পর্যন্ত সন্ধির শর্তাবলি স্থিরিকৃত হলো। সন্ধিপত্র লেখার জন্য হজরত আলী (রা)-কে ডাকা হলো। সন্ধিপত্রে যখন লেখা হলো ‘এই সন্ধি আল্লাহর রসুল মুহাম্মদ (সা.)-এর তরফ থেকে তখন কোরাইশ প্রতিনিধি সুহাইল প্রতিবাদ জানিয়ে বলল : ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি লেখা যাবে না; এ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে।’ এ কথায় সাহাবিদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। সন্ধিপত্র লেখক হজরত আলী (রা.) কিছুতেই এটা মানতে রাজি হলেন না। কিন্তু হজরত (সা.) নানাদিক বিবেচনা করে সুহাইলের দাবি মেনে নিলেন এবং নিজের পবিত্র হাতে ‘আল্লাহর রসুল’ কথাটি কেটে দিয়ে বললেন : ‘তোমরা না মানো, তাতে কি? কিন্তু খোদার কসম, আমি তাঁর রসুল।’

রাসূল (সা.) এর রিসালাত ও বিশাল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে হুদায়বিয়ার সন্ধি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এটা ছিল মক্কার নেতৃস্থানীয় কাফিরগণ কর্তৃক মদিনায় প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং মহানবী (সা.) এর নেতৃত্বের স্বীকৃতির দৃষ্টান্ত। এতকাল যারা ছিল প্রাণের শত্রু, আজ তারই সন্ধির মাধ্যমে ভবিষ্যতে দশ বছর যুদ্ধ বিগ্রহ না করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। এই চুক্তির মাধ্যমেই মুসলিম উম্মাহর জন্য আল্লাহর ঘর কাবা ঘর জিয়ারত করার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই চুক্তির ফলেই মহানবী (সা.) ইসলামের আহ্বান দিকে দিকে ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ পান। এই সন্ধির পরেই খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস ও উসমান বিন তালহাসহ বড় বড় যোদ্ধা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। এই মহান চুক্তির ধারাগুলো আপাত দৃষ্টিতে মুসলমানদের জন্য অসম্মাজনক মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এর ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী। অল্প সময়ের মধ্যে মদিনার বাইরের বিভিন্ন গোত্রর বহুসংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এই সন্ধির একটি শর্ত অনুযায়ী মক্কা হতে প্রত্যাগত নবদীক্ষিত মুসলমানদের মহানবী (সা.) মক্কায় পাঠিয়ে দিতেন, আবু জান্দাল যার জ্বলন্ত প্রমাণ। পরবর্তীতে এই রকম নবদীক্ষিত মুসলমানদের সংখ্যা বেড়ে গেলে তাঁরা সন্ধিশর্ত বজায় রেখে মদিনা না গিয়ে সমুদ্র তীরবর্তী ‘ইস’ নামক এক জঙ্গলে বসবাস করতে শুরু করেন। সিরিয়া হতে প্রত্যাগত মক্কার ব্যবসায়ীদের সেই পথ দিয়ে আসতে হতো, ফলে তারা এই সমস্ত নবদীক্ষিত মুসলমানদের হুমকিস্বরূপ মনে করে নিজেরাই শর্তটি সংশোধনের অনুরোধ জানায়। ফলে এই সমস্ত মক্কার নবদীক্ষিত মুসলমানরা মদিনায় মহানবী (সা.) এর সাথে মিলিত হবার সুযোগ পান। এইভাবে দেখা গেল, শর্ত যেমনই হোক না কেন, এর সুফলগুলো ছিল মুসলমানদের পক্ষে।

ইসলামের বিজয়:
হুদায়বিয়ার সন্ধি ইসলামের জন্য একটি সুমহান বিজয়। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচালক মহানবী (সা.) এর এ হুদায়বিয়া সন্ধি স্বাক্ষরের মাধ্যমেই মূলত মক্কা বিজয়ের পথ পরিষ্কার হয়ে যায়।

‘হুদায়বিয়ার চুক্তি’র ফলেই মুসলিম মিল্লাত আরব বিশ্বে একটি শক্তিধর জাতির সম্মান লাভ করে। আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল করীমে হুদায়বিয়ার সন্ধিকে তাই ‘ফাতহুম মুবীন’ বা সুস্পষ্ট বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই মহান সন্ধির ধারাবাহিকতায় ইসলামের উত্তরোত্তর প্রসার এবং সর্বোপরি ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। যা বিশ্বজয়েরও সূচনা করে।

হুদায়বিয়ার সন্ধি দুই বছর স্থায়ী হয়। এই দুই বছরে ইসলাম অনেকটাই শক্তিশালী হয়। সন্ধি কার্যকর হওয়ার পর খুযায়া গোত্র মুসলমানদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। পক্ষান্তরে মুসলমানদের শত্রু বনু বকর কুরাইশদের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মুসলমানদের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় কুরাইশদের অন্তর্জ্বালা যেমন বাড়তে থাকে, তেমনি তাদের মধ্যে জন্ম নিতে থাকে এক প্রচণ্ড ক্রোধের। খুযায়া গোত্র মহানবীর (সা.) সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় কুরাইশরা তাদের মিত্র বনু বকরকে খুযায়া গোত্র আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকে। এই গুপ্ত চক্রান্তের ফলে বনু খুযায়াবাসী যখন ‘ওয়াতির’ নামক জলাশয়ের নিকট এক রাত্রে নিদ্রামগ্ন ছিল, তখন অতর্কিতভাবে বনু বকর তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে বনু খুযায়ার অনেক লোককে হত্যা ও তাদের ধন-সম্পদ লুট কর নিয়ে যায়। কুরাইশরা এই আক্রমণে তাদের প্রকাশ্যে সাহায্য করে। বনু খুযায়া গোত্র এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে কুরাইশদের নিকট  অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে তারা মহানবী (সা.) এর নিকট তাদেরকে রক্ষা করার জন্য একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করে। মহানবী (সা.) সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করে কুরাইশদের তিনটি শর্ত দিয়ে এর যে কোনো একটি বেছে নেয়ার জন্য বার্তা প্রেরণ করেন :

) খুযায়া গোত্রের যেসব লোককে হত্যা করা হয়েছে, কুরাইশদের তার রক্তপণ প্রদান করতে হবে, অথবা
২)
 বনু বকরের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে, অথবা
৩) কুরাইশদেরকে হুদাইবিয়া সন্ধি বাতিল বলে ঘোষণা করতে হবে।

কুরাইশ পক্ষ প্রথম দু’টি শর্ত মেনে নিতে অস্বীকার করে কুরত ইবন উমারের মাধ্যমে মহানবীর (সা.) নিকট সংবাদ পাঠায় এবং এই সংবাদে তারা জানিয়ে দেয় যে, তারা তৃতীয় শর্তটি গ্রহণ করেছে। কুরাইশদের পক্ষে এটা ছিল একটি অবিবেচনাপ্রসূত পদক্ষেপ। হুদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তি বিলুপ্তির অনিবার্য ভয়াবহ পরিণতি উপলব্ধি করতে পেরে পরবর্তীতে আবু সুফিয়ান চুক্তিটি নবায়নের উদ্দেশ্যে নিজেই মদিনায় মহানবী (সা.) এর সাথে সাক্ষাতের জন্য গমন করেন। কিন্তু তার প্রস্তাবের পাশাপাশি মুসলমানদের দাবির প্রতি তিনি কর্ণপাত করেননি। এটি ছিল নিতান্তই অযৌক্তিক। ফলে মহানবী (সা.) তার চুক্তি নবায়নের প্রস্তাবে সম্মত হননি।

মহানবী (সা.) আল্লাহকে ভয় করতেন। নামাযে কাদতেঁন। তাঁর কান্নার শব্দ অন্যরা শুনতে পেতো। কুরআন পড়া শুনলে তাঁর হৃদয় মোমের মতো গলে যেতো। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো।

বিদায় হজ্ব

মহানবী (সা.) দশম হিজরীতে হজ্জ্ব পালন করেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ্জ্ব। শেষ হজ্জ্ব ইসলামের ইতিহাসে হুজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজ্জ্ব নামে অভিহিত। বিদায় হজ্জ্বে উপস্থিত লক্ষাধিক অনুসারীদের উদ্দেশ্য করে মহানবী (সা.) এক মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। এর পর আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয় কুরআনুল কারীমের শেষ বাণী।

মহানবী (সা.) তাঁর ভাষণের প্রারম্ভে মহান আল্লাহর হামদ ও প্রশংসা জ্ঞাপন করার পর বলেন: হে লোক সকল! আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদিগকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পরে পরিচিত হতে পারো। নিশ্চয় আল্লাহর কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত, যে সর্বাধিক পরহেজগার।’ (আল-কোরআন, পারা: ২৬, সূরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১৩। সুতরাং কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের, এমনিভাবে শ্বেতাঙ্গের ওপর কৃষ্ণাঙ্গের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই।  সব মানুষ আদম (আ.)-এর সন্তান; আর আদম (আ.) মাটি দ্বারা সৃষ্ট। হে সভ্যমণ্ডলী! এক মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই, সব মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই; তোমাদের অধীনদের (দাস-দাসী) প্রতি খেয়াল রাখবে—তোমরা যা খাবে, তাদের তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরও তা পরাবে। সাবধান! ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না; কেননা তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা ধর্মীয় বিষয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে। হে লোক সকল! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত করবে; পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়বে, রমজান মাসে রোজা রাখবে, সন্তুষ্টচিত্তে সম্পদের জাকাত প্রদান করবে, স্বীয় প্রভুর ঘরে এসে হজ পালন করবে এবং নেতাদের আনুগত্য করবে; তাহলে তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে। হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা শোনো। হয়তো আমি এ বছরের পর এখানে আর কখনো তোমাদের সঙ্গে মিলিত হব না। হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এই দিন ও এই মাসের মতো তোমাদের ওপর নিষিদ্ধ ও পবিত্র তোমাদের প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাতের দিন পর্যন্ত। অচিরেই তোমরা তোমাদের মহান প্রভুর সাক্ষাতে উপনীত হবে। তখন তিনি তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। আমি তো তোমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। তোমাদের কারও কাছে যদি কোনো আমানত গচ্ছিত থাকে, তা তার প্রাপকের কাছে অবশ্যই পৌঁছে দেবে। নিশ্চয়ই সব ধরনের সুদ রহিত করা হলো। তবে তোমাদের মূলধন বহাল থাকবে। মহান আল্লাহ ফয়সালা দিয়েছেন যে আর কোনো সুদ নয়। আব্বাস ইবন আবদুল মুত্তালিবের সব সুদ রহিত করা হলো। তোমরা কোনো জুলুম করবে না, বরং তোমাদের প্রতিও কোনো জুলুম করা হবে না। জাহিিল যুগের যত রক্তের দাবি, তা সব রহিত করা হলো। প্রথম আমি রিবয়া ইবন হারিস ইবন আবদুল মুত্তালিবের শিশুপুত্রের রক্তের দাবি রহিত করলাম। হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই শয়তান তোমাদের এই ভূখণ্ডের উপাস্য হওয়ার ব্যাপারে চিরদিনের জন্য নিরাশ হয়ে গেছে। তবে এ ছাড়া তোমরা যা তুচ্ছ মনে করে থাকো, এমন বহু কাজ রয়েছে, যাতে তার আনুগত্য করলে সে খুশি হবে। সুতরাং তোমরা তোমাদের দ্বীনের ব্যাপারে তার থেকে সাবধান থেকো। হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই মাসসমূহকে আগ-পিছ করা বস্তুত কুফরিকেই বৃদ্ধি করা, যা দ্বারা কাফিররা বিভ্রান্ত হয়। অথচ কাল (সময়) তার নিজস্ব নিয়মে প্রকৃতিতে আবর্তিত হয়। হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক প্রাপকের (উত্তরাধিকারীর) জন্য তার অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে ব্যক্তি নিজের জন্মদাতা ছাড়া অন্যের সঙ্গে নিজের বংশসূত্র স্থাপন করে এবং যে নিজ মনিব ছাড়া অন্যকে মনিব বলে স্বীকার করে, তার ওপর আল্লাহর লানত। সব ঋণ পরিশোধের যোগ্য ও অধিকার, ধারকৃত বস্তু ফেরতযোগ্য, উপঢৌকনেরও বিনিময় প্রদান করা উচিত, জামিনদার জরিমানা আদায় করতে বাধ্য থাকবে। কারও জন্য তার অপর ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে নিজে সন্তুষ্টচিত্তে তা প্রদান না করে। কোনো নারীর জন্য তার স্বামীর অনুমতি ব্যতিরেকে স্বামীর অর্থ-সম্পদ থেকে কাউকে কিছু দেওয়া বৈধ নয়। তোমরা কখনো একে অন্যের ওপর জুলুম কোরো না। নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের অধিকার রয়েছে এবং তোমাদের ওপরও তাদের অধিকার আছে। তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হলো তারা তোমাদের বিছানায় কাউকে কখনো স্থান দেবে না, যা তোমাদের সবার অপছন্দনীয় এবং তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হচ্ছে, তারা কোনো অশ্লীল বা লজ্জাকর কাজে লিপ্ত হবে না। তোমরা নারীদের প্রতি কল্যাণকামী হও। কারণ, তারা তোমাদের কাছে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। তারা তো নিজেদের জন্য কিছু করে না। তোমরা তো তাদের আল্লাহর আমানতস্বরূপ গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর বাণীর মাধ্যমে তাদের সতীত্বের ওপর অধিকার লাভ করেছ (বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য অধিকার লাভ করেছ)। অতএব, হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা অনুধাবন করো। আমি তো পৌঁছে দিয়েছি। আমি তোমাদের মাঝে এমন সুস্পষ্ট দুটি বিষয় (বিধান) রেখে গেলাম, যা দৃঢ়ভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না: আল্লাহর কিতাব এবং তাঁর নবী (সা.)–এর সুন্নাহ। হে মানবমণ্ডলী! তোমরা আমার কথা শোনো ও অনুধাবন করো। তোমরা অবশ্যই জেনে রেখো, প্রত্যেক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই এবং মুসলিমগণ ভ্রাতৃপ্রতিম। সুতরাং কোনো মুসলিমের জন্য তার ভাইয়ের কোনো কিছু বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে সন্তুষ্টচিত্তে তাকে তা প্রদান করে। অতএব, তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম কোরো না। সবাই শোনো, এখানে উপস্থিত লোকেরা যেন এই বার্তাগুলো অনুপস্থিত লোকদের কাছে পৌঁছে দেয়। হয়তো অনেক অনুপস্থিত লোক উপস্থিত শ্রোতা অপেক্ষা অধিক হেফাজতকারী হবে। শোনো! তোমরা আল্লাহর দরবারে আমার ব্যাপারে যখন জিজ্ঞাসিত হবে, বলো তখন কী উত্তর দেবে? উপস্থিত সাহাবিরা উত্তর দিলেন, আপনার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আপনি যথাযথ পালন করেছেন; ইয়া রাসুলুল্লাহ! (হে আল্লাহর রাসুল!) আপনি রিসালাতের হক পূর্ণরূপে আদায় করেছেন এবং উম্মতকে কল্যাণপথের দিশা দিয়েছেন। তারপর তিনি সাহাবিদের উদ্দেশে বললেন, ‘আমি কি পৌঁছে দিয়েছি?’ উপস্থিত সাহাবিরা সমস্বরে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি পৌঁছিয়েছেন।’ তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) আকাশের দিকে শাহাদত অঙ্গুলি উত্তোলন করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন; হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন।’ অতঃপর নাজিল হয়: ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের ধর্মকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করলাম এবং তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে ইসলাম দিয়ে আমি সন্তুষ্ট হলাম।’ (আল-কোরআন, পারা: ৬, সূরা-৫ মায়িদাহ, আয়াত: ৩)। (বিশ্বনবী, গোলাম মোস্তফা; সীরাতুন নবী (সা.), ইবনে হিশাম (র.), খণ্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ২৭৩-২৭৭; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ইবনে কাসীর (র.), খণ্ড: ৫, পৃষ্ঠা: ১৯৮ ও ৩২০-৩৪২, ই. ফা. বা.)।

৬৩২ খ্রিস্টাব্দে যুলহাজ্জ্ব মাসে বিদায় হজ্জ্বের পর ২৯ সফর মহানবী (সা.) মাথাব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। ১২ই রবিউল আউয়াল, সোমবার ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মহানবী (সা.) আজ নেই। তিনি ছিলেন সর্বশেষ নবী। আর কোন নবী আসবেন না। তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন দু’টি মুল্যবান জিনিস। একটি হলো কুরআন আর অপরটি হলো সুন্নাহ। এই দু’টিকে শক্ত করে আকড়ে ধরার তাগিদ রয়েছে ইসলামে।

আজকের সময়ে যাদের জীবনে কুরআন ও সুন্নাহর প্রভাব রয়েছে তারা হচ্ছেন সমাজের মণিমুক্তা। তাদের জীবন সৌন্দর্যে প্রতিফলিত হয় আল্লাহর দ্বীনের আদর্শ। ইসলামী জীবন প্রণালী, রীতিনীতি, আদব কায়দা ও আচার আচরণে তারা হয় মূর্ত প্রতীক। তাদের ভদ্রতা, শিষ্টাচার, কর্মপন্থা ও কর্মনীতি বিমুগ্ধ করে তোলে সমাজের মানুষকে। তাদের অনাবিল পরিচ্ছন্ন জীবনধারা মানুষকে আকৃষ্ট করে আল্লাহর পথে।

আমরা এখন দেখব মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কেন শ্রেষ্ঠ মানব।

  • সমাজে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা ।
  • শত্রুদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন।
  • সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততা।
  • আমানতের খেয়ানত না করা।
  • আরব-অনারবদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা।
  • অন্য ধর্মালম্বী বা ভিন্নমতালম্বীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক সমমর্যাদা দান।
  • নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা।
  • সমাজের পিছিয়ে পড়া সকল ধর্মের মানুষদের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছেন।
  • মানুষের প্রতি তার প্রেম, ক্ষমা ও মহত্য অবিস্বরনীয়।

তাই সর্বগুণে সর্বোত্তম আদর্শ মানব ছিলেন তিনি।

 

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলামঃ

বিশ্বে ইসলাম সব বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ ধর্ম। ইসলাম শব্দের সরল অর্থ শান্তি। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাই ইসলাম ধর্মের লক্ষ্য। অশান্তি হয় এমন সব কাজ ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ। আমাদের নবী হযরত মুহম্মদ (স.) বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মানব। তিনি জীবনে মিথ্যা কথা বলেননি। তিনি ছিলেন সত্যের উপাসক। নবী হওয়ার আগে মক্কায় তিনি সত্যবাদিতার জন্য ‘আল-আমিন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।  ইসলাম ধর্মের মূল ভিত্তি ইমান (বিশ্বাস)। আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় তাঁর কোনো শরিক নেই। হযরত মুহম্মদ (স.) তাঁর (আল্লাহর) বার্তাবাহক। এই বিশ্বাসই ইমান।  ইমান আনার পরে মানুষের পরিচয় হয় মুসলমান হিসেবে। মুসলমানরা হবে নবীর অনুসারী। মুসলমান আল্লাহর ইবাদত করে। ইবাদত শব্দের অর্থ আনুগত্য স্বীকার করা। ইবাদত দুই প্রকারের। আল্লাহর প্রতি (হকুল্লাহ) আর আল্লাহর সৃষ্টকুলের প্রতি (হক্কুল ইবাদত)। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত হলো আল্লাহর প্রতি বান্দার ইবাদত। এ ইবাদতে ভুল হলে আল্লাহ তা ক্ষমা করার অধিকার রাখেন। এ বিষয়ে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনে বহু আয়াত আছে। কিন্তু বান্দার প্রতি অর্থাৎ আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি যে ইবাদত তা যদি আমরা পালন না করি এ জন্য যে গুনাহ হবে তা ক্ষমা করার মালিক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি যদি তা ক্ষমা না করেন তাহলে তা আল্লাহও ক্ষমা করবেন না। এমন বিধান অন্য কোনো ধর্মে আছে কি? বান্দার হককে ইসলাম ধর্মে আল্লাহর হকের পরেই স্থান দিয়েছে।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, “আমি আজ তোমাদের ধর্মকে (এখানে শুধু মুসলমানদের কথা বলা হয়নি পুরো মানবজাতীর কথা বলা হয়েছে) পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের জন্য পরিপূর্ণ করে দিলাম। ইসলামকে তোমাদের জন্যে জীবনব্যবস্থা হিসেবে মনোনীত করলাম’ -(সুরা আল-মায়িদা, আয়াত: ০৩)।

ইমানের পরে আসে নামাজ। সময়ের ৫টি অবস্থানকে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্মে ৫ বার আল্লাহকে স্মরণ করার বিধানকে নামাজ বলে। ভোরে ফজর, দুপুরে জোহর, বিকালে আসর, সন্ধ্যায় মাগরিব আর রাতে এশার নামাজ ফরজ (অবশ্য পালনীয়) করা হয়েছে। মুসলমানরা একত্রিত হয়ে যথাক্রমে ২, ৪, ৪, ৩ ও ৪ রাকায়াত ফরজ নামাজ মসজিদে একত্রিত হয়ে আদায় করে। নামাজ আদায়ের আগে পানি দিয়ে পবিত্র হওয়ার (অজু করার) বিধান রয়েছে। দৈনিক ৫ বার অজু করার ফলে হাত, মুখমণ্ডল, নাক, পা, মাথা পানি দিয়ে তিনবার করে বিশেষ নিয়ম মেনে ধৌত করা হয়। এতে মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি লাভ করা যায়। দৈনিক ৫ বার ছাড়াও ইসলাম ধর্মে সাপ্তাহিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক আরও তিন ধরনের ফরজ (অবশ্যই পালনীয়) নামাজ আদায় করতে হয়। প্রতি শুক্রবার মসজিদে ২ রাকায়াত ফরজ নামাজ, দুই ঈদে মাঠে ২ রাকায়াত ওয়াজেব নামাজ ও বছরে একবার পবিত্র কাবাঘরে হজের তাওয়াফ করতে হয়। এতে মুসলমানদের মধ্যে সাপ্তাহিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক সম্মেলন আকারে পারস্পরিক দেখা শোনা হয় ফলে ভ্রাতৃত্ব দৃঢ় হয়। অন্য কোনো ধর্মে এমন ব্যবস্থা আছে বলে আমার জানা নেই। নামাজের মাধ্যমে মানুষের মনে আল্লাহর প্রেম সৃষ্টি হয়। ফলে প্রকৃত নামাজ আদায়কারীর দ্বারা কোনো অন্যায় কাজ সাধিত হয় না। দ্বিতীয় স্থানে আসে বছরে ১ মাস রোজা পালন। হিজরি বর্ষের রমজান মাসে দিনের বেলা পানাহার থেকে বিরত ও সকল প্রকার অন্যায় কাজ, অন্যায় চিন্তা ও কুমতলব থেকে মুক্ত থাকাই রোজা। রমজান মাসে প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী একই সময়ে সাহরি খায়, একই সময়ে ইফতার করে। এতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে একটি শৃঙ্খলা আসে। দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজের অতিরিক্ত হিসাবে আরও ২০ রাকায়াত তারাবিহ নামাজ পড়ার ফলে প্রতিটি রোজাদারের শরীর ও মন পরিশিলীত হয়। সারা দিন পানাহার ও কামাচার থেকে বিরত থাকায় একজন রোজাদার ক্ষুধার কষ্ট বুঝতে পারে বিধায় সে অনাহারি মানুষের দুঃখ যাতনা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে সক্ষম হয়। যা একজন বেরোজাদার কখনও অনুভব করতে পারে না। রোজাদার অনাহারি গরিব মানুষদের সহায়তা সরার তাগিদ রোজার মাধ্যমে অনুভব করে। ফলে মনুষ্যত্ববোধ হৃদয়ে বেশি করে জাগ্রত হয়। এতে মহান আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্য বৃদ্ধি পায়। নামাজ ও রোজার মাধ্যমে মানব মনে আল্লাহর প্রেম (তাকওয়া) সৃষ্টি হয়। চরিত্রে নম্রতা ও বিনয় সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও মমত্ববোধ জাগ্রত হয়। এটাই রোজার শিক্ষা।

সব মুসলমানের জন্য ইমান, নামাজ ও রোজা ফরজ। মুসলমানদের মধ্যে যারা ধনী তাদের জন্য আরও দুটি ফরজ ইবাদত আছে। তা হলো জাকায়াত আদায় করা ও জীবনে একবার মক্কায় গিয়ে হজ পালন করা। ধনীদের সম্পদে রয়েছে গরিবের হক। ইসলামের বিধান মেনে নির্দিষ্ট হারে সম্পদের ওপর জাকায়াত হিসাব করে কড়ায় গন্ডায় আদায় করতে হবে। ক্ষোদ দেখানো, ফাঁকিঝুকি দিয়ে নিজের মনগড়া হিসাবে জাকায়াত দিলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ধনীরা যদি ঠিকমতো জাকায়াত না দেয় তা হলে শেষ বিচার দিনে তাদের জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে।  ইসলামের বিধান মেনে সব মুসলমান জাকায়াত দিলে বিশ্বের মধ্যে গরিব খুঁজে পাওয়া যেত না। অন্য কোনো ধর্মে জাকাতের অনুরূপ আর্থিক ইবাদত নেই। জীবনে একবার হজ পালন করা ধনী মুসলমানের জন্য ফরজ। হজ পালনের মধ্য দিয়ে একজন হাজী শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসেন। সারা বিশ্বের মুসলমানরা আরাফাত ময়দানে একত্রিত হয়। যা একদিক দিয়ে বার্ষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের রূপ নেয়। যার ফলে বিশ্বের মুসলমানদের মধ্যে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি হয়। হক্কুল ইবাদতের মধ্যে নিষ্ঠার সঙ্গে সব কাজকর্মই আসে। কৃষকের কৃষি কাজ, জেলের মৎস্য ধরা, মাঝির নৌকা চালানো, ঠিকমতো ড্রাইভ করা, সৎভাবে চাকরি করা ইত্যাদি হক্কুল ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। এক কথায় সৎভাবে সম্পাদিত সব কর্মই ইবাদত।  

ইসলাম পৃথিবীর একমাত্র মানবতার কল্যাণকামী শ্রেষ্ঠ ধর্ম। পৃথিবীতে ইসলামই একমাত্র ধর্ম যেখানে মানবতার কল্যাণ সাধন করাকে এতোটা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত মানবজাতির কল্যাণের জন্যে তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে।  ( সুরা আল ইমরান ১১০)। এখানে শুধু ইসলামের অনুসারীদের বা মুসলমানের কথা বলা হয়নি কারণ আল্লাহ শুধু মুসলমানদের সম্পদ নয় তিনি সকল মানুষ ও অন্যান্য সবকিছুরই সৃষ্টিকর্তা।

আল্লাহ বলেন, যারা নিজেদের ধন সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি বীজের মত, যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে রয়েছে ১০০ শস্যদানা।  আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছে বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন।  আর আল্লাহ সর্বব্যাপী প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।  (সুরা বাকারা-২৬১)। 
 
আল্লাহ আরও বলেন, আর তাদের ধন–সম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের হক।  ( সুরা যারিয়াত -১৯)।

প্রশ্ন হলো- আমরা কি ভিক্ষুক আর বঞ্চিতদের হক ঠিকমত আদায় করছি? আমরা কি প্রকৃত অর্থে ইসলাম ধর্মকে অনুসরণ করে প্রকৃত মুসলমান হতে পেরেছি? আর তা যদি হয়ে থাকে তাহলে বিশ্বে মুসলমানরা এত লাঞ্চিত হচ্ছে কেন?

ইসলাম এবং কোরআন নিয়ে গবেষণা করেছেন বিশ্বের অন্যান্য ধর্মালম্বীর বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও মনীষী। তাঁদের মতেও ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম এবং পবিত্র কোরআন শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।  

ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্রের অধ্যাপক রবার্ট বায়ের জোসেফ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বলেছেন, “নিঃসন্দেহে ইসলাম- জ্ঞান বিজ্ঞানের ধর্ম- ইহা তার অনুসারীদেরকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও আমলের দ্বারা পাথেয় সংগ্রহ করতে সর্বদা আহবান করে। এতে কোন সঃন্দেহের অবকাশ নেই; কেননা আল কোরআনের সর্বপ্রথম আয়াতই হলোঃ পড়ুন আপনার রবের নামে”।

ব্রিটিশ প্রাচ্যবিশেষজ্ঞ স্ট্যানলি লেন. পল  বলেছেন,  “মানব ইতিহাসে কখনও সংস্কৃতির জন্য হঠাৎ আবেগময় হয়ে উঠার সেই আন্দোলনের মত আকর্ষনীয় কোন ঘটনা ঘটেনি, যেমনটি ঘটেছিল সে সময়ে সারা মুসলিম জাহান জুড়ে। তখন প্রত্যেক মুসলমান খলিফা থেকে শ্রমিক সকলেই যেন জ্ঞানের জন্য হঠাৎ আসক্ত হয়ে গেল, জ্ঞান অন্বেষণে সফর করতে তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠল। আর এটা ছিল ইসলাম সর্বক্ষেত্রে যে সব অবদান রেখেছে তার মাঝে সর্বোত্তম। জ্ঞান পিপাসু ছাত্রদের পদচারণায় তখনকার শিক্ষাকেন্দ্রসমূহ যেমন বাগদাদ নগরী, এরপরে অন্যান্য কেন্দ্রসমূহ যা কলা ও বিজ্ঞানের জন্য প্রস্তুত ছিল ইত্যাদি মুখরিত ছিল। যেমনিভাবে ইউরোপীয় জ্ঞানীদের হাতে আধুনিক মতাদর্শ গড়ে উঠেছিল, তাদের হাতে আধুনিক জ্ঞানের নানা গবেষণায় সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলো তরঙ্গায়িত হতো; বরং তাদের চেয়েও বেশী আকর্ষনীয় ও চমৎকার ছিল”।

ফরাসি দার্শনিক রিনে জীনো বলেছেন, “আমি আল কোরআনে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান সম্পর্কিত আয়াতসমূহ গবেষণা করে দেখেছি যে, এসব আয়াত আমাদের আধুনিক জ্ঞানের সাথে পুরোপুরি প্রযোজ্য। আমি বিশ্বাস করেছি যে, হাজার বছর পূর্বে মুহাম্মদ মানবজাতির থেকে কোন শিক্ষকের সাহায্য ছাড়াই স্পষ্ট সত্য নিয়ে আগমন করেছিলেন। যে কোন বিজ্ঞানী বা শিল্পী তার জ্ঞানের সাথে কোরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াতসমূহ তুলনা করে, যেমনিভাবে আমি করেছি, তবে নিঃসন্দেহে সে কোরআনের বশ্যতা স্বীকার করবে, যদি সে বিবেকসম্পন্ন হয় এবং হীন উদ্দেশ্য থেকে মুক্ত হয়”।

ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী  মহানবী হযরত (সা.) ছিলেন জীবনের সকল দিকে সর্বগুণে সুন্দরতম। তাঁর নেতৃত্ব ছিল সহজাত, ব্যক্তিত্ব ছিলো বরেণ্য, আচার-আচরণ ছিলো অনন্য অনুপম। মহানবী (সা.) ছিলেন মানবতার বন্ধু। সবসময় তিনি মানুষের কল্যাণ কামনা করতেন। মানুষের ক্ষতি ও কষ্ট দেখলে তাঁর হৃদয় কেদে উঠতো। মানুষের দুঃখ কষ্টে তিনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন। মানুষের দোষ ত্রুটি ক্ষমা করে দিতেন। তাঁকে যারা কষ্ট দিতো তাদের সবাইকে তিনি ক্ষমা করে দিতেন। এজন্যেই তো কুরআনে তাঁকে ‘রাহমাতুল লিল আলামীন’ বা জগতবাসীর জন্য ‘রহমত’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।

মহানবী (সা.) শৈশব থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কখনো মিথ্যা কথা বলেননি তাই তাকে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়র লোক আলামীন বা বিশ্বাসী খেতাবে ভূষিত করেছেন। তিনি ছিলেন অনাবিল সত্যবাদী ও সত্যের বাহক। মিথ্যাকে বিনাশ করা আর সত্যকে সমুন্নত করাই ছিলো তাঁর জীবনের অন্যতম মিশন। তিনি সর্বপ্রকার বিপদে আপদে ধৈর্য ধারণ করতেন। বিপদ, মুসিবত, দুঃখ কষ্ট, অত্যাচার নির্যাতন, ক্ষুধা, দারিদ্র, অভাব অনটন, মানুষের দেয়া জ্বালা যন্ত্রণা সবই তিনি অকাতরে সইতে পারতেন। কোন কিছুই তাঁর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙ্গতে পারতো না।

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, “তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। দরিদ্রদের দান করো। বড়দের সম্মান করো। ছোটদের স্নেহ করো। স্ত্রীর সাথে সুন্দর ব্যবহার করো। মানুষকে কষ্ট দিয়ো না। কারো প্রতি জুলুম করো না। বিশ্বাসঘাতকতা করো না। অশ্লীল কাজ করো না। লোভ লালসায় মত্ত হয়ো না। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করো না। আমানতের খেয়ানত করো না।

আমরা এখন দেখব ইসলাম কেন শ্রেষ্ঠ ধর্ম।

  • কোরআনের পরে আর কোন ধর্ম গ্রস্থ নাজিল হয়নি।
  • বিজ্ঞানের সকল দিকই রয়েছে কোরআনে।
  • হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর পর কোন নবী আর আসেনি।
  • একক স্রষ্টায় বিশ্বাস শিখিয়েছে কোরআন।
  • কোরআনের প্রতিটি বাণী মানবজাতির  জন্য কল্যাণকর।
  • মানুষকে সমান দৃষ্টিতে দেখিয়েছে ইসলাম।  

উপরোক্ত আলোচনা প্রেক্ষিতে একথা সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব এবং ইসলামই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম।

আগামীনিউজ/এএইচ