ধরিত্রী রক্ষা না করলে মানবজাতির ধ্বংস অনিবার্য?

ড. নিম  হাকিম  জুলাই ১১, ২০২০, ১১:৩৮ এএম
ড. নিম  হাকিম 

সমগ্র প্রাণী ও জীবকুল পৃথিবীতে আগমনের পূর্বেই সৃষ্টি হয়েছে ধরিত্রী। তারপর ধরিত্রীকে সাজানো হয়েছে প্রাণীকুলের বসবাসের মত উপযোগী করে। উদ্ভিদ ও প্রাণীকুল যাতে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে টিকে থাকতে পারে সে ব্যবস্থাও ছিল সৃষ্টির আদি থেকেই। প্রকৃতি এমনভাবে সজ্জিত হয়েছিল যে তার কোন অঙ্গ-প্রতঙ্গ যেন কোন অভাব বোধ না করে। 

যেমন: নদীতে থাকবে নানা প্রকার জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ, যারা পরস্পরকে সহযোগিতার মাধ্যমে টিকে থাকবে অনাদিকাল। পানিতে থাকবে মাছ, তা আহরণ করে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করবে অন্যান্য প্রাণী। থাকবে উদ্ভিদ ও জীব কণা, যা থেকে খাদ্য পাবে মৎস্যকুল। মানুষ তার পিপাসা নিবৃত করবে প্রাকৃতিক জলাধার থেকে। মালামাল পরিবহন হবে নৌযানে। জীবন ও জীবিকার সাথে সম্পৃক্ত থাকবে প্রাকৃতিক জলাধার।

মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর এক প্রাকৃতিক ছন্দময় জীবন পদ্ধতি ও কৃষ্টি গড়ে উঠেছিল এভাবেই। সৃষ্টিকর্তা তার আপন মহিমায় সাজিয়ে ছিল প্রাণী ও  উদ্ভিদকুলের বাসযোগ্য এই ধরিত্রী। মা যেমন তার সন্তানদের লালন করে, ধরিত্রী তেমন আমাদের লালন করে, তাই তো আমরা বলি ধরিত্রী মাতা।

মহাসাগরের উত্তাল জলরাশি, পাহাড়ের ঝর্ণাধারা, নদীর কলতান, রঙ-বেরঙের প্রাণীকুল সবই আমাদের জন্য। নীল আকাশ, রাতে উজ্জ্বল নক্ষত্র মন্ডিত হলে-কি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই না সৃষ্টি করে। বৃক্ষরাজি, ফল আর নানা রঙ মেশানো প্রাণকারা অপরূপ সৌন্দর্য আর কোথায় আছে? 

বিশ্বখ্যাত কবি ও সাধক শেখ সাদী তাই লিখেছেন, “বৃক্ষরাজির সবুজ পাতায় নজর কর বুদ্ধিমান। দেখবে তাতে সৃষ্টিকর্তার গোপন রহস্য বিদ্যমান, মানুষ জীব-জন্তু, জলজ আর স্থলজ প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের মিলেমিশে বাস করার এই যে কৌশল, তা বোধহয় অনেকেই অনুভব করেন। ফুলের সৌন্দর্য, পাখির গান, নদীর কলতান, ফলের স্বাদ-এসব সত্যিই ভাববার বিষয়।প্রকৃতির এই ভান্ডারে আমরা মানবকুল সামান্য কিছু সময়ের উপভোগকারী।

আমাদের জীবন অনন্ত নয়। আমরা যতটুকু পারি তা  উপভোগ করি, তার পর ফিরে যাই যেখান থেকে এসেছি। অর্থাৎ মহাশক্তির আলিঙ্গনে। প্রকৃতি আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে, আমরা তার কোলেই ফিরে যাই। মা-ধরিত্রী আমাদের সব চাহিদা পূরণ করছে, তবুও আমরা তার কাছে বড়ই অকৃতজ্ঞ। তাই সৃষ্টিকর্তাও দুঃখ করে বলেছেন, “হে মানব তোমরা বড়ই অকৃতজ্ঞ”। প্রকৃতি নিজেকে যেভাবে সাজিয়েছে আমরা তা নষ্ট করছি। প্রতিনিয়ত উত্ত্যক্ত করছি প্রকৃতিকে। নিরুপায় প্রকৃতি তাই নানা দুর্যোগের মাধ্যমে প্রতিশোধ নিচ্ছে আমাদের উপর। তবুও আমরা ক্ষ্যান্ত হইনে বরং আরো ধ্বংসলীলায় মেতে উঠি। সৃষ্টির আদিতে সৃষ্টিকর্তা যেভাবে সাজিয়েছিল ধরিত্রী মাতাকে তা এখন রোগাক্রান্ত। অত্যাচার-অবিচার আর নির্যাতনের মাধ্যমে আমরা প্রকৃতিকে করেছি বিবস্ত্র, তাই প্রকৃতি কখনো কাঁদছে, আবার কখনও ধারণ করছে হিংস্ররুপ। আর মানব জাতি তা অবলোকন করছে নীরবে। প্রকৃতিরও একটা সহ্য আর ধৈযের সীমা আছে।

ধরিত্রী যদি টিকে না থাকে তাহলে আমরা যাব কোথায়? কোথায় পাব আমরা আমাদের জীবন রক্ষার জন্য খাদ্য, পানি, বাতাস, আশ্রয় ও রোগ-শোকে চিকিৎসা? এসব কিছু তো প্রকৃতি থেকেই আসে, আমরাতো এর কিছুই তৈরি করতে পারিনা। আমরা যা তৈরি করতে পারি না তা ধ্বংস করার অধিকার আমাদের কে দিয়েছে? তথাপিও আমরা এই অনৈতিক কাজটি করছি অহরহ। আমরা যেমন পারি না অক্সিজেন তৈরি করতে, উদ্ভিদ বা অন্যান্য প্রাণীকুল সৃষ্টি করতে অথবা এগুলো ছাড়া আমাদের জীবনধারণ মোটেও সম্ভব নয়। 

বৈজ্ঞানিকরা তথ্য-প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে যা কিছু তৈরি করেছে, তা না হলে আমাদের বেঁচে থাকতে কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু প্রকৃতি আমাদেরকে যা দিয়েছে তা ছাড়া আমরা এক মুহূর্তও বাঁচতে পারি না অথচ এই মহাসত্যটির প্রতি আমরা মোটেও গুরুত্ব দেই না।

প্রকৃতি নানা দুর্যোগের মাধ্যমে বার বার আমাদের হুঁশিয়ার করছে, কিন্তু আমরা মোটেও সতর্ক হচ্ছি না। ধ্বংসাত্বক সব প্রযুক্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি প্রকৃতি, প্রকৃতি ধ্বংস করার জন্য ধ্বংসাত্বক প্রযুক্তি উদ্ভাবন আর ব্যবহারের জন্য যে অর্থ ও প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যয় হচ্ছে তার সহস্র ভাগের একভাগও যদি ধরিত্রীর কাজে ব্যয় হতো তাহলে হয়তো ধরিত্রীতে মানুষ, অন্যান্য প্রাণী ও উদ্ভিদকুলকে আরো নবরূপে সাজানো যেত।

বিলুপ্ত প্রায় এর তালিকাও অনেক ভারী। দূষণের কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে পৃথিবী। প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ, কায়িক শ্রম, শারীরিক খেলাধুলার পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে মানুষ শিকার হচ্ছে তথ্য সন্ত্রাসের। আর ঘরে বসে মিডিয়ায় সব কিছুই উপভোগ করছে। শ্রমের হাতগুলো পরিণত করা হচ্ছে অলস অঙ্গে। আগের মত এত পাখি গাছ-পালা, জীব-জন্তু, নদীলালা, খালবিল. গ্রাম্য খেলাধুলা এখন আর চোখে পড়ে না। কৃত্রিম আর ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের কারণে খাদ্য সামগ্রীর পুষ্টি গুণ আর স্বাদ নষ্ট হয়ে গেছে। ভিটামিন সমৃদ্ধ এসব শাকসবজি খেয়ে মানুষ হচ্ছে নানা রকম প্রাণঘাতী রোগের শিকার। মানুষের রক্ত হয়ে পড়ছে বিষাক্ত। আমাদের শিশুরা হচ্ছে মানসিক আর শারীরিক পঙ্গুত্বের শিকার। সব কিছু মিলে মানব সভ্যতা এগিয়ে যাচ্ছে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তবে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদ শেষ হয়ে যাবে-দুষণের কারণে নিরাপদ খাদ্য সামগ্রীর অভাব দেখা দেবে সর্বোপরি পরিবেশের ভারসাম্য নষ্টের কারণে ধরিত্রী হয়ে পড়বে জীবকুলের বাসের অযোগ্য এবং প্রকৃতির নিয়মে তখন ধ্বংস অনিবার্য। আমাদের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন বিজ্ঞানী এবং প্রকৃতি ও পরিবেশবিদরা এমনটিই আশংকা করছেন।