আধুনিক যন্ত্রের কাছে হার মেনে পেশা বদলাচ্ছেন শীতবস্ত্র তৈরির কারিগররা 

মানিক সাহা, গাইবান্ধা জেলা প্রতিনিধি সেপ্টেম্বর ২১, ২০২১, ০৩:৫০ পিএম
ছবি : আগামী নিউজ

গাইবান্ধাঃ অত্যাধুনিক কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের কারণে দিন দিন বেকার হচ্ছে মানুষ। এ কারণেই তারা ঝুকছে বিকল্প পেশার দিকে। এমনিভাবে গাইবান্ধা গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর নয়ারহাট এলাকার বহু হোশিয়ারী কারিগর আধুনিক যন্ত্রের কাছে জীবন-জীবিকার অবলম্বনের মাধ্যম তাদের দীর্ঘদিনের পেশা হারিয়ে এখন বিকল্প পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন হাতপাখা তৈরীর কাজ। 

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, বহুদিন আগে থেকেই এ এলাকার নারী-পুরুষ-শিশুসহ প্রায় সকল বয়সী মানুষ কারিগর হিসেবে সুয়েটার তৈরির ফ্লাট মেশিনে বিভিন্ন ধরণের সোয়েটার, মাফলার বা মোজা তৈরি করতেন। কিন্তু বর্তমানে এখানকার অধিকাংশ কারখানাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন কম্পিউটারাইজড মেশিন স্থাপন হওয়ায় স্বল্পসময়ে ও কম শ্রমিকে উন্নতমানের বিপুল সংখ্যক শীতবস্ত্র উৎপাদিত হচ্ছে। এর ফলে কাজ হারানো ওই কারিগর ও শ্রমিকদের মধ্যে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা বাড়িতে বসে হাতপাখা ও টুপি তৈরি করে কোনমতে দিনযাপন করছেন। পুরুষ শ্রমিকদের অনেকেই রিক্সা-ভ্যান ও অটোভ্যান চালানো থেকে শুরু করে রেলগাড়ি এবং বিভিন্ন হাটবাজারে ফেরী করে পাখা, টুপি, মোজা সহ বিভিন্ন মালামাল বিক্রির পেশায় নিয়োজিত হয়েছেন বাধ্য হয়ে। রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রিও হয়েছেন অনেকে। সম্প্রতি হোসিয়ারিপল্লী হিসেবে পরিচিত গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কোচাশহর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে এ চিত্র।    


    
গত শতকের দেশবিভাগ পরবর্তী সময়ে যে পাড়ায় প্রথম দুটি হাতে চালানো মোজা তৈরির মেশিন স্থাপনের মাধ্যমে এখানে হোসিয়ারি শিল্পের গোড়াপত্তন হয়েছিল, কারিগরপাড়া নামে পরিচিত সেই পেপুলিয়া-বনগ্রাম এখন হোসিয়ারি মেশিনশূন্য হয়ে পড়েছে। কোন বাড়িতেই আর শোনা যায়না মেশিনের ঠক ঠক শব্দ। এখানকার কারিগররা নিজেদের ছোট ছোট মেশিন ছাড়াও চারপাশের গ্রামগুলোতে প্রায় প্রতিটি বাড়িতে স্থাপিত ছোট-বড় কারখানাগুলোতে কারিগর বা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন বছরের অধিকাংশ সময়। মেশিনে সুয়েটার, মাফলার তৈরী, মোজা সেলাই, ইস্ত্রি, প্যাকিংসহ বিভিন্ন ধরনের কাজে যুক্ত থাকতেন তারা। এখানকার তৈরি শীতবস্ত্র দেশের একতৃতীয়াংশ চাহিদা পূরণ করে থাকে। কিন্তু গত পাঁচ-ছয় বছরে বিদেশ থেকে আমদানী করা স্বয়ংক্রিয় ও কম্পিউটারাইজড অত্যাধুনিক মেশিন স্থাপন করেন অনেকগুলো বড় বড় কারখানা স্থাপন হয়ে যায় এ এলাকায়। 

আগে প্রতিটি মেশিনে একজন করে কারিগর কাজ করতেন। বর্তমানের আধুনিক এ সব মেশিন শীতবস্ত্র উৎপাদনে একশ’ গুণ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। বর্তমানের আধুনিক এ সব মেশিন চলে সম্পূর্ণরূপে কম্পিউটারের ডিজাইন ও নিয়ন্ত্রনে। একজন অপারেটর একাই এমন পাঁচ-সাতটি মেশিন চালনা করতে পারেন। আগের একশ’ জন কারিগর ও শ্রমিকের এমন কারখানা চলে মাত্র পাঁচ থেকে সাতজন অপারেটরের মাধ্যমে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কাজ হারিয়েছেন কারিগরপাড়ার অধিকাংশ কারিগর। 

বনগ্রাম কারিগরপাড়ার হাতপাখা তৈরীর কারিগর গৃহবধু তহমিনা জানালেন, প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে মাঘ মাস পর্যন্ত এ পাড়ার পুরুষদের পাশাপশি নারী ও শিশুরাও বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন। এর আয়ে তারা বেশ স্বচ্ছল জীবন যাপন করতেন। কিন্তু কয়েক বছর থেকে হোসিয়ারি শিল্পে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক মেশিন হওয়ায় ছোট ছোট কারখানাগুলো বন্ধের পাশাপশি কারিগর ও সাধারন শ্রমিকরা কাজ হারাতে শুরু করেন। এ বছর বেকারত্বের হার ঠেকেছে একেবারে চরম পর্যায়ে। অনেক বাড়ির পুরুষরাই পেশা বদলে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন। জীবন বাঁচানোর তাগিদে নারী ও শিশুরা হোসিয়ারী মেশিনের কাজে ব্যবহৃত সুতা কিনে এনে বাড়িতে বসে হাতপাখা ও টুপি বানাচ্ছেন বলে জানালেন একই পাড়ার প্রতিবন্ধী গৃহবধু শান্তনা বেগম। বনগ্রাম কারিগরপাড়ার বৃদ্ধ আনছার আলী জানালেন,  চোখের জ্যোতি কমে আসলেও পেটের তাগিদে স্ত্রী ও পুত্রবধূর সাথে ঘরের দাওয়ায় বসে পাখা তৈরির কাজে তাদের সাহায্য করতে হয় তাকে। বাঁশের ফ্রেমে সুতোর বুননে প্রতিদিন পাঁচ থেকে দশটি পাখা তৈরি করেন তারা। প্রতিটি হাতপাখা ২৫ টাকায় বিক্রি করে খুব কষ্টে দিন যাপন করছেন বলে জানালেন কারিগরপাড়ার গৃহবধু আমেনা, রুবিনা, কণা, সুবিনা সহ অনেকে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়া পুত্র তোহানের টাকার অভাবে লেখাপড়া প্রায় বন্ধের পথে বলে জানালেন কাজ হারানো কারিগর শফিকুল ইসলাম। মহিমাগঞ্জ রেলস্টেশনে ট্রেনে ফেরি করে পাখা বিক্রি করতে আসা পেপুলিয়া গ্রামের মেহেদুল ইসলাম জানালেন, গরমে পাখা বিক্রি করে কোনমতে দিন পার করলেও আগামী দিনগুলোর জন্য তিনি শংকিত। 
  
কোচাশহর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন মন্ডল বলেছেন, হোসিয়ারি শিল্পে বিপ্লব নিয়ে আসা এখানকার আসল কারিগররাই এখন অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছেন। বড় বড় ও আধুনিক কারখানার ভীড়ে হারাতে বসা কোচাশহরের শীতবস্ত্র তৈরির কারিগরদের রক্ষা করতে সরকারি সাহায্য বা স্বল্পসুদে ঋণ দিয়ে ছোট ছোট কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে তাদের পূনর্বাসন করা এখন সময়ের দাবী।