লাভের মুখ দেখছে না সরকারি কর্পোরেশনগুলো, কিন্তু কেন?

প্রভাত আহমেদ ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২১, ০৩:৩৭ পিএম
ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর পেছনে প্রতিবছর জনগণের করের টাকা ব্যয় করা হলেও এসব প্রতিষ্ঠান লোকসান থেকে বের হতে পারছে না। কিন্তু একই খাত যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে গিয়ে পড়ে তখন তারা কিভাবে লাভবান হয়?  গেল অর্থবছরে ১৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠান লোকসান গুনেছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি লোকসান দিয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এই প্রতিষ্ঠানটি শুধু গত বছরেই লোকসান দিয়েছে পাঁচ হাজার ১৪১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।  ২০২০ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ২০০৬ সাল থেকে টানা ১১ বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে। একইভাবে ১৯৯০ সাল থেকে টানা লোকসান দিচ্ছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস করপোরেশন ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। টানা ২৬ বছরে একবারের জন্যও এই দুই প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখেনি। বিটিএমসি গতবছর এপ্রিল পর্যন্ত লোকসান দিয়েছে ৩০ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।

অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, চলতি ২০১৯- ২০ সালের  ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো সাত হাজার ৭৬১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা লোকসান গুনেছে। গেল অর্থবছরে লোকসানের শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লোকসানি প্রতিষ্ঠান পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। এই প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরের (এপ্রিল পর্যন্ত) লোকসান দিয়েছে ৯৭৫ কোটি তিন লাখ টাকা।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক অদক্ষতা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক হয়ে উঠতে পারেনি। এসব লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে।

বিজেএমসি

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে ভারত, সিরিয়া, ইরান, মিসর, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, থাইল্যান্ড, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্য রফতানি হচ্ছে। কিন্তু দেশের চাহিদার মাত্র ২৪ শতাংশ পাটপণ্য সরকারি পাটকল পূরণ করতে পারে। চাহিদার বাকি ৭৬ শতাংশ পূরণ করে বেসরকারি পাটকলগুলো। ওসব পাটকল লাভের মুখ দেখলেও দীর্ঘদিন ধরে সরকারি পাটকলগুলো লোকসানে রয়েছে।

টাকার অভাবে অনেক সরকারি পাটকল বন্ধ হয়েছে। গত ৫ বছরে এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দেয়া হয়েছে। তারপরও টাকার অভাবে সময়মতো পাট কেনা যাচ্ছে না। মূলত অব্যবস্থাপনা, রাজনৈতিক দলাদলি, সময়মতো কাঁচাপাট কিনতে ব্যর্থ হওয়া, পাটের গুণগতমান ভাল না হওয়া, বেশি জনবল, সিবিএ’র দৌরাত্ম্য, পুরাতন যন্ত্রপাতি, নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে সরকারী পাটকলগুলো লাভের মুখ দেখছে না। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে এ খাতকে উৎসাহ দেয়া হলেও সরকারি পাটকলগুলো লাভের মুখ তো দেখছেই না, উল্টো লোকসানের পরিমাণও কমাতে পারছে না।

দেশে বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মোট ৩০৭টি পাটকল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ২৬টি। বাকিগুলো বেসরকারি মালিকানাধীন। দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পাটের রফতানি বাড়ানো যায়নি। পাশাপাশি গতবছরের জুলাই থেকে পাট ও পাটজাত পণ্যের রফতানি কমেছে ২০ শতাংশের বেশি। ওই সময়ে ২ হাজার ৯১২ কোটি টাকার রফতানি লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও তার ২৮ শতাংশও পূরণ হয়নি। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কাঁচাপাটের রফতানি কমেছে ৬১ শতাংশ, পাটের সুতা ২৩ শতাংশ ও অন্যান্য পাটপণ্য ৫৪ শতাংশ। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে এ হার কিছুটা বেড়েছিল। বর্তমানে দেশে বেসরকারি খাতে পাটকলের সংখ্যা জুট স্পিনিং মিলসহ সব মিলিয়ে ২২২টি। সবগুলোই চলছে ভাল। সরকারের পক্ষ থেকে ২০ শতাংশ রফতানি প্রণোদনা পেয়ে খুবই খুশি বেসরকারি পাটকল মালিকরা। কিন্তু সরকারি পাটকলগুলোতে তার কোন প্রতিফলন নেই।

সূত্র জানায়, ১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন ও পরিত্যক্ত পাটকলসহ সাবেক ইপিআইডিসির ৬৭টি পাটকল তদারক, পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ জুট মিলস কর্পোরেশনের (বিজেএমসি) গঠিত হয়। পরে আরো পাটকল সরকারি করে বিজেএমসির আওতায় আনা হয় মোট ৮২টি পাটকল। কিন্তু ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ৪৩টি পাটকলকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পর সরকারের হাতে থাকে ৩৮টি পাটকল। কিন্তু ১৯৯৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে পাট খাত সংস্কার কর্মসূচীর আওতায় আরো ১১টি পাটকল বন্ধ করে দেয়া হয়। বিগত ২০০২ সালে এশিয়ার বৃহত্তম আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যায়।

সূত্র আরো জানায়, স্বাধীনতার আগে থেকে দেশের পাটখাত চলছে। ১৯৬২, ১৯৬৪ ও ১৯৭৪ সালে করা অধ্যাদেশের ভিত্তিতেই চলছে পাটখাত। সংশোধিত অধ্যাদেশে পরিবর্তন, পরিমার্জনসহ কিছু সংযোজনও করা হয়েছে। তার মধ্য দিয়ে এর আইন যুগোপযোগী হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে রফতানি আয়ের ৯০ শতাংশই ছিল পাটের অবদান। বর্তমানে রফতানি খাতে পাটের অবদান ২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে হার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এদিকে সরকারি পাটকলের লোকসানের প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশন নেতারা জানান, সরকার পাট খাতের উন্নয়নে যেসব সুবিধা দিচ্ছে সরকারি পাটকলগুলো তার সুফল পাচ্ছে না। বিভিন্ন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত সরকারি আদেশের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তা ঠেকিয়ে রাখছে। ফলে সরকারি পাটকল শ্রমিকরা দিন দিন উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। বারবার এ সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেয়া হলেও ফল মিলছে না। এমনকি সরকারি পাটকল শ্রমিকদের জমানো গ্রাচ্যুইটির টাকাও খরচ করেছে পাটকল কর্তৃপক্ষ।

অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়, লোকসান দেওয়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ পাটকল সংস্থা (বিজেএমসি)। স্বাধীনতার পর থেকে এই প্রতিষ্ঠানটিও অব্যাহতভাবে লোকসান দিয়ে আসছে। গত বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ৫৩০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

এছাড়া ২০০৬ সাল থেকে টানা লোকসান গুনছে বিআরটিসি। এই প্রতিষ্ঠানটি গেল অর্থবছরে লোকসান গুনেছে ৮৬ কোটি ৯০ লাখ টাকা। একইভাবে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট (বিএফএফডব্লিউটি), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) টানা ১১ বছর ধরে লোকসান গুনছে। গেল অর্থবছরে এই দু’টি প্রতিষ্ঠান লোকসান দিয়েছে ৩৪ কোটি টাকারও বেশি।

চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন

অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, প্রায় প্রতি বছরই মোটা অঙ্কের টাকা লোকসান গুনছে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। বিগত ১৪ বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি। এরমধ্যে গত অর্থবছরেই এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ৪৪০ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

চিনিকলগুলোতে উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিক বেশি পড়ছে। প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে সর্বোচ্চ খরচ পড়ছে ৩শ’ টাকারও বেশি। অথচ প্রতিকেজি চিনি আমদানি করলে খরচ পড়ে মাত্র ৪৮ টাকা। আর অপরিশোধিত চিনি এনে দেশে শোধন করলে প্রতি কেজিতে ৪০ টাকার মতো খরচ পড়ে। এমন পরিস্থিতির কারণে দেশে সরকারি চিনিকল আছে ১৫টি মধ্যে ১৪টি লোকসান গুনছে। বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে চিনির চাহিদা আনুমানিক ১৫ লাখ টন। আর সরকারি ১৫টি চিনি মিলের সক্ষমতা ২ লাখ টন হলেও এবার তার বিপরীতে উত্পাদন করেছে মাত্র ৬৮ হাজার টন। যার মধ্যে বেশিরভাগই অবিক্রিত থাকে। ফলে বাংলাদেশ চিনি শিল্প কর্পোরেশন চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি গতবছর ১ লাখ ৮ হাজার টন চিনি আমদানি করে। যার মধ্যে এখনো ৮৪ হাজার টন অবিক্রিত আছে। প্রতি কেজি চিনির আমদানি খরচ পড়েছে ৪৮ টাকা। আর বেসরকারি কোম্পানীগুলো প্রতিবছর গড়ে ১৪ লাখ টন চিনি অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে। সেগুলো আমদানির পর নিজস্ব মেশিনে পরিশোধন করে সাদা চিনি তৈরি করা হয়।

সূত্র জানায়, কুষ্টিয়া সুগার মিলে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন খরচ ৩৩৪ টাকা। পাবনা সুগার মিলে ওই খরচ প্রায় ৩শ টাকা। তবে কোনো মিলেই উৎপাদন খরচ ১৩০ টাকার কম নয়। অথচ বাজারে প্রতি কেজি চিনির বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০ টাকায়। পাশাপাশি শুধুমাত্র আখের অভাবে বছরের বেশিরভাগ সময় সরকারি চিনি মিলের উৎপাদন বন্ধ থাকছে। ১২ মাসের মধ্যে কুষ্টিয়া সুগার মিল চলে মাত্র ২ মাস। আর আখের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে জয়পুরহাট সুগার মিল। সরকারি চিনিকলগুলো রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ খাদ্য ও চিনি শিল্প কর্পোরেশনের আওতায়।

সূত্র আরো জানায়, দেশে চিনির উৎপাদনের পর আখের উপজাতকে কাজে লাগাতে পারলে সরকারি মিলগুলো লাভজনক হতে পারতো। সরকারি চিনিকলগুলোর মধ্যে একমাত্র লাভের মুখ দেখছে কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে লোকসান করলেও কেরুর ডিস্টিলারি ইউনিটই লাভ করছে। ১৯৩৮ সালের প্রতিষ্ঠিত এই চিনি কলটিতে দেশি মদের পাশাপাশি ৯টি ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ বা ফরেন লিকার তৈরি হয়। আখ থেকে চিনি বের করে নেয়ার পর তিনটি উপজাত থাকে। মোলাসেস বা চিটাগুড়, ব্যাগাস বা ছোবড়া, প্রেসমাড বা গাদ। মোলাসেসই লিকার উৎপাদনের মূল উপকরণ। তাছাড়া ওই চিনিকলে তৈরি হয় দুই ধরণের ভিনেগার, স্পিরিট ও জৈব সার। গত অর্থবছরে কেরু এ্যান্ড কোম্পানী প্রায় ৮ কোটি টাকা লাভ করে। কিন্তু বাকি চিনিকলগুলো বছরের পর বছর লোকসান দিচ্ছে। ওই কলগুলোকে লাভজনক করার জন্য তেমন উদ্যোগ নেই।

এদিকে সরকারি চিনিকলগুলোকে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির আদলে ব্যবহার করার কথা উঠলেও কর্পোরেশনের শীর্ষ কর্তারা তাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। তবে নর্থ বেঙ্গল ও ঠাকুরগাঁও চিনি কলে মদ, বিদ্যুৎ ও জৈব সার তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। ওই দুটি চিনি কলে প্রায় ৮শ কোটি টাকার দুটি প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয়েছে। বর্তমানে চিনিকলগুলো লোকসানে থাকায় কর্মকর্তা কর্মচারি ও শ্রমিকদের ৩/৪ মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। বেতনের বদলে তাদের দেয়া হচ্ছে চিনি। ওই চিনি বিক্রি করেও পুরো বেতন নিতে পারছেন না তারা। পাশাপাশি আখচাষীরা এই কর্পোরেশনের কাছে পাবেন ৩৫০ কোটি টাকা। তার উপরে আছে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক ঋণে বোঝা।

অন্যদিকে আখের বীজ রোপন থেকে শুরু করে কাটা পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ মাস সময় লেগে যায়। সারা বছর ধরে জমিতে একটি ফসলই পড়ে থাকে। অথচ ধান, ডাল ও সবজি চাষে কম সময় নেয়, লাভও বেশি। ওই কারণেই আখ চাষে কৃষকরা আগ্রহ হারাচ্ছে। কিন্তু আখের অভাবে চিনিকল বন্ধ থাকলেও শ্রমিকদের বসিয়ে বসিয়ে সারাবছরের বেতন-ভাতা দিতে হয়। ফলে সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসানের পরিমাণও বাড়ছে।

সরকারি চিনিকলগুলোর লোকসান প্রসঙ্গে কুষ্টিয়া সুগার মিলে জেনারেল ম্যানেজার আবু সায়েম জানান, সুগার মিলগুলোর মেশিন দীর্ঘদিনের পুরনো হওয়ায় উৎপাদন কম। নিয়ম অনুযায়ী ১শ কেজি আখ থেকে সাড়ে ৭ কেজি চিনি পাওয়ার কথা। অথচ দেশের চিনি মিলগুলোতে পাওয়া যায় ৫ কেজিরও কম। পাশাপাশি ঋণের টাকা পরিশোধ করতে গিয়েও লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে। কোন চিনি কলের মোট ব্যয় ৫০ কোটি টাকা হলে সুদ পরিশোধ করতে হয় ২০ কোটি টাকা। ওই কারণে চিনির উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়।

একই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চিনি ডিলার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবলু জানান, প্রশাসনিক অদক্ষতায় চিনি কলগুলোতে লোকসান হয়।

টেলিটকঃ

বেসরকারি কোম্পনীগুলো লাভে থাকলেও লাভের মুখ দেখছে না সরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানি টেলিটক।

মাসের পর মাস টানা সংযোগ কমেই চলেছে টেলিটকের।যেখানে অন্য তিন বেসরকারি অপারেটরের সংযোগ বাড়ছে।সর্বশেষ পাঁচ মাসের হিসাবে দেখা যায়, মে’তে টেলিটকের সংযোগ ছিল ৪৮ লাখ ৭৩ হাজার আর সেপ্টেম্বরে এসে তা আড়াই লাখ কমে হয়েছে ৪৬ লাখ ১২ হাজার। এরমধ্যে জুনে ছিল ৪৭ লাখ ৫৭ হাজার, জুলাইয়ে ৪৬ লাখ ৮১ হাজার ও আগস্টে ৪৬ লাখ ৫৫ হাজার সংযোগ। অন্যদিকে সেপ্টেম্বরে গ্রামীণফোনের রয়েছে ৭ কোটি ৭৫ লাখ ৯২ হাজার সংযোগ, রবির ৫ কোটি ১  লাখ ২৬ হাজার এবং বাংলালিংকের ৩ কোটি ৪৭ লাখ ৭৮  হাজার।আগস্টে দেখা যায় গ্রামীণফোন ৭ কোটি ৭০ লাখ ১১ হাজার, রবি ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮৪ হাজার এবং বাংলালিংকের ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৭৮ হাজার সংযোগ।জুলাইতে গ্রামীণফোন ৭ কোটি ৬০ লাখ ৮৪ হাজার, রবি ৪ কোটি ৯১ লাখ এবং বাংলালিংকের ৩ কোটি ৪৪ লাখ ১৭ হাজার।জুন মাসে গ্রামীণফোন  ৭ কোটি ৪৫ লাখ ৮১ হাজার, রবি ৪ কোটি ৭৯  লাখ ৭৭  হাজার এবং বাংলালিংকের৩ কোটি ৪০ লাখ ৩০ হাজার সংযোগ।আর মে মাসে গ্রামীণফোন ৭ কোটি ৪২ লাখ ৬০ হাজার, রবি ৪ কোটি ৮০ লাখ ৩২ হাজার এবং বাংলালিংক ৩ কোটি ৪৩ লাখ ৪০ হাজার সংযোগে ছিলো।হিসাব বলছে শুধু মে হতে জুন মাসে রবির সংযোগ খানিকটা কমা ছাড়া প্রতি মাসেই বেসরকারি  সব অপারেটরের সংযোগ বেড়েছে।

ডাক বিভাগ:

সরকারের আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ‘নগদ’-এর বিরুদ্ধে গুজব ছড়াচ্ছে একটি স্বার্থান্বেষী সংঘবদ্ধ চক্র। 

নগদ সরকারের ডাক বিভাগের একটি সাবসিডিয়ারি কোম্পানী। নগদ সরকারের বিধিবদ্ধ আইনরীতি বিধি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম রূপকল্পের বাস্তাবায়ন জনগনের হাতে হাতে ডিজিটাল পদ্ধতি’র মাধ্যম আর্থিক লেনদেন পৌঁছে দিয়ে একুশ শতকের মস্তবড় অগ্রগতি সাধন করেছে।

নগদের অগ্রযাত্রা এবং সুনাম ও সাফল্য অকল্পনীয় ভাবে বেড়ে যেতে থাকে। এই ক্রমবর্ধমান বাড়ন্ত গতিকে থামিয়ে দিতে দেশী-বিদেশী একটি সংঘবদ্ধ চক্র উদ্দেশ্যপ্রনোদীত হয়ে নগদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদী কায়দায় মিথ্যা প্রোপাগান্ডা গুজব সহ জনমনে বিভ্রান্তি তৈরী করা হচ্ছে। বিষয়’টি নগদ কর্তৃপক্ষে’র নজরে আসায় আইনী পদক্ষেপের অংশ হিসেবে আদালতে মামলাদায়ের করা হয়েছে। মামলা নং ২৪৯/২১/১৮/০২/২১ সি এম এম আদালত ঢাকা।

মামালার আর্জিতে নগদের পক্ষে বলা হয়েছে, গত ৯/২/২০২১ ইং তারিখে দৈনিক বণিক বার্তা পত্রিকায় নগদ কোম্পানি’র অনুমোদন কার্যক্রম নিয়ে মিথ্যা বানোয়াট ভিত্তিহীন সংবাদ প্রচার করে। নগদ কর্তৃপক্ষ এই সংবাদের প্রতিবাদ করলে পত্রিকাটি প্রতিবাদ প্রাকাশও করে। কিন্তু প্রতিবাদের অংশটুকু বাদ দিয়ে পত্রিকাটি’র মূল প্রতিবেদনটিকে নগদের প্রতিপক্ষ দেশী-বিদেশী চক্র একটি লিফলেট বিতরন করে। লিফলেট এর ধরন ও বিতরনের কৌশল সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গী কায়দায় ব্যবহার করা হয়। এতে নগদের ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুন্ন সহ-আর্থিক সামাজিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বিশেষ করে গ্রাহকদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়।

সরেজমিনে নগদ কর্তৃপক্ষ লিফলেট ও বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ, এমনকি আল জাজিরা’র প্রচারিত ‘অল দ্যা প্রাইম মিনিস্টার ম্যান’ সিনেমার অংশ জুড়ে দেয়া হয়। লিফলেট ও ভিডিও দেশ ব্যাপী-নগদের লাখ লাখ এজেন্টে’র স্থানে বিতরন করা হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জনবহুল স্থানে লিফলেট ছাড়া হয়। অত্যন্ত কৌশলে গোপনীয়তার সঙ্গে জঙ্গিকায়দায় লিফলেট বিতরন করা হয়। নগদ কর্তৃপক্ষ মনে করে এই লিফলেট বিতরণের সঙ্গে জাতীয় আর্ন্তজাতিক ও দেশীয় জঙ্গীগোষ্ঠির সর্ম্পক সহ নগদের প্রতিযোগী অন্য কেউ জড়িত থাকার সম্ভাবনা কম নয়।  বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য আদালতের নির্দেশে তদন্ত দেয়া হয়েছে।

পুলিশে’র ইনভেস্টিগেশন বিভাগ তদন্তে মাঠে নেমেছে। আদালতের বেধে দেয়া সময়ে’র মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার আদেশও রয়েছে। জেএটিভি’র অনুসন্ধানেও নানা ধরণের তথ্য উপাত্ত বেড়ে আসছে। ডিজিটাল মানি ট্রান্সফারের কোম্পানি গুলোর প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্রে করে রাষ্ট্র ও সরকারের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়তে পারে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ সংস্থা ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের খোজখবর নিয়ে তদারকির সময় এসছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করে।

শিপিং করপোরেশন (বিএসসি)

তবে দীর্ঘদিন লাভ করা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন (বিএসসি) গত বছরে ২৭ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। একইভাবে দীর্ঘদিন লাভে থাকা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) লোকসান করেছে। গেল অর্থবছরে এই প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনেছে পাঁচ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।

বিআইডব্লিউটিএ

টানা দুই বছর লাভে থাকা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) গেল বছরে লোকসান গুনেছে। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে ১৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা লোকসান দিয়েছে।

বিসিআইসি

বাংলাদেশ রসায়ন শিল্প সংস্থা (বিসিআইসি) অর্থবছরে লোকসান দিয়েছে ৪৫৫ কোটি টাকারও বেশি। যদিও ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২১৭ কোটি টাকা লাভ করেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। কিন্তু ২০১৪ সালের পরই দুর্নীতি, অনিয়ম ও একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে লাভ কমে নেমে আসে ৯৩ কোটি ৪৪ লাখে। কিন্তু পরের অর্থবছর লোকসান হয় ৭৭ কোটি ৭৯ লাখ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের (এপ্রিল পর্যন্ত) প্রতিষ্ঠানটি লোকসান দিয়েছে ৪৫৫ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

আরডিএ

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) লোকসান দিয়েছে ১৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। একইভাবে দীর্ঘদিন লাভে থাকা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জুট করপোরেশন (বিজেসি) গেল অর্থবছর লোকসান দিয়েছে। এ অর্থবছর প্রতিষ্ঠানটি লোকসান গুনেছে ৫৯ লাখ টাকা।

অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ৪৫টি। এর মধ্যে শিল্প ও বাণিজ্য খাতে নয়টি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সেবায় পাঁচটি, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে সাতটি, কৃষি খাতে দু’টি, নির্মাণ খাতে পাঁচটি ও সেবা খাতে ১৭টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

আগামীনিউজ/প্রভাত