মানব প্রকৃতি সম্পর্কে পবিত্র কোরআন

ঈসমাইল হক মার্চ ২, ২০২৪, ০২:৫৮ পিএম

ঢাকাঃ পবিত্র আল কোরআন আল্লাহ তায়ালার প্রত্যাদেশের দলিল। প্রত্যাদেশগুলোর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মানুষ। মানুষের হেদায়েতের জন্য প্রত্যাদেশগুলো মহান আল্লাহ নবী (সা.)-এর মাধ্যমে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, প্রত্যাদেশগুলোতে আল্লাহ রব্বুল আলামিন মানুষের প্রকৃতি, চরিত্র ও অনেক বৈশিষ্ট্যও বর্ণনা করেছেন।

যুগে যুগে মানুষের আচার-আচরণের সম্যক অবগতি থেকেই আল্লাহ তায়ালা মানবপ্রকৃতির এই বিশিষ্টতার কথা উল্লেখ করেছেন।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, 'আমি তো সৃষ্টি করেছি মানুষকে শ্রেষ্ঠতম অবয়বে' (সুরা তীন : ৪)। এরপর অন্যত্র রয়েছে, 'মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই দুর্বল'। (সুরা নিসা : ২৮)।

আল্লাহ এই মানুষকে 'শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না' (সুরা আলাক : ৫)। কিন্তু মানুষের মন কুচিন্তায় পূর্ণ। আল্লাহ বলছেন 'তার (মানুষের) অন্তরের কুচিন্তা সম্বন্ধে আমি অবহিত' (সুরা কাফ : ১৬)। 'আর আল্লাহ মানুষকে শ্রমনির্ভর করেই সৃষ্টি করেছেন' (সুরা বালাদ : ৪)।

'আল্লাহ চান মানুষ একটু বোঝার চেষ্টা করুক, কী থেকে তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে' (সুরা তারিক : ৫)। অন্যত্র আল্লাহ এর উত্তর দিচ্ছেন 'মানুষ কি দেখে না, আমি তাকে শুক্রবিন্দু থেকে সৃষ্টি করেছি'। (সুরা ইয়াসিন : ৭৭)

অথচ অনেক আশা ও গর্ব করে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছিলেন। ফেরেশতারা আতঙ্কিত হয়ে প্রতিপালককে বলেছিল, 'আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে'? মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কে ফেরেশতাদের এই আশঙ্কা প্রসঙ্গে আল্লাহ ছোট্ট একটি উত্তর দিয়েছিলেন 'আমি যা জানি, তোমরা তা জানো না' (সুরা বাকারা : ৩০)।

এ ব্যাপারে প্রতিপালকের দুটি শর্ত ছিল মানুষের প্রতি।

প্রতিপালক মানুষকে বলেছিলেন, তোমরা ১. আমার এবাদত করবে আর ২. আমার কোনো শরিক করবে না (সুরা নূর : ৫৫)।
এ দুটি বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা খুব স্পর্শকাতর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, 'মানুষের মধ্যে এরপর যারা এসব বিষয়ে অকৃতজ্ঞ হবে, তারা সত্যত্যাগী বলে পরিগণিত হবে' (সুরা নূর : ৫৫)।

মতভেদ করা মানুষের বৈশিষ্ট্য

কিন্তু আল্লাহ জানতেন, মানুষ এসব ব্যাপারে খুব মতভেদ করবে 'তোমার প্রতিপালক ইচ্ছে করলে সব মানুষকে এক জাতি করতে পারতেন; কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে।' (সুরা হুদ : ১১৮)। আর এ জন্য তিনি শেষ পর্যন্ত মানুষকে একটিমাত্র জাতি হিসেবে রাখেননি। যদিও মানুষ ছিল একই জাতি (সুরা মুমিনুন : ৫২, সুরা বাকারা : ২১৩ এবং সুরা আম্বিয়া : ৯২)।

কিন্তু মানুষের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছিল অথবা মানুষই মতভেদ সৃষ্টি করে। (সুরা ইউনূস : ১৯ ও সুরা বাকারা : ২১৩)।

শুধু তাই নয়, 'মানুষ নিজের ধর্মকেও বহুভাগে ভাগ করেছে' (সুরা মুমিনুন : ৫৩)। 'কিন্তু তারা নিজেদের ব্যাপারে বিভেদ সৃষ্টি করল' (সুরা আম্বিয়া : ৯৩)।

তর্কপ্রিয় মানুষ

মানুষ সৃষ্টি করার পর আল্লাহ তায়ালার একটি বড় পর্যবেক্ষণ হলো মানুষ খুব তর্ক করে। অথবা তর্কপ্রবণ এক মাখলুক হলো মানুষ। আল্লাহ খেদের সঙ্গে বলেছেন, 'সে (মানুষ) প্রকাশ্যে তর্ক করে। আমার (আল্লাহর) ক্ষমতা সম্বন্ধে অদ্ভুত কথা বানায়।' (সুরা ইয়াসিন : ৭৮)। অন্যত্র 'তিনি (আল্লাহ) শুক্র থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন অথচ দেখো সে প্রকাশ্যে তর্ক করে' (সুরা নাহল : ৪)। আবার 'মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক করে তাদের না আছে জ্ঞান, না আছে পথের নির্দেশনা'। (সুরা লুকমান : ২০)।

অথবা 'আমি মানুষের জন্য এই কোরআনে বিভিন্ন উপমা দিয়ে আমার বাণী বিশদভাবে বয়ান করেছি। (অথচ) মানুষ (এসব) বেশির ভাগ বিষয়েই তর্ক করে।' (সুরা কাহাফ : ৫৪)।

মানুষ উদাসীন চরিত্রের এবং অজ্ঞতায় পূর্ণ

মানুষের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো মানুষ মহান আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে উদাসীন। বিভিন্ন সময়ে বিপদে-আপদে পরীক্ষায় মানুষের এই উদাসীনতা ধরা পড়ে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের এই উদাসীন চরিত্রের কথাও তুলে ধরেছেন-

* মানুষ সৃষ্টির চেয়ে আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করা তো আরো কঠিন। অবশ্য বেশির ভাগ মানুষ এটা জানে না। (সুরা মুমিন : ৫৭)

* আল্লাহর প্রকৃতির কোনো পরিবর্তন নেই। এ-ই সরল ধর্ম; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। (সুরা রুম : ৩০)

* সার্বভৌমত্ব তাঁরই (আল্লাহরই)। এবাদত করার জন্য তিনি (আল্লাহ) ছাড়া আর কেউ নেই। অতএব তোমরা মুখ ফিরিয়ে কোথায় চলেছ। (সুরা জুমার : ৬)

* মানুষ তো নিজের ওপর বড় জুলুম করে থাকে আর সে বড়ই অজ্ঞ। (সুরা আহজাব : ৭২)।

* '......সব কাজেই আল্লাহর অপ্রতিহত ক্ষমতা কিন্তু অনেক মানুষ তা জানে না'। (সুরা ইউসুফ : ২১)

সীমালঙ্ঘন করা ও বিভ্রান্ত হওয়া মানুষের স্বভাব

আর স্রষ্টা এবং তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে মানুষের উদাসীনতার কারণেই মানুষ বিভ্রান্ত হয়। সেজন্য আল্লাহ জিজ্ঞেস করছেন-

* হে মানুষ! কিসে তোমার মহান প্রতিপালক সম্পর্কে তোমাকে বিভ্রান্ত করে রাখল? (সুরা ইনফিতার : ৬)।

* মানুষ বরাবরই সীমালঙ্ঘন করে। কারণ মানুষ মনে করে, সে অভাবমুক্ত। (সুরা আলাক : ৬-৭)।

সন্দেহবাদী চরিত্রের মানুষ

মানুষের একটা প্রবণতা হলো মানুষ খুব সন্দেহপ্রবণ। সব কিছুতেই তার সন্দেহ সেটা স্রষ্টা কিংবা সৃষ্টি যা-ই হোক, মানুষের সন্দেহবাদী মন মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। আল্লাহ বলছেন,

* তিনিই তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তারপর একটা কাল নির্দিষ্ট করেছেন। আর একটা নির্ধারিত সময়সীমা আছে, যা তিনিই জানেন। তবু তোমরা সন্দেহ করো। (সুরা আনআম : ২)।

* হে মানব জাতি! পুনরুত্থান দিবস সম্পর্কে তোমাদের সন্দেহ! (সুরা হজ্জ : ৫)।

মানুষ খুব অস্থির ও তাড়াহুড়া করে

আল্লাহর দৃষ্টিতে মানুষ স্বভাবগতভাবে অস্থির এবং তাড়াহুড়া খুব পছন্দ করে। এ বিষয়টিও পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বিবৃত করেছেন-

* মানুষ যেভাবে ভালো চায় সেভাবে মন্দও চায়। মানুষ তো খুব দ্রুততা ও তাড়াহুড়াপ্রিয়। (সুরা বনি ইসরাইল : ১১)

* মানুষ তো সৃষ্টিই হয়েছে ভীরুরূপে অথবা স্বভাবগতভাবেই মানুষ অস্থির। (সুরা মা'আরিজ : ১৯)।

মানুষের কৃপণতা ও অপব্যয়ী চরিত্র

মানুষ স্বভাবগতভাবে খুব কৃপণ। মানুষ মনে করে জীবনে যা সে কামাই করেছে, নিজের গুণেই তা সে করতে পেরেছে। ফলে সে খরচ করতে চায় না। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখে। শয়তানও মানুষকে ভবিষ্যতের ভয় দেখায়; ফলে মানুষ সম্পদ জমা করতে থাকে এবং সঞ্চয়ের পাহাড় গড়ে তোলে। আল্লাহ তায়ালা মানুষের এই 'কার্পণ্য' বৈশিষ্ট্যকেও পবিত্র কোরআনে তুলে ধরেছেন :

* মানুষ তো বড়ই কৃপণ। (সুরা বনি ইসরাইল : ১৩০)

* যে অর্থ জমায় এবং বারবার তা গোনে... তাকে ফেলা হবে হুতামায়।... (সুরা হুমাজা : ১০৪)

* ... যে (মানুষ) মুখ ফিরিয়ে নেয় আর দান করে সামান্যই, সে তো পাষাণ হৃদয়ের (মানুষ)। (সুরা নাজম : ৩৩-৩৪)

* যে (সব মানুষ) অপব্যয় করে, তারা তো শয়তানেরই ভাই। ... (কৃপণের) মতো তোমার হাত যেন গলায় বাঁধা না থাকে...। (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৯)

* ... যে (মানুষ) সম্পদ জমা করে এবং আঁকড়ে ধরে রাখবে... জাহান্নাম সে মানুষকে ডাকবে। (সুরা মা'আরিজ : ১৭-১৮)

* মানুষ যে ধন-সম্পদ নিয়ে কৃপণতা করে কেয়ামতের দিন সেই ধন-সম্পদই তার গলার ফাঁস হবে। (সুরা আলে ইমরান : ১৮০)

* যে মানুষ কৃপণতা করে এবং মানুষকে কৃপণতার নির্দেশ দেয় ...তারা জেনে রাখুক আল্লাহ তায়ালা অভাব থেকে মুক্ত। (সুরা হাদিদ : ২৩-২৪)

* যে (সব মানুষ) কৃপণতা করে, তারা আসলে নিজেদের ওপরই কৃপণতা করে। (সুরা মুহাম্মদ : ৩৮)

* (মানুষের মধ্যে) তারাই সফলকাম, যাদের মধ্যে কৃপণতা নেই। (সুরা তাগাবুন : ১৬)

* বুদ্ধিজীবী ও সন্ন্যাসী যারা মানুষের ধন অন্যায়ভাবে ভোগ করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে। সোনা-রুপা জমা করে আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি। (সুরা তওবা : ৩৪)।