দুনিয়ার জীবন ক্ষণিকের

ঈসমাইল হক ফেব্রুয়ারি ২৯, ২০২৪, ০৭:৫৭ পিএম
সংগৃহীত ছবি

ঢাকাঃ দুনিয়া আরবি শব্দ, অর্থ- বিশ্ব, পৃথিবী, জগৎ, ইহকাল, নিকটতর, ন্যূনতম, নিকৃষ্টতর। দুনিয়ার বিপরীত শব্দ আখিরাত। দুনিয়া আখিরাতের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে একে দুনিয়া বলা হয়। মানুষের অবস্থানস্থল চারটি। প্রথমত, মানুষ ছিল রূহের জগতে, যাকে বলা হয় আলমে আরোহা। তারপর মানুষ এসেছে আলমে দুনিয়া বা দুনিয়ার জগতে, তারপর যাবে আলমে বারজাখ বা কবরের জগতে। কবরের জগত থেকে উঠবে আলমে মহশার বা হাশরের ময়দানে। হাশরের ময়দানে হিসাব-নিকাশের পর দুই দলে বিভক্ত হবে। একদল জান্নাতি, আরেক দল জাহান্নামি, মানুষের চারটি অবস্থানস্থলের মধ্যে দুনিয়ার অবস্থান খুবই স্বল্প।

দুনিয়ার জীবন ক্ষণিকেরঃ মানুষ যখন পরকালের কঠিন অবস্থা ও কিয়ামতের বিভীষিকাময় অবস্থা অবলোকন করবে, তখন তাদের অবস্থা প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে দিন তার একে (কিয়ামত ও তার ভয়াবহ অবস্থা) দেখবে, সে দিন মনে হবে যেন তারা দুনিয়াতে মাত্র এক সন্ধ্যা অথবা এক সকাল অবস্থান করেছে’ (সূরা আল-নাজিয়াত-৪৬)। আরো ইরশাদ করেন, ‘তোমার রবের কাছে একদিন (দুনিয়ার) হাজার বছরের সময়, যা মানুষ গণনা করে সেই হিসাবে’ (সূরা আল-হাজ-৪৭) । অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তিনি আসমান থেকে পৃথিবীর দিকে সমস্ত কাজের ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন করেন একদিনে যার পরিমাণ তোমাদের গণনা অনুযায়ী এক হাজার বছর। দুনিয়ার জীবন ৬০, ৭০ বা ৮০ কিংবা ১০০ বছরের মধ্যে সীমিত। কিন্তু রূহের জগত, কবরের জগত ও হাশরের পরবর্তী জগত সীমাহীন। হাশরের মাঠে উলঙ্গ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ৫০ হাজার বছর। পুলসিরাতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ৫০০ বছর।

আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘বস্তুত তোমরা পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দাও, অথচ পরকালের জীবন উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী। এটি লিখিত রয়েছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে, ইবরাহিম ও মূসার কিতাবসমূহে’ (সূরা আল-আলা : ১৬-১৯)। হজরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ রা: বলেন, মানুষের মধ্যে পরকালের উপর ইহকালের প্রাধান্য দেয়ায় প্রবণতা দেখা যায়। কারণ ইহকালের নিয়ামত ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য উপস্থিত এবং পরকালের নিয়ামত ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্য দৃষ্টি থেকে আড়াল ও অনুপস্থিত। ফলে মানুষ উপস্থিতকে অনুপস্থিতের উপর প্রাধান্য দিয়ে বসে, যা তাদের জন্য চিরস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে যায়। মানুষ যে দুনিয়ার জন্য পাগলপারা, প্রথমত- তার বৃহত্তম সুখ ও আনন্দ, দুঃখ, কষ্ট ও পরিশ্রমের মিশ্রণ থেকে মুক্ত নয়। দ্বিতীয়ত- তার কোনো স্থিরতা ও স্থায়িত্ব নেই। আজ যে বাদশাহ কাল সে পথের ভিখারি, আজ যে যুবক ও বীর্যবান, আগামীকাল সে দুর্বল ও অক্ষম। আর তা দিবা-নিশি চোখের সামনে ঘটছে। পক্ষান্তরে, পরকাল এসব দোষত্রুটি থেকে মুক্ত। পরকালের সব নিয়ামত ও সুখ এমন উৎকৃষ্ট যে, দুনিয়ার কোনো নিয়ামত ও সুখের সাথে তার কোনো তুলনা হয় না।

তদুপরি তা চিরস্থায়ী। হজরত আবু জর রা: বলেন, আমি মহানবী সা:-কে হজরত মূসা আ:-এর কিতাবে বর্ণিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে মহানবী সা: বলেন, কতিপয় বিষয় এমন- যে ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি সে ব্যক্তির ব্যাপারে বিস্ময় বোধ করি যে মৃত্যুকে বিশ্বাস করে, অথচ সে আনন্দিত হয়। আমি সে ব্যক্তির ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ করি, যে বিধিলিপি বিশ্বাস করে, অথচ চিন্তামুক্ত থাকে। আমি সে ব্যক্তির ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ করি। যে দুনিয়ার পরিবর্তন ও উত্থাপন-পতন দেখে, অথচ শিক্ষা গ্রহণ করে না, আমি সে ব্যক্তির ব্যাপারে অশ্চর্যবোধ করি, সে পরকালের হিসাব-নিকাশে বিশ্বাসী অথচ এ জন্য কোনো কর্ম করে না’ (হাকেম-৪১৬৬, বায়হাকি-৪/৯, কুরতুবি ২০তম খণ্ড নং ১৯)। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা কি আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে তুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উদাহরণ অতি অল্প’ (সূরা তাওবা-৩৮)। পার্থিব নিয়ামত হলো রমণীকুল, সন্তান-সন্ততি, সোনা-রুপার ভাণ্ডার, উৎকৃষ্ট অশ্ব, পালিত জন্তু, শস্যক্ষেত ইত্যাদি, অথচ এসবের বিপরীতে পরকালে রয়েছে- ১. জান্নাতের সবুজ কানন; ২. পরিচ্ছন্ন সঙ্গিনী; ৩. আল্লাহর সন্তুষ্টি ইত্যাদি।

মহানবী সা: বলেছেন, ‘দুনিয়া অভিশপ্ত এবং এতে যা কিছু আছে তাও অভিশপ্ত।’ তিনি আরো বলেন, ‘দুনিয়াপ্রীতি সব অনিষ্টের মূল’। পার্থিব জীবনের উপমা দিতে গিয়ে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘পার্থিব জীবনের উদাহরণ হলো- যেমন আমি আসমান থেকে পানি বর্ষণ করলাম, পরে তা মিলিত সংমিশ্রিত হয়ে তা থেকে জমিনের শ্যামল উদ্ভিদ বেরিয়ে এলো যা মানুষ ও জীবজন্তুরা খেয়ে থাকে। এমনকি জমিন যখন সৌন্দর্য সুষমায় ভরে উঠল আর জমিনের অধিক তারা ভাবতে লাগল এগুলো আমাদের হাতে আসবে, হঠাৎ করে তার উপর রাতে যা দিলে আমার নির্দেশ এলো, তখন সেগুলোকে কেটে এমন স্তূপাকার করে দিলো, যেন কাল-ও এখানে কোনো আবাদ ছিল না। এমননিভাবে আমি স্পষ্টভাবে নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করে থাকি, ওইসব লোকের জন্য যারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (সূরা ইউনূস-২৪)। আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘তারা পার্থিব জীবনের প্রতি মুগ্ধ। পার্থিব জীবন পরকালের সামনে অতি সামান্য সম্পদ মাত্র’ (সূরা রাদ-২৬)। অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের কী হলো, যখন আল্লাহর পথে বের হওয়ার জন্য বলা হয়, তখন মাটি জড়িয়ে ধরো, তোমরা কি আখিরাতের পরিবর্তে দুনিয়ার জীবনে পরিতুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখিরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবনের উপকরণ অতি অল্প’ (সূরা তাওবা -৩৮)।

দুনিয়া ক্রীড়া-কৌতুকের বিষয় : মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘পার্থিব জীবন ক্রীড়া ও কৌতুক ব্যতীত কিছুই নয়। পরকালের আবাস পরহেজগারদের জন্য শ্রেষ্ঠতর। তোমরা কি বুঝো না’ (সূরা আল-আনয়াম-৩২)? আরো ইরশাদ করেন, ‘তাদেরকে পরিত্যাগ করুন, যারা নিজেদের ধর্মকে ক্রীড়া ও কৌতুকরূপে গ্রহণ করেছে এবং পার্থিব জীবন যাদেরকে ধোঁকায় ফেলে রেখেছে’ (সূরা আল-আনআম-৭০)। আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘এই পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া কিছুই নয়। পরকালের গৃহই প্রকৃত জীবন, যদি তারা জানত’ (সূরা আনকাবুত-৬৪)।

ক্রীড়া-কৌতুকের যেমন- কোনো স্থিতি নেই এবং এর দ্বারা যেমন কোনো বড় সমস্যার সমাধান হয় না, কিছুক্ষণের মধ্যেই সব তামাশা নিঃশেষ হয়ে যায়, পার্থিব জীবনের অবস্থাও অনুরূপ। দুনিয়া ও দুনিয়ার বৈষয়িক ও ধ্বংসশীল কামনা-বাসনার আসক্তি দুনিয়াপ্রেমিককে পরকাল ও পরিণামের চিন্তাভাবনা থেকে বিমুখ করে দেয়। অথচ এ পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক অর্থাৎ সময় ক্ষেপণের বৃত্ত ছাড়া অন্য কিছু নয়। পারলৌকিক জীবনই প্রকৃত ও অক্ষয় জীবন’ (মা’রিফুল কুরআন)। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি সীমানা লঙ্ঘন করে এবং পার্থিব জীবনকে (আখিরাতের ওপর) প্রাধান্য দেয় তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম’ (সূরা আল-নাজিয়াত : ৩৭-৩৯)। দুনিয়া পরিত্যাগকারী বুদ্ধিমান : মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের নফসকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান। আর যে ব্যক্তি নিজেকে কৃপ্রবৃত্তির গোলাম বানায় অথচ আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করে সে ব্যর্থ’ (তিরমিজি)। ইমাম শাফেয়ি র. বলেন, সবচেয়ে জ্ঞানী ওই ব্যক্তি যে দুনিয়াকে পরিত্যাগ করে দুনিয়া তাকে পরিত্যাগ করার আগেই, স্বীয় প্রভুকে সন্তুষ্ট করে তার সাথে সাক্ষাতের আগেই, জামাতে সালাত আদায় করে তার ওপরে জামাতে সালাত তথা জানাজা পড়ার আগেই, নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করে হিসাব দিবসে তার হিসাব গ্রহণ করার আগেই।

দুনিয়া পরীক্ষাগার : দুনিয়া মানুষের জন্য স্থায়ী আবাসন নয়; বরং তা একটি পরীক্ষাগার। পরীক্ষার ফলাফল পরে পাওয়া যায়। তদ্রুপ পার্থিব জীবনের কর্মফল পরকালে পাওয়া যাবে। আল্লাহ তায়ালা- যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন যাতে তোমাদের পরীক্ষা করেন। কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ’ (সূরা মূলক-২)। মহানবী সা: বলেছেন, ‘দুনিয়া আখিরাতের কর্মক্ষেত্র’।

পার্থিব সব কিছু ধ্বংসশীল : দুনিয়ার কোনো কিছু স্থিতিশীল নয় বরং ধ্বংসশীল। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ভূপৃষ্ঠের সব কিছুই ধ্বংসশীল’ (সূরা আর রাহমান-২৬)। আরো ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহর সত্তা ব্যতীত সব কিছু ধ্বংস হবে’ (সূরা আল কাসাস-৮৮)। পক্ষান্তরে, পরকালের সব কিছু স্থায়ী ও স্থিতিশীল। পরকালের কোনো কিছু ধ্বংস হবে না। যারা জান্নাতি হবে তারা চিরকাল জান্নাতে থাকবে। আর যারা জাহান্নামে যাবে তারাও চিরকার জাহান্নামে জ্বলবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘প্রত্যেক আত্মা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে’, এ বাক্যটি চারবার উল্লেখ করেছেন। দুনিয়ার সব কিছু পরিবর্তনশীল। কিন্তু পরকালের কোনো কিছুতে পরিবর্তন হবে না। সেখানে সব কিছুই একই অবস্থায় থাকবে।

মানুষের অবস্থান ধ্বংসশীলদের পৃষ্ঠে : কোনো মানুষ চিরঞ্জীব নয়। তাকে একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে। ধ্বংসশীলদের পৃষ্ঠে মানুষের অবস্থান। হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিব র: বলেছেন ‘হে মানুষেরা, তোমরা কি ভেবে দেখেছ তোমরা ধ্বংসপ্রাপ্তদের ঔরসে জন্মগ্রহণ করেছ এবং তোমাদের পরে আগতরা তোমাদের প্রতিনিধিত্ব করবে।’


লেখক একজন পুলিশ অফিসার