মিষ্টির প্যাকেটে ঘুষের টাকা আনতে বলেন দুদক কর্মকর্তার পিএ

নিজস্ব প্রতিবেদক জুন ২৪, ২০২৩, ০২:২৯ পিএম

ঢাকাঃ ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণের চোরাচালান এবং মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অভিযোগ থেকে রেহাই দিতে ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামানের কাছে কোটি টাকা দাবি করেন দুদক কর্মকর্তার ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) গৌতম ভট্টাচার্য। এর মধ্যে মতিঝিলে হীরাঝিল হোটেলে অগ্রিম কিছু টাকা আনতে বলা হয়। মিষ্টির প্যাকেটে করে আনা দেড় লাখ টাকা নেওয়ার সময় হাতেনাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আটক হন গৌতম ভট্টাচার্য। আটক করা হয় তার সঙ্গে আসা আরও তিনজনকে।

গ্রেফতারদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে শনিবার (২৪ জুন) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। সেখানে এসব তথ্য জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ।

গ্রেফতাররা হলেন- দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার পিএ গৌতম ভট্টাচার্য (৪২), হাবিবুর রহমান (৪২), পরিতোষ মন্ডল (৬৩) ও পুলিশের চাকরিচ্যুত কনস্টেবল মো. এসকেন আলী খান (৫৭)। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে মিষ্টির ৪টি প্যাকেট, নগদ দেড় লাখ টাকা, ৪টি মোবাইল ফোন, দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের একটি খাম ও দুদকের একটি নোটিশ জব্দ করা হয়েছে।

গ্রেফতার গৌতম ভট্টাচার্য দুদকের ডিজি মানি লন্ডারিংয়ের পিএ হিসেবে কর্মরত। তার বাড়ি মৌলভীবাজার। এসকেন আলী খান চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ। অপর দুইজন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা, তারা পেশাগত ভাবে দালাল ও প্রতারক।

পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ভিকটিম আশিকুজ্জামান একজন সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী। বায়তুল মোকাররম মসজিদের কার্পেটের দোকানে ইমপোর্ট করা কার্পেট ও জায়নামাজ সরবরাহ করে থাকেন। গত ২০ জুন আশিকুজ্জামানের উত্তরার বাসায় দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের খামে ১টি নোটিশ নিয়ে একজন কথিত দুদক অফিসার যায়। কথিত চিঠিতে আশিকুজ্জামানের বাসায় অভিযোগ আনা হয় ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণের চোরাচালান ও মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অভিযোগ। এই ভয়ানক অভিযোগ শুনে ঘাবড়ে যান আশিকুজ্জামান।

ভিকটিমের এই ভয়ের সুযোগ নিয়ে কথিত দুদক অফিসার তাকে বলে আপনি মোবাইল ফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে যান। আপনাকে ডিবি, সিআইডি ও দুদকসহ বিভিন্ন সংস্থা গ্রেফতারের জন্য খুঁজছে।

ডিবি প্রধান বলেন, ভিকটিমের বাসায় আসা কথিত দুদক অফিসার আশিকুজ্জামানকে হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের কথিত আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। ওই কথিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভিকটিমকে আরও ভয় পাওয়ানোর জন্য তাকে বলে শূন্য থেকে সে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। দুদকের জিম্মায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সকল প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমতাবস্থায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। ঘাবড়ে যাওয়া আশিকুজ্জামানকে দফায় দফায় ফোন দেওয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপে। ভয় দেখানো হয় সম্পত্তি ক্রোক করা, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের ব্যবস্থা করা, প্রিন্টেড ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে বেইজ্জতি করার।

তিনি আরও বলেন, এক পর্যায়ে দুদকের কথিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আশিকুজ্জামানকে মতিঝিলের হিরাঝিল হোটেলের দ্বিতীয় তলায় এসে সমঝোতার জন্য নির্দেশ দেয়। প্রথমে তার কাছে ৫ কোটি টাকা দাবি করা হয়। পরে সমঝোতা অনুসারে প্রথমে দুই কোটি টাকা দিতে বলা হলেও পরবর্তীতে দিতে বলা হয় এক কোটি টাকা। বিনিময়ে সব অভিযোগ থেকে অব্যাহতির নিশ্চয়তা দেওয়া হয়।

এই কথা অনুযায়ী গত শুক্রবার (২৩ জুন) ভিকটিমকে ২০ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। বাকি টাকা রোববার ব্যাংকের মাধ্যমে চক্রটি দেওয়ার জন্য ভিকটিমকে বলা হয়। এর আগে সন্দেহ হলে ভিকটিম বিষয়টি ডিবি লালবাগ বিভাগকে জানায়। পরে গতকাল ডিবি লালবাগের টিম হোটেল হিরাঝিলের আশপাশে অবস্থান নেয়। সমঝোতা অনুসারে ভিকটিম আশিকুজ্জামান চারটি মিষ্টির প্যাকেটে দেড় লাখ টাকা নিয়ে হোটেল হিরাঝিলে যান। তার কাছ থেকে মিষ্টির প্যাকেটে সংরক্ষিত টাকা গ্রহণের সময় পাশে অবস্থান নেওয়া ডিবি পুলিশ তাদেরকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে।

পিএ গৌতম ভট্টাচার্যের যে ভূমিকা

ডিবি জানায়, গৌতম ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে দুদকের বিভিন্ন মহাপরিচালকদের পিএ হিসেবে কাজ করে আসছে। সে কখনো দুদকের ডিজি (তদন্ত), ডিজি (অ্যাডমিন), ডিজি (প্রসিকিউশন), ডিজি (মানি লন্ডারিং) এর অফিসের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (পিএ) হিসেবে কাজ করছে। গৌতম ভট্টাচার্য কর্ম সূত্রে জানে দুর্নীতি সংক্রান্তে কীভাবে মানুষকে নোটিশ পাঠাতে হয়। এই অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তার সহযোগীদেরকে দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও চাকরিজীবীকে টার্গেট করেন। তাদের ব্যক্তিগত নানা তথ্য সংগ্রহ করে দুদকের চিঠির খাম ও প্যাড/ফরমেট ব্যবহার করে অভিযোগের নোটিশ পাঠাতেন। পরে কখনো মোবাইল হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে, কখনো শিল্পকলা একাডেমির ভেতরে বসে, কখনো আশপাশের বিভিন্ন হোটেলে টার্গেটের টাকায় খেতে খেতে তাদেরকে অভিযোগের দায় হতে অব্যাহতি দান/ সমঝোতার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।

ডিবি প্রধান বলেন, আসলে তারা দুদকের কেউ না। তারা মূলত দালাল চক্র। তাদেরকে হেল্প করতেন গৌতম ভট্টাচার্য ও চাকরিচ্যুত পুলিশ কনস্টেবল এসকেন আলী খান। এই দুজন জানে একটা মানুষকে কীভাবে ডাকতে হবে এবং ডাকার পর তার কাছে কীভাবে টাকা চাওয়া যায়। এই চক্রের সদস্যরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় সক্রিয় রয়েছে। গ্রেফতারদের মধ্যে ৩ জনের বাড়ি গোপালগঞ্জ। তাদের টার্গেট ছিল ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী ও যারা হঠাৎ বড় লোক হয়েছে। তারা দুদকের নামে বেনামি চিঠি দেয়, ভিকটিমদের নামে দুদকের সিল দিয়ে।

এই ঘটনার সঙ্গে দুদকের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা বা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জড়িত রয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ডিবি প্রধান বলেন, এই বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। আসামিদের রিমান্ডে নিলে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ বিষয়ে তথ্য জানার চেষ্টা করব।

গ্রেফতারদের মাধ্যমে এ পর্যন্ত কতজন মানুষ প্রতারিত হয়েছে- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এ বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত শেষে বলা যাবে।

বুইউ