মালদ্বীপের মুইজ্জুতে বেকায়দায় ভারত

আন্তর্জাতিক ডেস্ক অক্টোবর ৬, ২০২৩, ১২:৪৮ পিএম

ঢাকাঃ চীনপন্থি হিসেবেই বরাবর পরিচিত মালদ্বীপের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু। নির্বাচনে তার জয় নয়াদিল্লির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। মুইজ্জুর হাত ধরে এখন দেশটির ওপর চীনের প্রভাব বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। 

ছোট্ট মালদ্বীপ নিয়ে ভারত ও চীনের প্রচ্ছন্ন শক্তির লড়াই চলছে বহু দিন ধরেই। এদিকে নির্বাচিত হওয়ার পর এক সপ্তাহ না যেতেই মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সেনা অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন মুইজ্জু।   

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য বলছে, মালদ্বীপের নতুন সরকারের সঙ্গে প্রতিটি ইস্যুতে কথা বলতে আগ্রহী তারা। 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী মালদ্বীপের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর বক্তব্যের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এ কথা বলেন।

মালদ্বীপে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার মুনু মাহাওয়ার বুধবার সন্ধ্যায়  মোহাম্মদ মুইজ্জুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অভিনন্দন বার্তা পৌঁছে দেন। 

অরিন্দম বাগচী বলেন, মালেতে আমাদের হাইকমিশনার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। অনেক বিষয় নিয়ে দুজনের মধ্যে ভালো আলোচনা হয়েছে। 

তবে মোহাম্মদ মুইজ্জুর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে কে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করবেন তা জানায়নি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

২০১৮ সালে নরেন্দ্র মোদি ইব্রাহিম সোলিহর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। 

গত সপ্তাহে মালের মেয়র মোহাম্মদ মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম সোলিহকে ১৯ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন। দুজনের মধ্যে পরাজয়ের ব্যবধান ছিল আট শতাংশ ভোট। মালদ্বীপের এই নির্বাচনের ফলাফল ভারতের বিপক্ষে এবং চীনের পক্ষে গেছে। ইব্রাহিম সোলিহ সরকারের সঙ্গে ভারতের সহযোগিতা ছিল গভীর। তাকে মালদ্বীপের এমন একজন প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখা হতো যিনি কখনও ভারতের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাননি। .

মুইজ্জুর নির্বাচনী প্রচারণাতেও ভারত একটি প্রধান ইস্যু ছিল। তিনি ‘ইন্ডিয়া আউট’ ক্যাম্পেইনও চালান। মুইজ্জু বলেন, তার সরকার মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বের সঙ্গে আপস করবে না এবং কোনো দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে না।

মঙ্গলবার মালদ্বীপের গণমাধ্যমের শিরোনামে ছিল মুইজ্জুর আরেকটি বক্তব্য। তিনি বলেন, জনগণ চায় না মালদ্বীপে ভারতীয় সৈন্য থাকুক। বিদেশি সৈন্যদের মালদ্বীপের ভূখণ্ড ত্যাগ করতে হবে।

ভারত মহাসাগরে ভারতের সামরিক উপস্থিতি নতুন কিছু নয়। আবদু এবং লামমু দ্বীপপুঞ্জ ২০১৩ সাল থেকে ভারতীয় নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর সদস্যদের আবাসস্থল। ২০২১ সালের নভেম্বরে মালদ্বীপের জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী একটি সংসদীয় কমিটিকে জানায় যে মালদ্বীপে মোট ৭৫ জন ভারতীয় সেনা উপস্থিত রয়েছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মালদ্বীপের বিরোধী দলগুলো ভারতের সাথে সামুদ্রিক নিরাপত্তা চুক্তির বিরোধিতা করেছিল।

ভারত মালদ্বীপকে দুটি হেলিকপ্টার দিয়েছিল, এ নিয়েও বিতর্ক ছিল। ২০১৮ সালে আবদুল্লাহ ইয়ামিনের সরকার ভারতের উপহার দেওয়া নৌবাহিনীর দুটি হেলিকপ্টার ফিরিয়ে নিতে বলেছিল। ত্রাণ ও উদ্ধার কাজের জন্য মালদ্বীপকে এই হেলিকপ্টারগুলো দিয়েছিল ভারত।

মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে বলে মোহম্মদ মুইজ্জুর বক্তব্যের বিষয়ে অরিন্দম বাগচী স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। তিনি বলেন, মালদ্বীপের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্বের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে অভিন্ন চ্যালেঞ্জ ও অগ্রাধিকার। প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের একসঙ্গে কাজ করা জরুরি।

মালদ্বীপে ভারত
ভারতীয় চলচ্চিত্র, ফ্যাশন, খাবার সবকিছুরই সরব উপস্থিতি রয়েছে মালদ্বীপে। ভারতের তিরুবন্তপুরম শহরটি মালে শহরের খুব কাছেই অবস্থিত। মালদ্বীপের হাজার হাজার মানুষ প্রতি বছর ভারতে আসেন। বিশেষ করে চিকিৎসার জন্য ভারত তাদের সবচেয়ে পছন্দের গন্তব্য। 

এই ছোট্ট দ্বীপের নিরাপত্তায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৮৮ সালে রাজীব গান্ধী সেনাবাহিনী পাঠিয়ে মামুন আবদুল গাইয়ুমের সরকারকে বাঁচিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে মালদ্বীপের মানুষ যখন পানীয় জলের সমস্যায় ভুগছিলেন, তখন নরেন্দ্র মোদি পানি পাঠিয়েছিলেন। এর পর মালদ্বীপকে অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের করে আনতে বহুবার ঋণও দিয়েছে মোদি সরকার।

তিক্ততার সূত্রপাত 
ভারত ও মালদ্বীপের সম্পর্ক ২০১৮ সালে সবচেয়ে তিক্ত ছিল। ২০১৮ সালে মালদ্বীপের সুপ্রিম কোর্টের ১ ফেব্রুয়ারির রায় দিয়ে এটি শুরু হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছিল যে প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন বিরোধী নেতাদের কারারুদ্ধ করে সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম লঙ্ঘন করেছেন।

একই সঙ্গে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদসহ সব বিরোধী নেতাকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানান।

এর সঙ্গে সঙ্গে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন ইয়ামিন। এই জরুরি অবস্থা ৪৫ দিন স্থায়ী হয়। ভারত এই জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করেছিল। ভারত বলেছিল যে মালদ্বীপের সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পুনরুদ্ধার করা উচিত এবং জরুরি অবস্থা অবিলম্বে শেষ করা উচিত।

মালদ্বীপের নাটকীয় রাজনৈতিক সংকট ভারত ও চীন উভয়ের জন্যই বিরক্তিকর ছিল। এই সংকটের মধ্যেই চীন, পাকিস্তান ও সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত পাঠান ইয়ামিন। এর পর চীন সতর্ক করে দিয়ে বলে— মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো দেশ যেন হস্তক্ষেপ না করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ ব্যাপারে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।

চীন বলেছে, কোনো অবস্থাতেই মালদ্বীপের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হবে না। অন্যদিকে, মালদ্বীপের বিরোধী দলীয় নেতা নাশিদ ভারতের সাহায্য চেয়েছিলেন।

তিনি ভারতের কাছ থেকে সামরিক হস্তক্ষেপও আশা করেছিলেন যাতে বিচারকদের আটক থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। নাশিদ আমেরিকার কাছেও সাহায্যের আবেদন করেছিলেন।

এই অচলাবস্থার মধ্যেই পূর্ব ভারত মহাসাগরে ১১টি যুদ্ধজাহাজ পাঠায় চীন। যদিও ভারত মহাসাগরে চীনা যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন নতুন কিছু নয়। জিবুতিতে চীনের একটি সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে।

মালদ্বীপ চীনের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। মালদ্বীপ যে সমুদ্রের উচ্চতায় কৌশলগতভাবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মালদ্বীপে চীনের উপস্থিতি ভারত মহাসাগরে চীনের কৌশলের অংশ। ২০১৬ সালে মাত্র ৪০ লাখ ডলারে চীনের একটি কোম্পানিকে ৫০ বছরের জন্য ইজারা দেয় মালদ্বীপ।

অন্যদিকে ভারতের কাছেও মালদ্বীপ কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। মালদ্বীপ ভারতের খুব কাছাকাছি এবং সেখানে চীনের ‘পা’ রয়েছে, তাই ভারতের উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। মালদ্বীপ ভারতের লাক্ষাদ্বীপ থেকে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার এবং ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে ১২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।

মালদ্বীপ চীন ও পাকিস্তানের উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোডকে প্রকাশ্যে সমর্থন করছে। ভারত যদি মালদ্বীপ থেকে দূরে থাকে, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট ছোট দেশগুলোতে চীনের প্রভাব বাড়বে।


এমআইসি