অনিশ্চয়তায় কাটছে শিক্ষার্থীদের দিন

নিজস্ব প্রতিবেদক অক্টোবর ২৭, ২০২০, ০৭:০৬ পিএম
ছবি সংগৃহীত

ঢাকাঃ করোনায় থমকে আছে শিক্ষা ব্যবস্থা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই স্থবিরতায় চালিয়ে নিচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাস হলেও পরীক্ষা হচ্ছে না। সেই সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরা কয়েকটি পরীক্ষা না দিতে পারায় কোনো চাকরির জন্য আবেদন করতে পারছেন না। সেইসঙ্গে দেখা দিয়েছে সেশনজটের শঙ্কা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাতিল হয়েছিলো দুটি বোর্ড পরীক্ষা। সে সময় এটি ছিল আলোচিত বিষয়। এরপর দীর্ঘ সময় পর করোনায় বাতিল করা হলো বোর্ড পরীক্ষা।

পিইসি, জেএসসি বাতিলের পর এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষাও বাতিল করে সরকার। এবং সর্বশেষ গত ২১শে অক্টোবর মাধ্যমিকের বার্ষিক পরীক্ষা না নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এমন পরিস্থিতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীদের নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ছে এটা অনুমেয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সেদিন বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো পরিস্থিতি এখনো সৃষ্টি হয়নি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি ১৭ই মার্চ শুরু হয়ে কয়েকদফায় বাড়িয়ে তা আগামী (৩১শে অক্টোবর) পর্যন্ত করা হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম আল হোসেন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার মতো পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। তাই নতুন করে আরো ছুটি বাড়াতে হবে। আগামী (২৯শে অক্টোবর) এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়তে পারে, তবে কতদিন বাড়বে তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কয়েকদিনের মধ্যেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেয়া হবে।

উচ্চ শিক্ষায় সর্বাধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদিকে, যারা স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে শেষ বর্ষে ছিল অথবা যারা শেষ বর্ষে পদার্পণ করেছেন তাদের অভিযোগ, তারা শুধুমাত্র কয়েকটি পরীক্ষা বাদ থাকার কারণে, সার্টিফিকেট নিতে পারছে না। তাদের জুনিয়র ব্যাচদের ঠিকই ক্লাস হচ্ছে, ক্যাম্পাস খুললে পরীক্ষা দিতে পারবে। এর ফলে, সিনিয়র ব্যাচ ও জুনিয়র ব্যাচগুলোর মধ্যে খুব একটা পার্থক্য থাকবে না। পাশাপাশি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পরীক্ষা না হলেও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা হচ্ছে। এর ফলে, বিশাল একটা ব্যবধানের তৈরি হতে পারে। রয়েছে সেশনজটের শঙ্কাও। এই পরিস্থিতিতে এসব শিক্ষার্থীদের হতাশা বেড়েছে কয়েকগুণ। তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটছে।

জানা যায়, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের পাঁচটি পরীক্ষা হয়েছে, বাকি আছে চারটি বিষয়ে। মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের তিনটি করে পরীক্ষা বাকি হয়েছে। সকলের সাক্ষাৎকার ও ব্যবহারিক পরীক্ষা বাকি আছে। সমপ্রতি বিগত পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে চূড়ান্ত পরীক্ষার ফল প্রকাশের দাবিতে এবং ‘অটোপাস’ চেয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধনও করেন। সেইসঙ্গে করেন সড়ক অবরোধ।

এ মানববন্ধনে অংশ নেয়া চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, আমাদের দাবি একটাই কলেজ বন্ধ হওয়ার আগে চতুর্থ বর্ষের অনুষ্ঠিত ৫টি বিষয়ের পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করে বাকি বিষয়ের ইনকোর্স পরীক্ষার নম্বর মূল্যায়ন করে ফল প্রকাশ করা হোক।
আরেক শিক্ষার্থী রাকিব হাসান বলেন, আন্দোলনে মৌখিক ও বিজ্ঞান বিষয়ের ব্যবহারিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও গড় পদ্ধতি অনুসরণ করে সর্বোচ্চ ৩০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছি আমরা। তিনি আরো বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অনিশ্চয়তার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট নিরসন ও শিক্ষার্থীদের চাকরির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার লক্ষ্যে বিশেষ সুযোগ সৃষ্টির জন্য পরীক্ষা না নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থায় ফলাফল দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা।

দিনাজপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদৌস শান্তা বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর (ভিসি) স্যার এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর আমাদের পরীক্ষার ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত জানাবেন বলছেন। সমপ্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরীক্ষাবিহীন এইচএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের ফল প্রকাশের ব্যাপারে অদ্যাবধি কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। এতে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি।

ঢাকার মোহাম্মদপুরের আলহাজ মকবুল হোসেন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. লামিউল ইসলাম জানান, বাকি পরীক্ষা নেয়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি এবং অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আগের পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণপূর্বক অটোপাস দিয়ে দ্রুত ফল প্রকাশ করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।

ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. রবিউল ইসলাম নিরব বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি স্যারের কাছে স্মারকলিপি দেই। এই বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তের কথা না জানানোয় গত সোমবার দেশের বিভিন্ন কলেজ থেকে শিক্ষার্থীরা এ মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেন।
জামালপুরের মাহমুদা সালাম মহিলা কলেজের ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষার্থী খুশবু রহমান নিশি ইনকোর্স পরীক্ষার নম্বর যোগ দিয়ে তাদের ফল প্রকাশের দাবি জানান।

শুধু চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীরাই নয়। অভিযোগের কথা জানান, অন্যান্য বর্ষের শিক্ষার্থীরাও। তারা বলছেন কোনো রকম ক্লাস চললেও নেই কোনো পরীক্ষা। কারমাইকেল কলেজ, রংপুরের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শাকিল চৌধুরী বলেন, আমাদের ক্লাস নিয়মিতই হচ্ছে। তবে জুম কিংবা অনলাইনে ফেস টু ফেস পরীক্ষা নেয়া হলে হয়তো কিছুটা উপকার হতো। আর ক্লাসে কোনো এটেনডেন্স নেই। কোনো অ্যাসাইন্টমেন্ট নেই।

সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুরের শিক্ষার্থী তাসনুভা তন্নি বলেন, এই ক্লাসে যদি উপস্থিতির বিষয় থাকতো তাহলেও একটা বিষয় থাকতো। যেহেতু উপস্থিতির কোনো বিষয় নেই সেহেতু তার ক্লাসের মান নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। তাই এটা একটা প্রসেস মাত্র।

চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেন, আপনি হাফওয়েতে এসে যদি আপনি বলেন পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হোক তবে অসম্পূর্ণ পরীক্ষা হবে। এই ফলাফল নিয়ে আপনি না পারবেন বিদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে। না পারবেন চাকরির জন্য এপ্লাই করতে। কারণ তারা জানবে আপনি সকল কোর্স সম্পন্ন করে আসেন নাই। এটা শিক্ষার্থীদের জন্য হিতে বিপরীত হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একসময় সেশনজট ভয়াবহ ছিল। চার বছরের অনার্স কোর্স সাত বছর লাগতো। কিন্তু এখন তা লাগছে না। করোনা না হলে ২০১৯ সালের পরীক্ষা ২০১৯ সালেই হতো। করোনা পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক হয় তবে এই সমস্যা সমাধানে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা তিন মাসের মধ্যে ফলাফল দেবো। শুধু সনদ দিয়ে কি হবে? যদি মানসম্মত শিক্ষা হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকী বলেন, অটোপাসের বিষয়ে ভাবতে হবে। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এক্ষেত্রে ইউজিসি বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কারণ কোন্‌ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেমন তা সেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই বলতে পারবেন। আর এ সময়টা যেহেতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমার মনে হয় না অটোপাস না দেয়াই ভালো।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)’র সদস্য অধ্যাপক দিল আফরোজা বেগম বলেন, কোনো অবস্থাতেই অটোপাস সম্ভব না। আমরা এখনো এ বিষয়ে ভাবছি না। শিক্ষার্থীদের উচিত যথাযথভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া।

আগামীনিউজ/জেহিন