Dr. Neem on Daraz
Victory Day

ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের উজ্জল জ্যোতিষ্ক সুভাষ বোস


আগামী নিউজ | প্রভাত আহমেদ প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৪, ২০২১, ০৬:২৪ পিএম
ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনের উজ্জল জ্যোতিষ্ক সুভাষ বোস

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন সমগ্র বাংলা তথা বাঙালীর গর্ব, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।  ভারতের স্বাধীন হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান আমাদের কারোরই ভোলার নয়। তিনি দেশের জন্য যা করে গেছেন, তা হয়তো অনেক রাজনৈতিক নেতারাও করেননি জীবনে ।

নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম হয় ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী, বর্তমান ওড়িশার কটক শহরে।  তাঁর বাবার নাম ছিলো শ্রী জানকীনাথ বসু, যিনি কিনা সেইসময়ের কটক শহরের একজন বিখ্যাত আইনজীবী ছিলেন এবং মা ছিলেন শ্রীমতী প্রভাবতী দেবী।

তুমি কি জানো, তিনি কিন্তু ছিলেন তাঁর বাবা মায়ের চোদ্দ সন্তানের মধ্যে নবমতম সন্তান | তাঁর মেজদা ছিলেন শরৎচন্দ্র বসু, যিনি তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এবং ছোট্ট নেতাজীরও খুব কাছের মানুষ ছিলেন তিনি ।

নেতাজীর মধ্যে এই দেশপ্রেম ব্যাপারটা জাগে তাঁর বাবার হাত ধরেই। যদিও তাঁর বাবা একজন ব্রিটিশ শাসিত সরকারী অফিসে কর্মরত ছিলেন, তবুও তিনি তৎকালীন কংগ্রেসের সমস্ত অধিবেশনে যোগদান করতেন এবং সাধারণ মানুষের খুব সেবা করতেন।  তিনি স্বদেশী এবং জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির পক্ষপাতী ছিলেন।

ছোটবেলা থেকেই সুভাষচন্দ্র, পড়াশোনার বিষয়ে ভীষন মনোযোগী ছিলেন, আর তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কটকের এক প্রোটেস্ট্যান্ড ইউরোপীয় স্কুল থেকে। এরপর ১৯০৯ সালে তিনি সেখান থেকে ভর্তি হন কটকের রাভেনশো কলেজিয়েট স্কুলে।

স্কুলে পড়ার সময়, তিনি সেই স্কুলের প্রিন্সিপাল বেনিমধাব দাসের ব্যক্তিত্বের উপর বিশেষভাবে প্রভাবিত হন এবং তাঁরই সহযোগীতায় ছোট্ট সুভাষ, স্বামী বিবেকানন্দের বই পড়তে আগ্রহী হয়েও পরেন।

সুভাষচন্দ্র বোস অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁর লেখায় এটা উল্লেখ করেছিলেন যে, স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও লেখা বই তাঁকে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীতে পরিণত করেছিলো | স্বামীজির লেখা বই পড়েই তিনি তাঁর জীবনের আসল উদ্দেশ্য খুঁজে পান।

সাল ১৯১১, যখন নেতাজী ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতায় প্রথমস্থান অধিকার করেন । এরপর তিনি ১৯১১ সালে ভর্তি হন কোলকাতার প্রেসিডেন্সিতে, কিন্তু সেখানে শিক্ষক ও ছাত্রদের মধ্যে ভারত বিরোধী মত পার্থক্যর জন্য ভীষন সংঘাত শুরু হয়।

সেই সংঘাতে, যেহেতু সুভাষচন্দ্র ভারতীয় ছাত্রদের পক্ষে ছিলেন তাই তাঁকে এক বছরের জন্য কলেজ থেকে বহিস্কার করে দেওয়া হয় এবং পরীক্ষা দেওয়ারও অনুমতি দেওয়া হয়না। তারপর ১৯১৮ সালে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে, দর্শনে সাম্মানিক সহ বি.এ পরীক্ষায় পাশ করেন তিনি।

কোলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে সুভাষচন্দ্র বসু, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ফিজউইলিয়াম কলেজে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন । সেখানে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান, কিন্তু বিপ্লব সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি হওয়ার জন্য সেই নিয়োগও প্রত্যাখ্যান করেন।

চাকরি প্রত্যাখ্যান করার পর তিনি আবার ইংল্যান্ড ছেড়ে ভারতে চলে আসেন এবং এখানে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন | সেই দলে ঢোকার তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো, ভারতকে যেভাবেই হোক ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীন করে তোলা।

১৩ই এপ্রিল ১৯১৯, যখন অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ড ও দমনমূলক রাওলাট আইন সমস্ত ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে । এইরুপ বিশৃঙ্খলার পর, নেতাজী ‘স্বরাজ  নামক একটি খবরের কাগজের হয়ে লেখালেখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্বে নিযুক্ত হন।

এরপর চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৪ সালে যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র হন, সেইসময় সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর অধীনে কাজ করতেন। চিত্তরঞ্জন দাশই ছিলেন তাঁর রাজনৈতিক গুরু, কারণ তাঁর কাছ থেকেই সুভাষচন্দ্রের রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়।

তার ঠিক পরের বছর অর্থ্যাৎ ১৯২৫ সালে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দি করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয় । সেখানে থাকাকালীন তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্তও হয়েছিলেন | জানা যায়, তিনি তাঁর ২০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে, প্রায় ১১ বার গ্রেফতার হন ব্রিটিশদের হাতে।

সুভাষচন্দ্র বোসের হৃদয় জাতীয়তাবাদের ধারায় ভরা ছিল, তাই স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য তাঁর ভীতর জাতীয়তাবাদী মনোভাব, ব্রিটিশদের কাছে খুব ভালো খবর ছিলোনা | তাই তাঁরা প্রত্যেকে সুভাষচন্দ্রের প্রতি সর্বদা সতর্ক থাকতেন।

সাল ১৯৩০, যখন সুভাষকে সমগ্র ইউরোপ থেকে নির্বাসিত করা হয়, কিন্তু তবুও তিনি বাকি অন্যান্য দেশে থেকে নিজের দেশকে স্বাধীন করার কাজে তখনও লিপ্ত থাকেন| পরে, তিনি একবার নিজের দেশেও ফিরেছিলেন শুধুমাত্র তাঁর বাবার অন্ত্যোষ্টি ক্রিয়া করার জন্য। তারপর আবার তিনি আত্মগোপন করেন।  তারপর ১৯৩৮ সালে তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন আর ১৯৩৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বারের জন্য ত্রিপুরা অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন।

সুভাষচন্দ্র বসু এই নির্বাচনে জয়লাভ করলেও গান্ধীজির বিরোধিতার ফলস্বরূপ তাকে বলা হয় পদত্যাগ পত্র পেশ করতে;  নাহলে কার্যনির্বাহী কমিটির সব সদস্য পদত্যাগ করবে। এইসব নানা কারণে তিনি অবশেষে নিজেই কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেণ এবং “ফরওয়ার্ড ব্লক” নামক একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন।

কিন্তু সেইসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় আর সেই যুদ্ধে ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয় | ভারতবর্ষের এইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার ব্যাপারে সুভাষচন্দ্র বসু ভীষনভাবে ব্যথিত হন।  তিনি সেই সময় গৃহবন্দি ছিলেন কিন্তু মনে মনে তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন দেশত্যাগ করার।

অবশেষে তাঁর দলের একজন সদস্যকে নিয়ে তিনি, আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে গিয়ে তিনি প্রথমে বার্লিনে “ভারতীয় মুক্ত কেন্দ্র”গড়ে তোলেন, আর তারপর ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি জার্মান নেতা এডলফ হিটলারের সাহায্য চান।

 কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সাহায্যের ব্যাপারে এডলফ হিটলারের কোনো ইচ্ছা না থাকায়, তিনি তা বুঝতে পেরে খুব দুঃখ পান। এরপর ১৯৪৩ সালে তিনি অবশেষে জার্মানি ত্যাগ করেন এবং একটি সাবমেরিনে চেপে পোঁছে যান জাপানে, হিদেকি তোজোর সাহায্যের আশায়।

সেইসময় জাপানে রাসবিহারি বসু গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী | ১৯৪৩ সালে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে তিনি সেই বাহিনীর দায়িত্ব তুলে দেন। নারী-পুরুষ মিলিয়ে এই বাহিনীতে মোট সৈন্য সংখ্যা ছিলো প্রায় ৮৫০০০ মতো। পরে অবশ্য এই বাহিনীর নাম বদলে “আজাদ হিন্দ” করে দেওয়া হয়।

সুভাষ চন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর তাঁর সৈন্যবাহিনীর হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে সেখানে যোগ দেবে কিন্তু তা একদমই হয়নি। কারণ খুব সংখ্যক ভারতীয় সেনা সেই হামলার পর তাঁর বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে যখন জাপান আত্মসমর্পণ করে আমেরিকার কাছে, তখন সেইসাথে তাঁর জাতীয় সেনাবাহিনীও আত্মসমর্পণ করে নেয়।

জাপানের এই ঘোরতর দূর্দশার পর নেতাজী, ১৮ই আগস্ট ১৯৪৫ সালে জাপানের তাইহুকু বিমানবন্দর থেকে প্লেনে করে যাওয়ার সময় দুর্ঘটনার কবলে পরেন এবং সেইসাথে মারা যান। যদিও তাঁর এই মৃত্যুর সত্যতা সম্পর্কে আজও মানুষ অজানা। কেউ ঠিক ভাবে জানেন না যে, সেই দিনটির পর নেতাজীর কি হলো।

অনেক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই ঘটনা একদম ভুয়ো।  নেতাজীর জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে উঁচুতলার কিছু ভারতীয় নেতারা এবং ইংরেজ সরকার মিলিতভাবে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে হত্যা করেন নৃশংস ভাবে।

যদিও এই তথ্যের পিছনে কতটা সত্যতা আছে, তাও আমাদের কাছে এক রহস্যের সমান। কিন্তু নেতাজী যা করে গেছেন আমাদের ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য, তা আমরা কখনই ভুলতে পারবোনা।  তাঁর অবদান প্রত্যেকটা ভারতবাসী চিরকাল মনে রাখবে। তিনি সর্বদা আমাদের মধ্যে অমর হয়ে আছেন এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছেও অমর হয়েই থাকবেন।

শাহনওয়াজ কমিশনে (বিমান দুর্ঘটনায় মি. বসুর মৃত্যু হয়েছিল কিনা সেটা খতিয়ে দেখতে ভারতের গঠিত প্রথম সরকারি কমিটি) দেওয়া সাক্ষ্যে কর্নেল হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, "বিমান তখনও বেশি উপরে ওঠে নি। বিমানঘাঁটির চৌহদ্দির মধ্যেই ছিল। সেই সময়েই বিমানের সামনের দিকে একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পাই। পরে জেনেছিলাম বিমানের একটা প্রোপেলার ভেঙ্গে নীচে পড়ে গেছে। বিমানটা নীচে পড়ে যেতেই সামনের দিকে আর পেছনের দিকে আগুন লেগে গিয়েছিল।"

"বিমান ভেঙ্গে পড়তেই নেতাজী আমার দিকে তাকিয়েছিলেন। আমি তাকে বলেছিলাম, সামনের দিক দিয়ে বের হওয়ার জন্য। পেছনের দিকে যাওয়ার জায়গা নেই। সামনের দিকেও আগুন জ্বলছিল। তার মধ্যে দিয়েই তিনি বাইরে বেরিয়ে যান। কিন্তু তিনি যেখানে বসেছিলেন, তার সামনে রাখা পেট্রল ভর্তি জেরিক্যান থেকে তেল বেরিয়ে তার কোট পুরো ভিজে গিয়েছিল," শাহনওয়াজ কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে জানিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কর্নেল হাবিবুর রহমান।

তিনি আরও বলেছিলেন, "আমি বাইরে এসেই দেখি নেতাজী ১০ মিটার দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। পশ্চিমের দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। ততক্ষণে তার পোশাকে আগুন লেগে গেছে। আমি তার দিকে দৌড়ে গিয়ে অনেক চেষ্টার পরে তার 'বুশর্ট বেল্ট'টা খুলতে পারলাম। তারপরে তাকে মাটিতে শুইয়ে দিই আমি। তার মাথার বাঁদিকে প্রায় ৪ ইঞ্চি লম্বা একটা গভীর ক্ষত।"

"একটা রুমাল দিয়ে ওই ক্ষত থেকে রক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করছিলাম। তখনই নেতাজী আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, 'তোমার বেশি চোট লাগে নি তো?' বলেছিলাম যে আমি ঠিক আছি," জানিয়েছিলেন কর্নেল রহমান।

"উনি বলেছিলেন মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচব না। আমি ভরসা দিয়েছিলাম, 'আল্লাহ আপনাকে বাঁচাবে'। তিনি বলেছিলেন, 'আমার মনে হচ্ছে না। দেশে ফিরে গিয়ে সবাইকে জানিও যে আমি শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলাম। তারা যেন এই লড়াই জারি রাখে। ভারত নিশ্চয়ই স্বাধীন হবে," এভাবেই সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছিলেন তিনি।

দশ মিনিটের মধ্যেই উদ্ধারকারী দল বিমানঘাঁটিতে পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনও অ্যাম্বুলেন্স ছিল না। তাই সুভাষচন্দ্র আর বাকি আহতদের সেনাবাহিনীর একটা ট্রাকে করেই তাইহোকু সামরিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মি. বসুকে প্রথম যে চিকিৎসক পরীক্ষা করেছিলেন, তার নাম ছিল ডাক্তার তানইয়াশি ইয়োশিমি।

১৯৪৬ সালে হংকং এর এক কারাগারে ব্রিটিশ কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন অ্যালফ্রেড টার্নারের জেরার জবাবে ডাক্তার ইয়োশিমি বলেছিলেন, "গোড়ায় সব আহতদের একটা বড় ঘরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরে মি. বোস আর মি. রহমানকে একটা অন্য ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। দুর্ঘটনায় আহত অন্য জাপানি সৈনিকরা ব্যথায় চিৎকার করছিল তখন। তাই ওদের দু'জনকে আলাদা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।"

ডাক্তার ইয়োশিমি জানিয়েছিলেন, "মি. বসুর ভীষণ জলপিপাসা পেয়েছিল। তিনি জাপানি ভাষাতেই জল চাইছিলেন বার বার - মিজু, মিজু করে। সেখানে যে নার্স ছিলেন, আমি তাঁকে বলি একটু জল দিতে।"

সুভাষচন্দ্রের আঘাতের বর্ণনা করতে গিয়ে ডাক্তার ইয়োশিমি বলেছিলেন, "তিনটের সময়ে এক ভারী চেহারার মানুষকে সেনাবাহিনীর ট্রাক থেকে নামিয়ে স্ট্রেচারে করে নিয়ে আসা হয়। তার মাথা, বুক, পিঠ, হাত, পা, এমনকি তার হৃদযন্ত্রও - সব সাংঘাতিকভাবে পুড়ে গিয়েছিল।"

ডাক্তার ইয়োশিমির বর্ণনায়, "তার চোখগুলো ফুলে গিয়েছিল। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন, কিন্তু চোখ খুলতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। জ্বর ছিল গায়ে, ১০২.২ ডিগ্রি। পালস রেট হয়ে গিয়েছিল প্রতি মিনিটে ১২০। তাকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়ার জন্য বিটা-ক্যাম্ফোর-এর চারটে আর দুটো ডিজিটামাইন ইনজেকশন দিয়েছিলাম। তারপরে ড্রিপ চালু করি। এছাড়া সংক্রমণ যাতে না ছড়ায়, তার জন্য সালফানামাইড ইনজেকশনও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আমি বুঝতেই পারছিলাম, এত কিছুর পরেও বোস আর বেশিক্ষণ জীবিত থাকবেন না।"

হাসপাতালেই হাজির ছিলেন আরেক চিকিৎসক ডাক্তার ইয়োশিও ইশি। তিনিও সুভাষ বসুর অবস্থার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন।

" আহত দু'জন দুটো আলাদা খাটে শুয়ে ছিলেন। একজন এতটাই লম্বা ছিলেন যে তার পা খাটের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। একজন নার্স আমাকে ডেকে বলেছিলেন, 'ডক্টর, ইনিই ভারতের চন্দ্র বোস। রক্ত দিতে হবে উনাকে। আমি শিরা খুঁজে পাচ্ছি না, প্লিজ একটু সাহায্য করুন আমাকে'," জানিয়েছিলেন ডাক্তার ইশি।

তার কথায়, "আমি যখন রক্ত দেওয়ার জন্য তার শিরায় সুচ ফোটালাম, কিছুটা রক্ত সুচ দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। রক্তের রঙটা ছিল গাঢ়। মৃত্যুর কিছুটা আগে থেকেই রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যেতে থাকে আর রক্তের রঙ পাল্টাতে থাকে।"

"একটা বিষয় আমাকে বেশ অবাক করেছিল। পাশের ঘরে দুর্ঘটনায় আহত জাপানি সৈনিকরা ব্যথায় চিৎকার করছিল, কিন্তু সুভাষচন্দ্র বসুর মুখ থেকে একটা শব্দও বের হয়নি। অথচ আমি ডাক্তার হিসাবে বুঝতে পারছিলাম তার কতটা শারীরিক কষ্ট হচ্ছে," জানিয়েছিলেন ডাক্তার ইশি।

১৮ অগাস্ট, ১৯৪৫, রাত প্রায় ন'টার সময়ে সুভাষ চন্দ্র বসু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

আশিস রায়ের কথায়, "জাপানে মৃতদের ছবি তোলার প্রথা নেই। কিন্তু কর্নেল রহমান বলেছিলেন যে তিনি জেনে-শুনেই সুভাষচন্দ্রের ছবি তুলতে দেন নি। কারণ তার শরীর তখন বেশ ফুলে গিয়েছিল।"

"জাপানি সেনাবাহিনীর মেজর নাগাতোমোর কথা অনুযায়ী, তার গোটা শরীরেই ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। ওর পার্থিব শরীরটা ঘরের এক কোনে রেখে দেওয়া হয়েছিল। চারদিকে একটা পর্দা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সামনে কয়েকটা মোমবাতি জ্বলছিল। ফুলও ছিল কিছু," বলছিলেন মি. রায়।

"কয়েকজন জাপানি সৈনিক সেখানে হাজির ছিলেন। সম্ভবত সেইদিনই, অথবা পরের দিন, ১৯ অগাস্ট নেতাজীর শরীর একটা কফিনে রাখা হয়। মেজর নাগাতোমো কফিনের ঢাকনা খুলে নেতাজীর চেহারা একবার দেখেছিলেন।"

কোনও বিমান না পাওয়ার ফলে তার মৃতদেহ সিঙ্গাপুর বা টোকিওতে নিয়ে যাওয়া যায় নি। চারদিন পরে, ২২ অগাস্ট তাইপেতেই তার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সেখানে হাজির ছিলেন কর্নেল হাবিবুর রহমান, মেজর নাগাতোমো আর সুভাষ চন্দ্রের দোভাষী জুইচি নাকামুরা।

মেজর নাগাতোমো শাহনাওয়াজ কমিশনে বলেছিলেন, আমি ফার্নেসের ঢাকনাটা খুলে ভেতর থেকে 'স্লাইডিং প্লেট'টা টেনে এনেছিলাম। ভেতরে নেতাজীর কঙ্কালটা পড়ে ছিল। শরীরটা দাহ করা হয়ে গিয়েছিল। একটা ছোট কাঠের কৌটা ছিল আমার সঙ্গে। বৌদ্ধ পরম্পরা অনুযায়ী দুটো চপস্টিক দিয়ে নেতাজীর ঘাড়ের কাছ থেকে একটা হাড় তুলে এনেছিলাম। তারপর একে একে তার শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ থেকে একেকটা হাড় সংগ্রহ করে ওই কাঠের কৌটোর ভেতরে রেখেছিলাম।"

কর্নেল হাবিবুর রহমানও পরে জানিয়েছিলেন যে শ্মশানে এক কর্মকর্তা তাকে সুভাষ বসুর সোনায় বাঁধানো একটা দাঁত দিয়েছিলেন। ওই দাঁতটা মৃতদেহর সঙ্গে জ্বলে যায় নি।

আশিস রায়ের কথায়, "আমি যখন ১৯৯০ সালে পাকিস্তানে গিয়েছিলাম, তখন হাবিবুর রহমানের ছেলে নইমুর রহমানের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন যে তার বাবা কাগজে মোড়া সুভাষ বসুর ওই সোনা বাঁধানো দাঁতটা অস্থি- কলসেই রেখে দিয়েছিলেন।"

২০০২ সালে ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের দুই অফিসার যখন রেনকোজি মন্দিরে রাখা সুভাষ বসুর অস্থি-কলস পরীক্ষা করতে গিয়েছিলেন, তারাও ভেতরে ওই কাগজের মোড়কে রাখা সোনার দাঁতটা দেখতে পেয়েছিলেন।

সেই সময়ে জাপানে ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন আফতার শেঠ। তিনি বলছেন, "ওই দুজন অফিসার, সি রাজশেখর এবং আর্মস্ট্রং চেঙসন আমার সঙ্গেই টোকিওতে ভারতীয় দূতাবাসে কাজ করতেন। বাজপেয়ী সরকার যখন নেতাজীর মৃত্যুর তদন্ত করতে মুখার্জী কমিশন তৈরি করেন, তখন বিচারপতি মুখার্জীও টোকিওতে এসেছিলেন।"

আশিস রায় জানাচ্ছেন, "কিন্তু বিচারপতি মুখার্জী নিজে রেনকোজি মন্দিরে যান নি। তার নির্দেশ মতো দু'জন অফিসারকে পাঠানো হয়। তারা কাগজের মোড়কে রাখা ওই দাঁতের ছবিও তুলে এনেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও মুখার্জী কমিশন এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে নেতাজীর মৃত্যু ওই বিমান দুর্ঘটনায় হয় নি আর রেনকোজি মন্দিরে যে অস্থি রাখা আছে, সেটাও নেতাজীর নয়।"

মি. রায়ের কথায়, "অনিতাই আমার বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন যে নেতাজী একটা স্বাধীন ভারতে ফিরে এসে কাজ করতে চেয়েছিলেন। সেটা যখন সম্ভব হয় নি, তখন অন্তত তার অস্থিটা ভারতের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হোক। তার মৃত্যুর ৭৩ বছর পরে হলেও অস্থিটা যদি ভারতে নিয়ে এসে গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়, সেটাই বোধ হয় রাষ্ট্রের তরফে তার প্রতি সবচেয়ে বড় সম্মান জানানো হবে।"

আগামীনিউজ/প্রভাত

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে