Dr. Neem on Daraz
Victory Day
ফিরে দেখা ১৯৭১’র মার্চ

একজন শরণার্থীর জবানবন্দি


আগামী নিউজ | জিকরুল হক, উত্তরাঞ্চল প্রতিনিধি প্রকাশিত: মার্চ ১২, ২০২২, ০৪:৫৪ পিএম
একজন শরণার্থীর জবানবন্দি

অধ্যাপক ক্ষিতিশ চন্দ্র রায়

বাঙালি জাতির মহাস্মরণীয় বছর ১৯৭১ সাল। জাতি হিসাবে বিশ্বের দরবারে পরিচিত হতে হাজার বছর সংগ্রামের স্বীকৃতির ফসল ১৯৭১। এ বছরের মার্চ মাস বাঙালি জাতির জীবনে অবিস্মরণীয় হিসাবে থাকবে অসীম কাল পর্যন্ত। পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম বুলেটের আঘাত এবং দেশীয় দালালদের হাত থেকে জীবন ও সম্ভ্রম বাঁচাতে সেদিন প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল প্রায় কোটিখানেক মানুষ। বাস্তুচ্যুত এসব মানুষ দীর্ঘ ৯ মাস ভারতে শরণার্থী জীবন কাটিয়েছেন। কেমন ছিল সেই শরণার্থী জীবন তা জানা যাক একজন শরণার্থীর জবানবন্দি থেকেই।

অধ্যাপক ক্ষিতিশ চন্দ্র রায়। ১৯৭১ সালে যার বয়স ছিল বারো বছরের কাছাকাছি। এই শিশু বয়সে তিনি শরণার্থী জীবন কাটিয়েছেন ভারতের ফকিরগঞ্জ বাজার এলাকায়। তার মুখ থেকেই শোনা যাক ঘটনার আদিঅন্ত। অধ্যাপক ক্ষিতিশ চন্দ্র রায় জানান, ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় সংসদের বৈঠকের দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী ভুট্টুর প্ররোচনায় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করেন। এ খবরে সবচেয়ে বেশি আতংকিত হয়ে পড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের কথা পাকিস্তানিরা কোনভাবেই বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্বকারী দল আ’লীগের হাতে ক্ষমতা দিবে না, তাই সংঘর্ষ অনিবার্য। এমন চিন্তা থেকেই ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় তারা। গৃহস্থালী পণ্য ও গরু, ছাগল, ধান, চাল বিক্রি করে অর্থ সঞ্চয়ের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই প্রস্তুতির অংশ হিসাবে যুদ্ধ শুরুর দিন কতক পূর্বে গরুর গাড়িতে করে বাড়ির চাল বিক্রি করার জন্য রংপুরের তারাগঞ্জ হাটে যাচ্ছিল। কিন্তু পথিমধ্যে চাল বোঝাই দুটি গরুর গাড়ী আটক করে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায় সেই সময়ের শান্তি কমিটির নেতা ও কুখ্যাত রাজাকার কছিম উদ্দিন পাইকার ওরফে চকরু পাইকার (বর্তমান আ’লীগ নেতা আমেনা কোহিনুরের দূরের স্বজন)। এরপর সমস্ত চাল ওই চকরু পাইকার লুট করে নেয়। পাকসেনার দেশীয় দালালদের এমন আচরণে হিন্দু সম্প্রদায়সহ আ’লীগের মুসলমান কর্মী সমর্থকরাও ভয় পেয়ে যায়। এর মধ্যে ২৫ মার্চ শুরু হয়ে গেল যুদ্ধ। জীবন বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নেয়ার প্রস্তুতি নেয়া হয়। রাতের আঁধারে ছুটতে থাকে ভারতের সীমান্ত অভিমুখে। মোহনপুর সীমান্ত পেরিয়ে তারা যাবে ভারতে। পার হতে হবে দিনাজপুর-ফুলবাড়ী মহাসড়ক। যাতে কোন বাঙালি ভারতে যেতে না পারে সেজন্য ওই মহাসড়কে টহল দিত পাকি সেনারা। এমন অবস্থায় গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতে হতো। সুযোগ বুঝে রাস্তা পার হয়ে তিন কিলোমিটার দৌঁড়ে যেতে হতো মোহনপুর বর্ডারে। ক্ষুধা নিবারণে সম্বল ছিল মুড়ি চিড়া আর গুড়। ভারতে পৌছার পর শুরু হয় শরণার্থী জীবন। শরণার্থীরা কেউ টিনের চালা, কেউ তাঁবু খাটিয়ে রাত্রিযাপন করতো। জীবন টিকিয়ে রাখতে রেশনের চাল ছিল ভরসা। ভাত খেতে তরকারি ছিল বনের শাকসবজি। খড়কুটো জোগাড় করে সাড়া হতো জ্বালানীর কাজ। আমিষ বলতে ছোট নদী ও জলাশয়ের মাছ ছিল ভরসা। দীঘি ও পুকুরের পানিতে রান্নার কাজ চলতো। শুধু খাওয়ার পানি মিলতো দূরের নলকূপ থেকে। প্রাকৃতিক কাজের স্থান ছিল বন জঙ্গলে। ভারত সরকার পরিচালিত শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে চাল, তেল, আলু, ডাল ও খড়ি মিলতো। কিন্তু থাকার জায়গা ছিল অপর্যাপ্ত। ছোট ঘরে গাদাগাদি করে একাধিক পরিবারের মানুষ বাস করতো। গোসলখানা ও পায়খানার রাস্তায় দীর্ঘ সারির লাইন থাকতো। ফলে ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগে অনেক শিশু ও বৃদ্ধ প্রতিদিন মারা যেত। সৎকার করা হতো যেনতেন ভাবে। রেশনের পণ্য নিতে রাত ১০টায় লাইনে দাঁড়ালে রেশন মিলতো পরদিন দুপুর ১২টায়। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ক্যাম্পগুলোও ছিল অব্যবস্থাপনায় ভরপুর। বর্ষার পানিতে ক্যাম্পে হাঁটুপানি জমে যেত। প্রায় সময় মুক্তিযোদ্ধারা বিনিদ্র সময় অতিবাহিত করত। খাবারের সংকটও ছিল। তারপরও অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণপণ লড়াই চালিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের শতকরা ৯৫ ভাগ ছিল কৃষক, শ্রমিক, দিনমজুর ঘরের সন্তানরা। রাতের বেলা মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র হাতে নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে পাকি সেনাদের ঘাঁটিতে আঘাত করে ভোরবেলা সীমান্ত পার হয়ে ক্যাম্পে ফিরতো। যুদ্ধে যাওয়ার সময় যতজনকে দেখা যেত, ফিরে আসার সময় ততজন ফিরতো না। এমন অবস্থা দেখে খুউব খারাপ লাগতো। তবে যেদিন রাজাকার কিংবা পাকি সেনাদের খতম করার খবর শুনতাম সেদিন মন উৎফুল্ল হয়ে উঠতো। শরণার্থী শিবিরের মানুষরা কচু ঘেচু যাই খাক না কেন রাতের বেলা জড়ো হয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতো।

অধ্যাপক ক্ষিতিশ চন্দ্র রায় আরো জানান, দেশকে শত্রুমুক্ত করার লড়াইয়ে নিজেকে যুক্ত করার মনোবাসনা পোষণ করলেও সুযোগ মিলেনি। তার কারণটি ছিল বয়স কম আর সাইজে ছিলাম আমি বেশ ছোট। সে কারণে সেদিনের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে হার মানতে বাধ্য হয়েছি। ১৬ ডিসেম্বর যেদিন শুনলাম দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর বিলম্ব না করেই ১৭ ডিসেম্বর বাড়িতে ফিরে আসি। বাড়ি ফিরে এসে দেখি সব শ্মশান। সব ধ্বংস করে দিয়েছে পাকি সেনা আর তাদের এ দেশীয় দোসররা। তারপরও নিজ দেশে ফিরে দীর্ঘ শান্তির নিঃশ্বাস নেই, ফিরে পাই নতুন জীবন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছর পর মনে হচ্ছে নিজ ভূমিতে পরবাসী জীবন কাটাচ্ছি। শান্তির নিঃশ্বাস বিষাক্ত হচ্ছে। বিদেশী শত্রুরা পালিয়ে গেলেও পরাজিতরা বীর বিক্রমে চলছে। সাধারণ মানুষ আবারো যেন শিকলবন্দি হতে চলেছে। নিত্যপণ্যের বাজারে ধাধা করে আগুন জ্বলছে। এমন দেশ সেদিন চাইনি। এমন দেশের জন্য কাটাইনি সেদিন শরণার্থী জীবন।

এসএস

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে