Dr. Neem on Daraz
Victory Day

মানতের ডিম


আগামী নিউজ | চিনুয়া আচেবে প্রকাশিত: মার্চ ৭, ২০২১, ০২:০৬ পিএম
মানতের ডিম

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ জুলিয়াস অবি চেয়ারে বসে একদৃষ্টে তার টাইপ রাইটারটির দিকে তাকিয়ে আছে। তার বস মোটাসোটা প্রধান কেরানিটি টেবিলে মাথা রেখে ইতিমধ্যেই নাকডাকা শুরু করে দিয়েছে। বাইরে, সবুজ রঙের উর্দি পরা দারোয়ান চৌকিতে ঘুমিয়ে আছে। বিগত প্রায় এক সপ্তাহের মধ্যে কোনো ক্রেতা ফটকের ভেতর দিয়ে ঢোকেনি। ওজন মাপার বিশাল যন্ত্রটির উপরে একটি খালি ঝুড়ি ফেলে রাখা। কয়েকটা পাম শাঁস যন্ত্রটির চারপাশে ধুলোর মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জুলিয়াস উঠে জানালাটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায় যেখান থেকে নাইজার নদীর পাড়ে বিশাল বাজারটি চোখে পড়ে। অন্য সব ইবো বাজারের মত এই বাজারটি সপ্তাহে চারটি বাজার দিনের মধ্যে একদিন বসত। তবে সাদাদের আগমন এবং উমুরু নদী ঘাঁটটি একটি বিশাল পাম-ওয়েল বন্দরে পরিণত হওয়াতে এটা এখন একটা প্রাত্যহিক বাজারে পরিণত হয়েছে।

এসব সত্ত্বেও বাজারটি এখনও এটার মূল নিকোয়া বারে সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে। কারণ এটার অধিষ্ঠাত্রী দেবী ঐদিনই কেবল তার জাদুমন্ত্র প্রয়োগ করে। লোকমুখে শোনা যায় যে দেবী একজন লোলচর্ম পক্ককেশ বুড়ির ছদ্মবেশ ধরে ঐদিন ভোরে মোরগ ডাকার আগ মুহূর্তে বাজারের মাঝখানে এসে আবির্ভূত হয়। এবং দূর সম্পর্কীয় নানা গোত্র থেকে নারী-পুরুষকে বাজারের দিকে টেনে নিয়ে আসতে সে তার জাদুর পাখা পৃথিবীর চার অভিমুখে- তার সামনে-পেছনে, ডানে-বামে- নাড়ায়। এবং তারা আসে, এই শত শত নারী-পুরুষ বহন করে নিয়ে আসে তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে উৎপাদিত পণ্য: পাম তেল ও শাঁস, কোলা বাদাম, কাসাভা, হরেক রকমের মাদুর, ঝুড়ি এবং মাটির হাড়ি-পাতিল। এবং তারা বাড়ি ফেরার সময় সাথে করে নিয়ে যায় রঙ্গীন বাহারি কাপড়চোপড়, ধূমায়িত মাছ এবং লোহার বাসন-কোসন। ডিঙ্গি নৌকায় মাছ এবং ইয়াম ভরে আরো অনেকে বিশাল নদী দিয়ে আসে।

অনেক সময় বারো চৌদ্দজন আসে বড় ডিঙ্গি নৌকায়; আবার মাঝে মাঝে একজন জেলে আর তার বউ একটা ছোট নৌকায় চড়ে খরস্রোতা আনাম্বারা নদী দিয়ে আসে। তারা ডিঙ্গি ঘাটে বেঁধে অনেক দরাদরির পর তাদের মাছ বিক্রি করে। এরপর নারীরা নদীর খাড়া পাড় বেয়ে হেঁটে বাজারের ভেতর প্রবেশ করে তেল-নুন কিনতে এবং বিক্রি-বাট্টা ভালো হলে এক ফালি কাপড়ও কিনে ফেলে। এবং বাড়িতে রেখে আসা শিশুদের জন্য কিনে ইগারা- নারীদের তৈরি মটরশুটি পিঠা অথবা “আকারা” এবং “মেই-মেই”। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে তারা বৈঠা হাতে নৌকা বাইতে শুরু করে, সূর্যাস্তের লালচে আভায় নদীর পানি চিকচিক করে এবং তাদের ডিঙ্গিগুলো তীর থেকে দূরে সরতে সরতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হতে হতে পানির উপর বাঁকা চাঁদের মত হয়ে উঠে এবং তার মধ্যে দুটি আবছা অবয়ব সামনে পেছনে দুলতে থাকে। জুলিয়াস অবি উমুরু এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা নয়।

সে এসেছে বিশ মাইলের মত দূরের জঙ্গলাকীর্ণ একটি গ্রাম থেকে। কিন্তু সে মিশন স্কুলে ১৯২০ সালে স্ট্যান্ডার্ড সিক্স পাস করার পর উমুরুতে নাইজার কোম্পানির অফিসে কেরানির কাজ নিয়ে চলে আসে, এটা পাম তেল ও পাম শাঁসের ব্যবসা করে। এই কোম্পানির অফিস বিখ্যাত উমুরু বাজারের পাশেই অবস্থিত। এর ফলে প্রথম দুই তিন সপ্তাহের মধ্যেই তাকে ব্যাপক হৈ-চৈ আর হট্টগোলের মধ্যেই কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হয়। মাঝে মাঝে যখন প্রধান কেরানিটি বাইরে যায় অথবা ঘুমিয়ে থাকে তখন সে হেঁটে জানালাটির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় এবং উইঢিবির মত বিপুল কর্মযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে মনে মনে ভাবে, এই ভিড়ের মধ্যকার অধিকাংশ লোক গতকাল এখানে ছিল না, তারপরও পুরো বাজার ছিল আজকের মতই জনাকীর্ণ। পৃথিবীতে নিশ্চয় অনেক মানুষের বাস।

অবশ্য তারা বলে যে এই বিশাল বাজারে যারা আসে তারা সকলেই আসল মানুষ নয়। জ্যানেটের মাও এরকম বলত। “যে সুন্দরী তরুণীদের ঠেলেঠুলে ভিড়ের ভেতর ঢুকতে দেখো, ওদের সকলে কিন্তু আসল মানুষ নয় বরঞ্চ নদী থেকে উঠে আসা ম্যাম্মি ওয়াটা, ” জ্যানেটের মা বলত। “ওদেরকে চেনা যাবে কিভাবে?” জিজ্ঞেস করে জুলিয়াস, তার শিক্ষা-দীক্ষা তাকে এসব কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। কিন্তু সে তার অবিশ্বাসী মনোভাব গোপন করার চেষ্টা করে। সে অন্তত এটুকু শিখেছে যে, এসব বিষয় নিয়ে মুরুব্বিদের সাথে তর্ক করা খুব একটা ভালো দেখায় না। “তাদেরকে সহজেই চেনা যায়, ” সে ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়াস পায়, “কারণ তাদের সৌন্দর্য এই পৃথিবীর সৌন্দর্য থেকে পুরোপুরি আলাদা ।

তুমি তাদেরকে আড়চোখে একবার দেখবে, আর সাথে সাথেই তারা ভিড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যাবে।” জুলিয়াস এখন জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জনশূন্য বাজারের দিকে তাকিয়ে থেকে এসব কিছু ভাবতে থাকে। কে ভেবেছিল যে এই বিশাল বাজারটি কখনও এমন জনশূন্য হয়ে উঠবে? তবে কিটিকপা অথবা গুটি বসন্তের এমনই দাপট। উমুরু যখন ছোট্ট একটি গ্রাম ছিল তখন এখানকার মুষ্টিমেয় অধিবাসীরা সকলে মিলে এটাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখত। তবে এটা এখন ব্যস্ত, ঠাসবুনট, ঘিঞ্জি এবং নোংরা একটি নদী বন্দর হয়ে উঠেছে। আর চলে এসেছে গুটিবসন্ত। ইবো সম্প্রদায়ের লোকজন অন্য কোনো রোগকে গুটিবসন্তের মত এত ভয় পায় না। তারা এটাকে একটা ভয়ংকর অপদেবতা রূপে কল্পনা করে। এই রোগের শিকার লোকজন শোক পর্যন্ত করে না, পাছে এই অপদেবতাকে রুষ্ট করা হয়। এটা প্রতিবেশীদের আসা-যাওয়া এবং এক গ্রাম হতে আরেক গ্রামে মানুষের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়। লোকজন বলাবলি করে, কিটিকপা এখন ঐ গ্রামে ঢুকেছে, আর সাথে সাথেই গ্রামটি তার আশেপাশের সকল গ্রাম থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

জুলিয়াস দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। কারণ সে তার বাগদত্তা জ্যানেটকে শেষবার দেখার পর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। জ্যানেটের মা তাকে খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে বলেছিল যে, জিহোভার রহমতে শুভকাজ সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের সাথে তার দেখা করতে আসা ঠিক হবে না। জ্যানেটের মা একজন ধর্মপরায়ণ খ্রিষ্টান নারী এবং তার একমাত্র মেয়েকে জুলিয়াসের সাথে বিয়ে দিতে রাজী হয়েছে। তার কারণ সে গির্জায় গিয়ে সমবেত প্রার্থনা সঙ্গীত গায়। “তুমি সবসময় তোমার ঘরেই থাকবে, ” তিনি বলেছিলেন, তুমি তো আর জান না যে রাস্তায় কার সাথে তোমার দেখা হয়ে যাবে। ওটা (গুটিবসন্ত) এখন ঐ বাড়িতে ঢুকেছে।” রাস্তার অপর পাশের বাড়িটির দিকে সে আঙুল নির্দেশ করে। “দরজার সামনে ফেলে রাখা পাম গাছের হলুদ পত্রবৎ ডাল দেখেই এটা বোঝা যায়। এই বাড়ির সকলকে আজকে সরকারি একটা বড় লরিতে উঠিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” সেদিন জ্যানেট খানিকটা পথ তাকে এগিয়ে দেয়, এবং তারা পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় জানানোর সময় হাত মেলায় যা ছিল খুবই অস্বাভাবিক। সেদিন জুলিয়াস সরাসরি বাড়ি ফিরে আসেনি।

সে সোজা চলে যায় নদীর পাড়ে এবং ইতস্তত হাঁটাহাঁটি করে। সে ওখানে নিশ্চিত অনেকক্ষণ ছিল। কারণ যখন রাতের প্রেতাত্মার কাঠের ঘণ্টা বেজে উঠে সে তখনও ওখানেই। সে সাথে সাথে হাঁটা এবং দৌড়ের মিলিত ভঙ্গিতে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করে। প্রেতাত্মাটি শহরের ভেতর দিয়ে ছুটতে শুরু করার আগে বাড়িতে পৌঁছুতে তার হাতে সময় ছিলো মাত্র আধা ঘণ্টা। জুলিয়াস বাড়িতে দ্রুত ফেরার সময় এমন একটা কিছুর উপর তার পা পড়ে যা সামান্য শব্দে ফেটে গিয়ে কিছুটা পিচ্ছিল তরল পদার্থ বের হয়ে আসে। সে সাথে সাথে দাঁড়িয়ে পড়ে এবং নীচের দিকে তাকায়। আকাশে তখনও চাঁদ উঠেনি তবে সামান্য আবছা আলোর ফলে বোঝা যাচ্ছিল চাঁদ ওঠার আর বেশি দেরি নেই। সেই আবছা আলোতে জুলিয়াস দেখতে পেল, সে একটি মানতের ডিমের উপর পা ফেলেছে। ডিমটি পাম গাছের কচি পাতা দিয়ে ঘিরে রাখা।

দুর্ভাগ্য পীড়িত কেউ হয়তো ঘোর কালী সন্ধ্যায় তার নৈবদ্যটিকে পথের মোড়ে রেখে গেছে। এবং পা ফেলে সে এটাকে ভেঙে ফেলেছে এবং দুর্ভোগকারীর মন্দভাগ্য নিজের ঘাড়ে টেনে এনেছে। “যত্তসব, ” সে আবার আবার বাড়ির দিক জোর কদমে ছুটতে শুরু করে। তবে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে; রাতের প্রেতাত্মা ইতোমধ্যেই বাইরে চলে এসেছে। অন্ধকারের মধ্যে স্থবির বাতাসে এটার কণ্ঠ উঁচুতে উঠে ও পরিষ্কার শোনা যেতে থাকে। আওয়াজটা বেশ দূর থেকেই কানে আসছে, কিন্তু জুলিয়াস জানে যে এদের ক্ষেত্রে দূরত্ব কোনো ব্যাপার না। সে কোনো দিকে না তাকিয়ে রাস্তার পাশের কোকোয়াম ফার্মে ছুটে যায় এবং উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে। আর মুহূর্তের মধ্যেই প্রেতাত্মাটির ঝনঝন শব্দ এবং গূঢ় কথাবার্তার বজ্র ধ্বনি শুনতে পায়। ভয়ে তার সর্বাঙ্গ কাঁপতে শুরু করে। শব্দগুলো ভয়ংকরভাবে তার দিকে ছুটে আসতে থাকে।

এবং এরপর সে পা ফেলারও শব্দ শুনতে পায়। মনে হচ্ছিল যেন বিশ বাইশ জন লোক একসাথে ছুটে আসছে। মুহূর্তের মধ্যেই সকল শব্দ পাশ কেটে চলে গিয়ে বেশ দূরে রাস্তার অপর পাশে মিলিয়ে যায়। জুলিয়াস অবি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে জনহীন বাজারের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবনার মধ্য দিয়ে সেই ভয়াল রাত্রিটিকেই যেন পুনরায় পেরিয়ে যায়। মাত্র একসপ্তাহ আগের কথা, তবে মনে হয় যেন তা একটা বিশাল শূন্যতা দ্বারা বর্তমান সময় থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই শূন্যতা সময়ের বয়ে চলার সাথে আরো বেশি গভীর হয়ে উঠে। এ-পাশে দাঁড়িয়ে আছে জুলিয়াস নিজে আর অপর পাশে জ্যানেটের মা এবং জ্যানেট গুটিবসন্ত যাদেরকে পরপারে নিয়ে গেছে। কোলা বাদাম* (প্রধানত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মে ক্যাফেইন সমৃদ্ধ এক ধরনের গাছ বাদাম) কাসাভা* (গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মে এক ধরনের শ্বেতসার বহুল কন্দ) ইয়াম* -(গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মে এক ধরনের মিষ্টি আলু) কোকোয়াম* (একধরনের সবজি এবং কন্দ) ম্যাম্মি ওয়াটা (mammy-wota)* (জলের দেবী, যাকে আফ্রিকান অঞ্চলে পূজা করা হয়) নিকোয়া বার (Nkwo day)* (নাইজেরিয়াতে সপ্তাহের চারটি বাজার বারের একটি)

অনুবাদ : মেহেদী হাসান

আগামীনিউজ/প্রভাত

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে