আগামীর চালিকাশক্তি নবায়নযোগ্য জ্বালানি

মো. জিল্লুর রহমান ফেব্রুয়ারি ২, ২০২১, ১২:২৯ এএম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ গোটা বিশ্ব বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন আর পরিবেশ নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। একদিকে উন্নত বিশ্বের অবাধে কার্বন নির্গমন অব্যাহত রয়েছে, আর অন্যদিকে বিদ্যমান রয়েছে দরিদ্র জাতিগোষ্ঠীর দুর্ভোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি। এসব কারণে বর্তমানে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে সময়োপযোগী একটি পরিবেশবান্ধব শক্তি এবং কার্বন নিঃসরণমুক্ত উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং একটি টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থায় পৌঁছানোর জন্য জাতিসংঘ ও বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী দলগুলো নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ওপর উৎসাহ ও জোর দিয়ে আসছে।


আসলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এমন এক শক্তির উৎস, যা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে পুনরায় ব্যবহার করা যায় এবং শক্তির উৎসটি নিঃশেষ হয়ে যায় না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎস, যেমনÑসূর্যের আলো ও তাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, জৈবশক্তি (বায়োগ্যাস, বায়োম্যাস, বায়োফুয়েল), ভূ-তাপ, সমুদ্রতরঙ্গ, সমুদ্র-তাপ, জোয়ার-ভাটা, শহুরে আবর্জনা, হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল প্রভৃতি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়। সভ্যতার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি চাহিদা মেটাতে এত দিন ব্যবহার করে আসা জীবাশ্ম জ্বালানির বিপরীতে নবায়নযোগ্য শক্তি বর্তমানে বিশ্বে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অধিকাংশ দেশ তাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম শিকার বাংলাদেশও নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিক থেকে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশকে জার্মানিসহ বেশ কিছু উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা এক্ষেত্রে সহায়তা করছে। আর সরকারও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির উৎপাদন ও ব্যবহারে বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে সারা দেশের মানুষকে জৈব গ্যাস এবং সৌরশক্তির ব্যবহারের পাশাপাশি জ্বালানি সাশ্রয়ে উদ্বুদ্ধ করছে। এমনকি জনগণের মাঝে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাতি বিতরণ করা হয়েছে।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে বেসরকারি উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) কর্তৃক সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি। এ পর্যন্ত প্রায় ৪৫ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকলের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচির কারণে এর সংখ্যা বাড়ছে।

বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি বা জ্বালানির ব্যবহার এবং এর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ২০০৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা কার্যকর হয়। বাংলাদেশ সরকার টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) অ্যাক্ট-২০১২ প্রণয়ন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস হিসেবে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োমাস, বায়োফুয়েল, জিওথার্মাল, নদীর স্রোত, সমুদ্রের ঢেউ প্রভৃতিকে শনাক্ত করেছে। ২০১৬ সালে পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান (পিএসএমপি) নবায়নযোগ্য শক্তির শেয়ারের ক্ষেত্রে ২০২১ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ১০ শতাংশে (২৪৭০ মেগাওয়াট) পৌঁছানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।

এ লক্ষ্য অর্জনে সৌরশক্তি সর্বাধিক কাজে লাগানোকে প্রধান হিসাবে ধরা হয়েছিল। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, দেশে এখন প্রচলিত উৎস থেকে ২০ হাজার ৫৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ মাত্র ৭০০ দশমিক ৬১ মেগাওয়াট, যা মোট উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র তিন শতাংশ এবং কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অপ্রতুল। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) তথ্যানুসারে, বিভিন্ন নবায়নযোগ্য শক্তি উৎসগুলোর মধ্যে এই খাতের সর্বোচ্চ ৪৬৬ দশমিক ৬৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা নিয়ে শীর্ষে আছে পিভি সোলার এবং এরপর রয়েছে ২৩০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন জলবিদ্যুৎ, বায়ু থেকে দুই দশমিক ৯ মেগাওয়াট, জৈব-গ্যাস থেকে দশমিক ৬৩ মেগাওয়াট এবং বায়োগ্যাস থেকে মাত্র দশমিক চার মেগাওয়াট।

সরকারের তথ্যমতে, ২০১৬ সালে পিএসএমপি গঠনের পর সরকার গত পাঁচ-ছয় বছরে সরকারি ও বেসরকারি খাতে থাকা মোট ৩৬টি গ্রিড-সংযুক্ত করে সোলার পার্ক প্রকল্প বাস্তবায়নের মোট দুই হাজার ১১০ দশমিক ৬৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করেছিল। হালনাগাদ ২৬টি প্রকল্পের জন্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও এখন পর্যন্ত কেবল পাঁচটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। প্রায় ৮৮ দশমিক পাঁচ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি বাস্তবায়িত প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে ৫০ মেগাওয়াটের গৌরীপুর, ময়মনসিংহ, সাত দশমিক পাঁচ মেগাওয়াট কাপ্তাই, আট মেগাওয়াট পঞ্চগড়, ২০ মেগাওয়াট টেকনাফ এবং তিন মেগাওয়াট সরিষাবাড়ী সৌরপার্ক।


আশার কথা হচ্ছে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশগুলোই সবচেয়ে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার করছে। এর কারণ তাদের নিজ দেশের মানুষের এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদীদের চাপ। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, রাশিয়া ও ভারত বিশ্বের সব থেকে বেশি নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের জন্য রয়েছে আলাদা আইনি বাধ্যবাধকতা এবং ফিড-ইন-ট্যারিফের ব্যবস্থা। বিশ্বের সব থেকে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে চীনে। চীন সব থেকে বড় বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রও প্রতিষ্ঠা করেছে। চীনে ১০০টিরও বেশি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ভারতে পৃথিবীর সব থেকে বড় সোলার পাওয়ার প্লান্ট রয়েছে, যা ৬৪৮ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। জার্মানিতে সবচেয়ে বেশি সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। নরডিক দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তিবান্ধব আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এর প্রসার ঘটাতে সাহায্য করছে। একইসঙ্গে বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ নবায়নযোগ্য শক্তি বৃদ্ধির জন্য নীতি ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ভারত থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে তিন শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, যেখানে ভারত উৎপাদন করে তার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ২৪ দশমিক ১৬ শতাংশ, যা প্রায় ৯০ হাজার ৩৯৯ মেগাওয়াট। দেশটির মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা তিন লাখ ৭৪ হাজার ১৯৯ মেগাওয়াট (জলবিদ্যুৎ বাদে)। অন্যদিকে পাকিস্তানের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৩৭ হাজার ৪০২ মেগাওয়াটের (সৌর ও বায়ু বাদে) বিপরীতে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পাঁচ শতাংশ (এক হাজার ৮৭০ মেগাওয়াট) উৎপাদন করে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০১০ সালে শহরে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেত এবং অন্যদিকে ৪২ শতাংশ গ্রামের মানুষ এই সুবিধা পেত। সাত বছর পর, অর্থাৎ ২০১৭ সালে প্রায় ৭৬ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা পেয়েছে। যদিও বিদ্যুৎ অবকাঠামো ত্রুটিবিহীন নয় এবং ফলাফলস্বরূপ এখনও লোডশেডিং হয়। এক্ষেত্রে আরও তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা একটা ভালো সমাধান হতে পারে। তবে ভবিষ্যতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিই হবে বিদ্যুতের প্রধান উৎস ও চালিকাশক্তি।


সৌরবিদ্যুতের জন্য বাংলাদেশ বেশ উপযুক্ত, কারণ দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় ১১ ঘণ্টা পরিষ্কার সূর্যের আলো পাওয়া যায়। এসব এলাকায় ওহংড়ষধঃরড়হ-এর হার তিন দশমিক আট কিলোওয়াট/এম ২ /প্রতিদিন এবং ছয় দশমিক চার কিলোওয়াট /মি ২ /প্রতি দিন। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য সৌর হোম সিস্টেম, যাকে সংক্ষেপে এসএইচএস বলে, তা চালু করেছে। এগুলো পাওয়ার গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। এই কার্যক্রমটি ৪০ লাখেরও বেশি পরিবারকে সাহায্য করেছে। ২০০৯ সাল থেকে প্রতি মাসে প্রায় ৫০ হাজার টিএসএইচএস স্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল সৌর হোম সিস্টেম কার্যক্রম হিসেবে অভিহিত করেছে। স্পষ্টতই, বিদ্যুতায়ন রোডম্যাপে বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র  অনগ্রসর হিসেবে পরিণত হয়েছে। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানি হবে আগামীর মূল চালিকাশক্তি ও আধার।

তবে এক্ষেত্রে কিছু দুর্বলতা আছে। বাংলাদেশ মৌসুমি বায়ুর জন্য পরিচিত, সৌরশক্তি অনেকটাই আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল এবং বাংলাদেশের আবহাওয়া বছরের কিছু সময়  মেঘাচ্ছন্ন থাকে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও সোলার প্লান্ট অনেক ব্যয়বহুলও বটে। তার পরও বেশিরভাগ দুর্বলতাগুলো বড় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে সমাধান করা যায়।

নবায়নযোগ্য শক্তি বর্তমানে বিশ্বে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অধিকাংশ দেশ তাদের বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের মধ্যে সৌরশক্তি সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এবং বায়োগ্যাস ও বায়োমাসের রয়েছে সীমিত ব্যবহার। বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির অধিকাংশ ব্যয় হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে, মোটরযান চলাচলে এবং বাসাবাড়ির তাপ-উৎপাদনে। এজন্য নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করে টেকসই বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, টেকসই যানবাহন ব্যবস্থা এবং গ্রিন টেকনোলজিসমৃদ্ধ শক্তিসাশ্রয়ী গৃহস্থালি পণ্য প্রবর্তনে আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন গবেষণা প্রক্রিয়াধীন আছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে প্রতিশ্রুতির অভাব, জমির সংকট, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং প্রচলিত জ্বালানির পক্ষে কঠোর আমলাতান্ত্রিক মানসিকতার জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার কাক্সিক্ষত পর্যায়ে পৌঁছেনি। তবে বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি এখন টেক অফ পর্যায়ে চলে এসেছে। টেক অফের পর্যায়ে সব সেক্টরকেই বিশাল চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এ চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে পারলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি হবে আগামীর চালিকাশক্তি।

লেখকঃ ব্যাংকার ও কলামিস্ট 

আগামীনিউজ/এএইচ