বিশ্বকাপ জিতিয়ে মায়ের কান্না থামিয়েছেন আকবর

রবিউল ইসলাম বিদ্যুৎ ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২০, ১২:১৩ পিএম
ছবি : আগামীনিউজ ডটকম

ঢাকা : ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশে এখন শুধুই আবেগের মাখামাখি। ছেলে বুড়ো আবালবৃদ্ধবনিতা সবার মুখে মুখে বাংলাদেশের যুবাদের নিয়ে প্রশংসার বান ছুটছে। আর হবেই না বা কেন স্বাধীনতার পর এত বড় অর্জন যে দেখেনি বাংলাদেশ। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে প্রবল পরাক্রমশালী ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। আকবর আলীদের সৌজন্যে এখন থেকে বাংলাদেশের আগে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন শব্দটিও বসানো যাবে। 

কিন্তু বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন করার নেপথ্যে যিনি বড় ভুমিকা নিয়েছিলেন সেই আকবর আলীর বাড়িতে আনন্দ যেন একটু কমই। বিশ্বকাপ চলাকালিনই গত ২২ জানুয়ারী যমজ সন্তান প্রসব করতে গিয়ে বাংলাদেশ অধিনায়কের একমাত্র বোন মারা যান। পরদিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচ দেখে সেই খবর দেওয়া হয়নি আকবরকে। পাছে যদি আবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বাংলাদেশ অধিনায়ক দেশে ফিরতে চায়-এই ভয় ছিল পরিবারের। কিন্তু বোনের এমন করুণ মৃত্যুর খবর পরিবারের দেওয়ার আগেই পেয়েছিলেন আকবর। 

এ নিয়ে পরিবারের সঙ্গে তাঁর একটু অভিমানও হয়েছিল। সে কথাই আগামীনিউজের প্রতিবেদককে বলছিলেন আকবরের বড় ভাই মুরাদ হোসেন, ‘আমরা ওকে খবরটা দিতে চাইনি। ও খেলছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। ওখানে তো আমাদের পরিবারের কেউ নেই। আর ও বোনকে খুব ভালোবাসত। খেলা বাদ দিয়ে যদি দেশে আসতে চায়! পরিবারের সবাই মিলেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু কিভাবে যেন ও জেনে গিয়েছিল। পরে ফোন করে আমাদের বলেছে, আমরা কেন তাঁকে জানালাম না।’

বড় বোন না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর আগে ছোট ভাইয়ের দুটো ম্যাচের খবর নিতে পেরেছিলেন। গ্রুপ পর্বে সেই দুটি ম্যাচে অনায়াসেই জয় তুলে নিয়েছিল বাংলাদেশ। মুরাদ বলছিলেন, ‘আমার বোনটা আকবরের এই কীর্তিটা দেখে যেতে পারল না। ওর এই জায়গায় আসার পেছনে আমার বোনেরও অবদান আছে। ম্যাচ দেখতে পারেনি। তবে গ্রুপ পর্বে দুটি ম্যাচের স্কোরকার্ড ওকে দেখিয়েছিলাম।’

ভারতের ১৭৮ রান ধাওয়া করতে নেমে ১০৬ রানে বাংলাদেশের ৬ উইকেট পড়া দেখে আকবরের মা শাহিদা বেগম টেলিভিশনের সামনে থেকে উঠে গিয়েছিলেন। তখন গোটা বাংলাদেশের মনেই শঙ্কা, বাংলাদেশ পারবে তো? আকবরের মা বসে পড়েন জায়নামাযে ছেলের আর দলের মঙ্গল প্রার্থনায়। 

আগামীনিউজকে শাহিদা বেগম সেই টেনশন মূহুর্তের কথা উল্লেখ করে বলছিলেন, ‘কদিন আগে মেয়ে হারানোর শোক ভুলতে পারছিলাম না। এই বয়সে মেয়েটা আমাদের ছেড়ে চলে গেল। আকবর বাংলাদেশকে জিতিয়ে আমাদের পরিবারের শোক ভুলিয়েছে। মাঝখানে যখন উইকেট পড়ছিল তখন খুব খারাপ লাগছিল। আমি তখন জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে দোয়া করলাম, ‘তুমি সহায় আল্লাহ। আপনি যদি রহমত করেন ইনশাআল্লাহ বাচ্চা আমার কাপ নিয়ে আসবে।’

এরপর কথা না থামিয়ে এক নিঃশ্বাসে আকবরের মা বলে চলেন, ‘নামাজে বসে আল্লাহকে ডেকেছি আর বলেছি, আমরা বড় একটা আঘাত পেয়েছি। তুমি আমাদের সহায় হও। আমার ছেলে যেন বাংলাদেশের জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারে।’ 

শেষ অবধি তাই হয়েছেও। আকবর অপরাজিত ৪৩ রান করে বাংলাদেশকে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন করে তবেই মাঠ ছেড়েছেন। এই বিজয়ে বোনের মৃত্যু শোক কাটিয়ে উঠেছে আকবরের পরিবার। 

এখন আকবরকে কিভাবে তারা ঢাকায় বরণ করতে যাবেন তার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই রংপুর শহরের পশ্চিম জুম্মাপাড়ায় লোকজনের ভিড় লেগেই আছে। খন্ড খন্ড মিছিল আসছে চারদিক থেকে। আকবরকে ঘিরে রংপুর শহরটাই যেন আনন্দের নগরীতে পরিণত হয়েছে। বড় ভাই মুরাদ বলছিলেন, ‘ও এলে আমরা তিন ভাই-ই ঢাকায় যাব রিসিভ করতে। আর রংপুরে এলে কিভাবে রিসিভ করবে সবাই ভাবছে। এটা নিয়ে পাড়ার বড় ভাইরা আলোচনা করছে। তাছাড়া রংপুরবাসি কিভাবে তাঁকে রিসিভ করতে চায় সেটাও একটা ব্যাপার। এগুলো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সবার মাঝে।’

মাথা ঠান্ডা রেখে দলকে জেতানোয় আকবর আলীকে তুলনা করা হচ্ছে ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে। কিন্তু আকবরের পছন্দের ক্রিকেটার কিন্তু ধোনি নন এবি ডি ভিলিয়ার্স। মি. ৩৬০ ডিগ্রিকে আকবর খুবই পছন্দ করেন। মুরাদ বলছিলেন, ‘ওর প্রিয় ক্রিকেটার দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্স। সবসময় ওকেই ফলো করে। ওর সবকিছুই আকবর পছন্দ করে।’ 

ডি ভিলিয়ার্সের দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই দেশ থেকে অমূল্য এক উপহারই নিয়ে আসছেন আকবর। 

আগামীনিউজ/রবিউল/জাকিউল