শিক্ষা ব্যবস্থায় আদিবাসী শিক্ষার্থী: প্রতিবন্ধকতা এবং সম্ভাবনা

প্রত্যয় নাফাক জানুয়ারি ৪, ২০২১, ১২:১৫ পিএম
ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ বাংলাদেশ একটি বহুজাতিগোষ্ঠীর সম্মিলিতো দেশ ।বাঙালি জনগোষ্ঠীর বাইরে ও সরকারি গেজেট ভুক্ত ৫০টি জাতি গোষ্ঠী রয়েছে এবং গেজেট ভুক্ত ছাড়াও প্রায় ৫০টিরও বেশি জনগোষ্ঠী রয়েছে।

অথচ গেজেট ভুক্ত  না হতে পারা জনগোষ্ঠেীর  ও রয়েছে আলাদা ভাষা সংষ্কূতি । যদিও আজকের আলোচনা এই টপিকে না ,শিরোনামে উল্লেখিত আলোচনায় ফিরতে হলে আমাদের বাংলাদেশ সূষ্টির আগে এবং পরের শিক্ষা কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা কিছু আন্দোলন দিকে ফিরে যেতে হবে । যার ফলে হয়তো আলোচনার প্রাসঙ্গীকতা খোজে পাওয়া সহজ হবে।

১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা আন্দোলন ,বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামরিক শাসক আয়ুব খানের শাসন আমলে শরীফ কমিশনের নেতৃত্বে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল।

শিক্ষানীতির বেশ কিছু বক্তব্য তৎকালীন পাকিস্তানের মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় অপ্রসাঙ্গিক ছিল। এগুলোর মধ্যে উচ্চশিক্ষা সংকোচন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বছরে বছরে পরীক্ষা ব্যবস্থা, ৩ বছর মেয়াদি ডিগ্রি পাস কোর্স চালু এবং ছাত্র বেতন বৃদ্ধি প্রস্তাবনা অন্যতম। পরবর্তী ছাত্র আদোলনের হাত ধরে নীতিমালা বন্ধ করো দেওয়া হয়। ৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কারন ছিল শিক্ষার সংকোচন অবস্থা থেকে মুক্তি এবং শিক্ষাকে সার্বজনীন করা।

এবার আসা যাক বর্তমান শিক্ষার অবস্থার দিকে। বর্তমান সময়ে শিক্ষা চলছে ভিন্ন ভিন্ন ধারায়। যেখানে বাম ছাত্র সংগঠন গুলো একই ধারার শিক্ষানীতি দাবী করে আসলেও সরকার কর্ণপাতে নারাজ। ভিন্ন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু হওয়ার কারনে রাষ্ট্রীয় যে মূল ধারার শিক্ষানীতি সেখানে রয়েছে এক বিশাল গলদ। এই গলদের মাশুল গুনতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এবং একূল না অকূল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বাংলাদেশের  বিভিন্ন ভাষাবাসী আদিবাসী জনগোষ্ঠী গুলোকে।

ঠিক কেমন জটিল প্রতিব্ধকতায় পড়তে হচ্ছে আদিবাসী শিক্ষার্থীদের এই আলোচনা বরং সরাসরি করা যাক । বিভিন্ন প্রতিবেদনের দিকে নজর দিলে আপনি কিছু সমীকরন দেখতে পাবেন যেখানে দেখা যাবে  বাংলাদেশ চা  বোর্ড  কর্তুক অনুমোদিত ১৬৬ টি চা বাগান রয়েছে।

লন্ডনভিত্তিক ‘ইন্টারন্যাশনাল টি কমিটি’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায় চা রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান  ৯ম এবং নানা জটিলতার মধ্যেও চা উৎপাদনে বাংলাদেশের যথেষ্ট ভালো । এবার যাদের শ্রমের বিনিময়ে এই উৎপাদন প্রক্রিয়া তাদের বা সেই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের শিক্ষার কি অবস্থা আমরা দেখি।

শ্রম আইন( ২০০৬) র ৯৫ নাম্বার ধারার (খ) তে  বলা হচ্ছে  চা বাগানের শ্রমিকদের ছয় থেকে ১২ বছরের সন্তান যদি ২৫ জনের   বেশি হয় তাহলে উক্ত বাগানে ওই সকল শিশুদের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ৯৭ নাম্বার ধারায় চা শ্রমিক দের সহজ ভাবে দৈননি্দন  প্রয়োজনীয় জিনিস প্রাপ্তির সুবিধার ব্যবস্থা করবে৷

কিন্তু বাস্তব চিত্র কি বলছে আমরা একটু দেখি যেখানে এই সমীকরনের বিপরীতে রয়েছে মাত্র ১০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। অথচ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের শ্রম আইন বা প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সারাদেশ ব্যাপী পরিচালিত বহুল আলোচিত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করন প্রক্রিয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে এই জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থরা।এর বাইরেও রয়েছে সাস্থ্য এবং মানসিক সাস্থ্য থেকে বঞ্চিত হওয়ার পরিসংখ্যান যেখানে  ৫থেকে ১৭ বছর শিশুদের মধ্যে ৫০ ভাগ শিশুয় খর্বকায় মানে বয়স এবং স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার তুলনায় শারিরীক দুর্বল অপুষ্টি জনীত বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছে যা ডেলি স্টারে প্রকাশিত multiple indicator cluster survey র পরিসংখ্যান তাই বলছে। 

এছাড়াও সব থেকে আশংক্জনক পসিংখ্যান হলো সারা দেশে যেখানে শিশু শ্রমের পরিমান ৬ কি ৭ শতাংশ সেখানে চা ব্গানে এর পরিমান ২০ শতাংশ। যার ফলে এই জনগোষ্ঠীর শিশুদের বিভিন্ন উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করতে আসার জন্য যে শারিরীক  মানসিক সাস্থ্যের প্রয়োজন তা থেকে বঞ্চিত হয়ে পিছিয়ে পরছে। এছাড়াও আদিবাসীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য যে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে শুধু মাত্র রাষ্টীয় গেজেট ভুক্ত না হওয়ার কারনে। এবং  ১৬৬ বছরের চা জনগোষ্ঠীদের এই বাংলার ইতিহাসে মাত্র ৪০ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পেয়েছে ।এই হলো মোটামুটি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়  চা জনগোষ্ঠীদের শিক্ষা ব্যবস্থা ।

এই পরিসংখ্যান গুলো  শুধু মাত্র চা জনগোষ্ঠীদের নিয়ে হলেও এই চিত্র সারাদেশে বসবাসরত বাকি আদিবাসী  জনগোষ্ঠীদেরো। আমরা যদি সমতলে বসবাস রত  গারো সাওতাল মুন্ডা মাহালী ওড়াও হাজং সহ ৩৫ টির মত জনগোষ্ঠীর প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় অবস্থানগত জায়গা দেখি তাহলে দেখতে পাবেন স্কুল সংকট ,শিক্ষক সংকট ,ভাষাগত জটিলতা এইসব নানাবিধি সমস্যায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর  শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে যচ্ছে।

আদিবাসীদের শিক্ষার এই প্রতিবন্ধকতার  পেছনে শুধু রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার অভাব নাকি রাষ্ট্র কতৃক গৃহীত বিভিন্ন পলিসিও যুক্ত রয়েছে আলোচনার খাতিরে এই বিষয় ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। এই বিষয়ের উপর আলোচনা করতে গিয়ে স্পষ্ট  ভাবে চোখ রাখতে হচ্ছে  পার্বত্য চট্টগ্রামের দিকে যেখানে পরগাছার মত করে পাহাড়ি জমি দখল করার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে পর্য়টন কেন্দ্র ,যার ফলে শুধু ভুমি হারা না সরাসরি ভাবে পাহাড়ের শিক্ষার্থীদের কতটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

সাজেক সরকারি প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষিকার সাথে আলোচনায় উঠে আসে এই অপরিকল্পীত পর্য়টনের ফলে পাহাড়ি শিক্ষার্থীরা স্কুল বিমুখ হচ্ছে। গাইডের নামে এই পাহাড়ি শিশুদের ২০ টাকা ৩০ টাকায় পর্যটক দের গাইড হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং পর্যটন কেন্দ্রের রাস্তা গুলোতে চিড়িয়াখানার জন্তুদের মত করে পাহাড়ি শিশুদের দিকে ছুড়ে মারা হয় চকলেট যার ফলে শিশু সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় উদ্দেশ্যমূলক  এবং পর্যটক দের দাসত্ব মুলক আচরনের শিকার হচ্ছে পাহাড়ের এই আদিবাসী শিশুরা। বিকাশের সময়টাতেও অপরিকল্পীত পলিসির ফাঁদে পরতে হচ্ছে পাহাড়ের আদিবাসী ‍শিশুদের।

আবার  জাতীয় বাজেটের শিক্ষাখাতে কেমন বরাদ্দ আসছে এসবের দিকে নজর দিলে দেখতে পাবেন গত ২০১৯- ২০ অর্থ বছরে তুলনায় ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে প্রস্তাবিত বাজেটের পরিমান ৫ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা বেড়েছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ২৪ হাজার ৯৩৭ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ৩৩ হাজার ১১৮ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় বিভাগের জন্য ৮ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়।

বছরের পর বছর ধরে শিক্ষাখাতে বাজেটে আত্মতৃপ্তি পেলে চলবে না কারন ঘুরে ফিরে মোট বাজেটের ১১-১২ শতাংশের মধ্যে বিদ্যমান যার হওয়ার কথা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ  এবং মোট জিডিপির ৬ শতাংশ যেখানে আছে ২.০৯ শতাংশ। এর মাঝেও রয়েছে কিছু শুভংকরের ফাঁকি ,  অর্থমন্ত্রী বলছে  সরকারের ২৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ বাস্তবায়ন করবে । 

কিন্তু এর মধ্যে শিক্ষাবহির্ভূত খাতের বরাদ্দও আছে । যেহেতু বাজেট মন্ত্ররালয় ধরে হয় সেখানে  শিক্ষা খাতে কেন আলাদা বরাদ্দ রাখবে  না এই প্রশ্ন রাখা যায় । খোজ নিলে দেখা যাবে  গত বছর থেকে সরকার বাজেট বরাদ্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগকে যুক্ত করে বরাদ্দের হিসাব করছে যা সম্পূর্ণ অযোক্তিক। এছাড়াও শিক্ষা  খাতের দুই তৃতীয়াংশ ব্যয় হচ্ছে শিক্ষকদের বেতন খাতে আার মাত্র এক শতাংশ ব্যয় হচ্ছে শিক্ষার্থীর পেছনে।

২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট পেশ করা হয়েছে সেখানে আদিবাসী বা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ ৮০ কোটি টাকা যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিলো ৫০ কোটি টাকা।এত অল্প বাজেটে ৩০ লাখ জনগোষ্ঠীর অন্যান খাতের পাশাপাশি আলাদা ভাবে শিক্ষা খাতে উন্নয়নের কতটুকু সুযোগ রয়েছে প্রশ্নের দাবী রাখে।

আইএলও কনভেশন আদিবাসী ও ট্রাইবাল জনগোষ্ঠী কনভেনশন  ১৯৫৭ ও ১৯৮৯ এর ষষ্ঠ অংশ  অনুচ্ছেদ  ২৮  এ বলা আছে এই সকল জনগোষ্ঠীদের স্ব স্ব মাতৃভাষায়  শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে এবং সকল প্রকার সহযোগিতা রাষ্ট্রকে গ্রহন করতে হবে।  ২০১০ সালের শিক্ষানীতি তে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিজস্ব মাতৃভাষায় পাঠদানের কথা বলা হলেও এপর্যন্ত চালু হয়েছে মাত্র ৬টি ভাষায় শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু দক্ষ শিক্ষকের অভাব ,বাজেটের সল্পতা  ইত্যাদি কারনে কচ্ছব গতিতে আগাচ্ছে কাজ।

বর্তমান সময়ে  বহুল আলোচিত চিম্বুকে  ম্রোদের জমিতে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মান কে কেন্দ্র করে যে সংকট যেখানে কয়েকটি গ্রাম মিলেও একটি সরকারি বা বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই বা আপনি যদি দেখেন সাজেকের স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীদের  যেখানে ছোট ছোট শিশুরা প্লে কার্ড হাতে বলছে আমাদের মসজিদ না স্কুল চায় ,এইসকল প্রতিবন্ধকতার মধ্যে আদিবাসী শিক্ষার্থীরা কতটা  মৌলিক শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে বা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে প্রশ্নের বিষয়।

সম্ভাবনা –

আলোচনার একটা বিশাল অংশ জোড়ে প্রতিবন্ধকতার কথা বলা হলেও আমাদের আদিবাসী শিক্ষার্থীদের সম্ভাবনার দিকে যথেষ্ট নজর দিতে হবে বা যে পদক্ষেপ গুলো রাষ্ট্র  কর্তৃক গৃহীত হলে এই বঞ্চিত শিক্ষার্থীরা সম্ভাবনার মুখ দেখবে। সম্ভাবনার কথা বলতে গেলেই প্রথমে ন্যাশন স্টিট এর ধারনা থেকে বেড়িয়ে এসে বাংলাদেশের সকল জাতি গোষ্ঠীর যে সাংবিধানিক স্বীকৃতি তা নিশ্চিত করতে হবে। 

আদিবাসী শিক্ষার্থীদের শিক্ষায় যে মূল প্রতিবন্ধকতা তা হলো নিজ মাতৃভাষায় এবং নিজনিজ সামাজিক সাংস্কৃতিক শিক্ষা নিশ্চিত না করা যার ফলে সম্ভাবনা দেখতে হলে রাষ্ট্রকে ন্যাশনাল ট্রাস্কোর্স গঠন করে এই অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ২০১০ শিক্ষানীতিতে যে সুবিধার কথা বলা হয়েছে  সেই সুবিধা গুলোকে অধিকারে রুপান্তর করতে হতে।

দেশে যে ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষা নীতি চালু রয়েছে এই ব্যবস্থাকে ভেঙে একই ধারার শিক্ষা নীতিতে রুপান্তর করতে হবে। চাকরি মুখি বা পন্য মুখী শিক্ষা না করে মানবিক এবং মৌলিক ‍শিক্ষায় রুপান্তর করতে,আদিবাসী শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিশ্চিত করতে  গিয়ে আলাদা ভাবে গবেষণা করতে হয় বা নজর দিতে হয় তা রাষ্ট্রকে নজর দিতে হবে। সাথে শিক্ষাখাতে আর্থিক বাজেট বৃদ্ধির পাশাপাশি সঠিক খাতে ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে।

লেখকঃ সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ

আগামীনিউজ/প্রআ