মামুনুল হক উধাও: মামলা ও গ্রেফতারের জালে ঘেরাও হেফাজত

প্রভাত আহমেদ এপ্রিল ১৩, ২০২১, ০২:৪৯ পিএম
ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের সহিংসতার ঘটনায় ধর্মীয় সংগঠনটির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে প্রশাসন। নেতাদের গ্রেপ্তার আর সংগঠনের সহিংসতা বন্ধে চারপাশ থেকে ঘিরে আসছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পুরোনো মামলা নতুন করে সচল এবং সাম্প্রতিক বিভিন্ন সহিংস ঘটনায় মামলা-গ্রেপ্তারে বহুমুখী চাপে পড়েছে হেফাজতে ইসলাম। গুঞ্জন আছে হেফাজতে ইসলামের আলোচিত-সমালোচিত কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক গ্রেপ্তার হতে পারেন যেকোনো সময়।

সূত্রে জানা যায়, মামুনুল ঘর ছেড়েছেন বেশ কয়েকদিন আগে, তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন বলে জানা গেছে, তবে মামলা ও গ্রেফতারের ভয়েই কি মামুনুল ঘর ছেড়ে উধাও?

হেফাজতে ইসলামের নেতারা দাবি করছেন, সরকার তাদের বিপদে ফেলতে ও আন্দোলন থেকে বিরত রাখতে একের পর এক মামলা আর গ্রেপ্তারের জালে ফেলেছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ড থেকে সরকারকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তারা বলছেন, এ নিয়ে তারা বসে শিগগির কর্মসূচি জানাবেন।

হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকের বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা হয়েছে। সাত বছর আগে রাজধানীর মতিঝিলে জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে। তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে।

হেফাজত ইসলামের সাবেক আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পিবিআই। প্রতিবেদনে হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীসহ ৪৩ জনের নাম রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে একটি রিসোর্টে মামুনুল হক কাণ্ডে সেখানে ভাঙচুরের অভিযোগ করা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে হেফাজতের নেতা মাওলানা ইকবাল, মাওলানা মহিউদ্দীন, মাওলানা শাহজাহান শিবলী ও মাওলানা মোয়াজ্জেমকে। দুই মামলায় এই চারজনকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্যের জেরে ময়মনসিংহে ওয়াসিক বিল্লাহ নোমানীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আর হেফাজতের পক্ষে সোচ্চার থাকা কথিত ‘শিশুবক্তা’ রফিকুল ইসলাম মাদানীকে গ্রেপ্তারের পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সে এখন কারাগারে।

এসব মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হেফাজতে ইসলামের নেতারা। পুলিশ বলছে, নতুন ও পুরোনো মিলিয়ে প্রায় ১৬০ মামলায় হেফাজতের লাখের বেশি নেতাকর্মী আসামি হয়েছে।

গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরুদ্ধে বায়তুল মোকাররমে আন্দোলন ও সহিংসতার ঘটনায় হেফাজত নেতা মামুনুল হকসহ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। রাজধানীর কয়েকটি স্থানসহ দেশের চারটি জেলায় অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, অস্ত্র লুটসহ নাশকতার অভিযোগে হেফাজতে ইসলামের ৫০ হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে প্রায় ৮০টি মামলা করা হয়েছে।

পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ বাদী হয়ে দায়ের করা এসব মামলায় হেফাজতের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও সাধারণ কর্মীরা আসামি হয়েছে। যার মধ্যে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা রয়েছে। আসামির তালিকায় মদতদাতা হিসেবে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মীদের নামও রয়েছে।

আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, হেফাজতে ইসলামকে আর ছাড় দেওয়া যাবে না। রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে হবে। হেফাজতের নাশকতা, নারী কেলেঙ্কারি এসবের বিরুদ্ধে পাড়া-মহল্লায় জনমত গঠন করতে হবে।

নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া পুলিশ দাবি করছে, মামলার আসামিদের ধরতে অভিযান চলছে। একাধিক মামলার আসামি হেফাজতের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে ধরতে সরকারের সবুজ সংকেত পেয়েছে পুলিশ। এছাড়া ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর কাণ্ডে হেফাজত নেতাকর্মীদের নামে দায়েরকৃত ৮৩টি পুরোনো মামলার তদন্ত শেষ করে বিচার দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নিয়েছে পুলিশ। এসব মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়।

সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দায়েরকৃত ৪৮টি মামলায় হেফাজতের ৩০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় ৬টি, নারায়ণগঞ্জ জেলার তিন থানায় ১৬ মামলা, ঢাকার পল্টন থানার দুটি ও মতিঝিল থানার দুই মামলায় আসামি প্রায় ২০ হাজার।

এদিকে মামুনুল হকের সোনারগাঁও রিসোর্ট কাণ্ডের পর সেখানে হামলা চালায় সংগঠনের নেতাকর্মীরা। রিসোর্টে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ছাড়াও শীর্ষ এই নেতার (মামুনুল) বিরুদ্ধে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় অন্তত চারটি মামলা হয়েছে৷ এর আগে তার বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা রয়েছে বলে জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।

হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফায়েজি বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হয়েছিল। এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির সহ অর্থসম্পাদক ও ঢাকা মহানগরী কমিটির সহসভাপতি মুফতি ইলিয়াস হামিদিকে আটক করা হয়েছে। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে রয়েছেন। তাছাড়া নারায়ণগঞ্জের চারজন নেতাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। হেফাজতের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ওয়াসিক বিল্লাহ নোমানীকে রবিবার ময়মনসিংহ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একই দিন নারায়ণগঞ্জে আরো দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

প্রচার সম্পাদক মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফায়েজি বলেন, ‘আমরা মনে করছি এগুলো হয়রানিমূলক গ্রেপ্তার। আমাদের যে আন্দোলন চলছিল, সেটা দমন ও ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে চাপে রাখা হচ্ছে। সেই চেষ্টাই সরকার চালাচ্ছে। না হলে অনেক পুরোনো মামলা তারা নতুন করে কেন সচল করছে। যেগুলো সবই হয়রানির উদ্দেশ্যে আর আন্দোলন বন্ধ করার জন্য হচ্ছে।’

দ্রুতই বসে কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে জানিয়ে সংগঠনটির এই নেতা বলেন, ‘আমরা রবিবার মিটিং শেষেও আহ্বান জানিয়েছি, যারা কারাবন্দি হয়েছে তাদের দ্রুত মুক্তি দিতে হবে। আর হয়রানিমূলক যে মামলা হয়েছে, সেগুলো বাতিল করতে হবে। কিন্তু এসব দাবি সরকার শুনছে না। বরং অনেক কেন্দ্রীয় নেতাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমরা দ্রুত বসে এসব বিষয়ে জানাব।’

সংগঠনটির অন্যতম নেতা মামুনুল হককে যেকোনো সময় গ্রেপ্তার করা হতে পারে বলে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। বৃহস্পতিবার ফেসবুক লাইভে এসে মামুনুল হক বলেন, ‘স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করতে, স্ত্রীকে খুশি করতে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে কোনো সত্যকে গোপন করারও অবকাশ রয়েছে। আমি একাধিক বিয়ে করেছি। ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী ও বাংলাদেশের আইনে একাধিক বিয়ের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। একজন পুরুষ চারটি বিয়ে করতে পারেন। চারটি বিয়ে করলে কার কী? যারা আমার ব্যক্তিগত আলাপ, কথা জনসম্মুখে এনেছেন; তাদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা করব। তবে ওই দিন অসাবধানতা ও নিজস্ব নিরাপত্তা না নিয়ে রয়্যাল রিসোর্টে ঘুরতে যাওয়া উচিত হয়নি। ব্যক্তিগত অসাবধানতা ও পদক্ষেপ না নেওয়ায় আমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।’

অপরদিকে ‘শিশুবক্তা’ হিসেবে পরিচিত রফিকুল ইসলাম মাদানীকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গাজীপুরে তার মাদ্রাসাটিতেও তালা ঝুলছে। মাদানীকে গত বুধবার নেত্রকোনায় তার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তারের পর বৃহস্পতিবার তাকে গাজীপুরের গাছা থানায় হস্তান্তর করে র‌্যাব। গত ১০ ফেব্রুয়ারি এক ওয়াজ মাহফিলে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়।

তার এই উসকানিমূলক বক্তব্যের ফলে ২৬ মার্চ ঢাকায় বায়তুল মোকাররম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, নাশকতা ও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ সংঘটিত হয়- দাবি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

আগামীনিউজ/প্রভাত