যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল, যন্ত্রপাতি থাকলেও জনবল নেই

বেনাপোল প্রতিনিধি জুন ১৭, ২০২৩, ১১:৩৭ পিএম
ফাইল ছবি

যশোরঃ যশোর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের নব নির্মিত ১০ বেডের আইসিইউ ও ২০ বেডের আইসোলেশন ওয়ার্ডের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সহায়ক সামগ্রী স্থাপন করা হলেও জনবল সংকটে চালু করা যাচ্ছে না। তবে জনবল চেয়ে প্রকল্প পরিচালকের কাছে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। জনবল সংকট কেটে গেলে আইসিইউ’র পূর্ণাঙ্গ সুবিধা দেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

হাসপাতাল সূত্র মতে, গতমাসের তিন তারিখে নবনির্মিত আইসিইউ ওয়ার্ডের জন্য জনবল চেয়ে প্রকল্প পরিচালকের কাছে হাসপাতালের তত্ত্বাধায়ক স্বাক্ষরিত একটি পত্র পাঠানো হয়েছে। ওই পত্রে আইসিইউ চালুর জন্য ১০ জন চিকিৎসক, ২০ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স দরকার বলে উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও ওয়ার্ড বয়, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী আটজন এবং চারজন গার্ড চাওয়া হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে করোনারি কেয়ার ইউনিটের চতুর্থ তলায় আইসিইউ ও আইসোলেশন ওয়ার্ড প্রস্তুত করে গণপূর্ত বিভাগ। সেই সাথে সকল যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সহায়ক সামগ্রী স্থাপন করা হয়।

 

হাসপাতালের প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, নতুন এ ওয়ার্ডে থাকবে ১০টি আইসিইউ বেড, ২০টি থাকবে আইসোলেশন বেড, চিকিৎসক ও নার্সদের বসার কক্ষ, অক্সিজেন, নেবুলাইজার এবং ভেন্টিলেটরসহ বিভিন্ন উপকরণ। সম্পূর্ণ ওয়ার্ড শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের জন্য লাগানো হয়েছে ২০টি এসি। লিফট সুবিধাও থাকবে।

এ ব্যাপারে যশোর মেডিকেল কলেজের এনেসথেসিয়া ও আইসিইউ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এএইচএম আহসান হাবিব বলেন, আর্টিফিসিয়াল শ্বাস-প্রশ্বাস চালানোর জন্য ভেনটিলেটর মেশিন, অটোমেটিক শিরিঞ্জ পাম্প মেশিন, কার্ডিয়াক মনিটর স্থাপন করা হয়েছে। এখানে পালস, প্রেসার, অক্সিজেন সেচুরেশন এবং ইসিজি করা যাবে। ৬০ থেকে ৮০ লিটার পার মিনিটে অক্সিজেন সাপ্লাই দেওয়ার জন্য হাইফ্লোনেজাল ক্যানোলা স্থাপন, শ্বাসনালী পরিস্কার করার জন্য সাকার মেশিন, শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক রাখার জন্য বিপেপ এবং সিপেপ, হঠাৎ বন্ধ হওয়া হার্টকে শক দিয়ে সচল করার জন্য ডিফিব্রিলেটর স্থাপন এবং প্রতিটি বেডের বিপরীতে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন, একটি ইয়ার ও একটি ভ্যাকিউম লাইন সংযোগ দেওয়া আছে।

ফলে এখন থেকে আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন এমন রোগীকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর বাইরের কোন হাসপাতালে যেতে হবে না। ১০ বেডের কোভিড ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) প্রস্তুত করার জন্য সরকারের বরাদ্দের পাশাপাশি স্থানীয় সহায়তায় প্রায় সোয়া কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবে শুধুমাত্র এবিজি ম্যাশিনের রিএজেন্ট ঘাটতি রয়েছে বর্তমানে।

এদিকে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশীদ বলেন, যে আইসিইউ আছে সেটা একেবারে জাতীয়মানের। এখানে শুধুমাত্র হাইফ্লো অক্সিজেন নয় উন্নত মানের ন্যাজাল ক্যানোলা ও আধুনিক মেশিনসহ জরুরি প্রয়োজনে সব সেবা দেয়া সম্ভব। তবে রয়েছে জনবল ঘাটতি, বর্তমানে চিকিৎসক রয়েছেন সাত জন। এরমধ্যে দুইজন কোভিট প্রজেক্টের, সিনিয়র স্টাফ নার্স রয়েছেন ১৬ জন। এরমধ্যে তিনজন কোভিট প্রজেক্টের নিয়োগ প্রাপ্ত। এছাড়াও ওয়ার্ড বয়, আয়া, গার্ড ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী রয়েছে ১৩ জন। এরমধ্যে তিনজন কোভিট প্রজেক্টের নিয়োগ প্রাপ্ত, বাকিদের হাসপাতালের নিজস্ব অর্থায়ন থেকে বেতন দেওয়া হয়। আইসিইউ ওয়ার্ডের জনবল পেলে সেবার মান আরোও বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশাবাদী। এছাড়াও তিনি বলেন, জনবল চলে আসলে ও নব নির্মিত আইসিইউ ওয়ার্ডটি চালু হলে দক্ষিণবঙ্গের মধ্যে সেরা আইসিইউ ওয়ার্ডে রূপান্তরিত হবে এটি। তখন এ জেলার পাশাপাশি আশেপাশের জেলা থেকে রেফার হয়ে আসা রোগীদের আইসিইউ সেবা নিতে আর খুলনা বা ঢাকায় দৌড়াতে হবে না।

জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতিতে গত ২০২০ সালের মে মাসে হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ওয়ার্ড করার জন্য ১০ টি ভেন্টিলেটর চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় কর্তৃপক্ষ। ওই বছরের জুন মাসে মন্ত্রণালয় ৬ টি ভেন্টিলেটর বরাদ্দ পায়। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে ৬টি ভেন্টিলেটর হাসপাতালে এসে পৌঁছায়। অক্টোবর মাসে আইসিইউ ওয়ার্ড প্রস্তুত হয়ে যায়। পরে দক্ষ চিকিৎসক, সেবিকা, ৬টি শয্যা, মনিটর, অক্সিজেন, পাইপ লাইনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি বরাদ্দের ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রনালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়। নভেম্বর মাসে পাঁচটি বেডের বরাদ্দ পাওয়া যায়। এরপর ২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য তিনটি শয্যায় আইসিইউ সেবা চালু করা হয়। বর্তমানে সরকারি বেসরকারি সহায়তায় আইসিইউতে দশটি ও আংশিক সুস্থ হলে এইচডিইউতে নেওয়া হয়। সেখানে রয়েছে ছয়টি এইচডিইউ শয্যা চালু রয়েছে। হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়কের প্রস্তাবে ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জেলা হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় করোনায় আক্রান্ত ছাড়াও সাধারণ রোগীরা আইসিইউ সেবা পাবেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইসিইউতে রোগী ভর্তি ফি বাবদ এক হাজার টাকা ও প্রতিদিন শয্যা ভাড়া বাবদ পাঁচশত টাকা নির্ধারণ করা হয়।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আইসিইউ ও এইচডিইউতে ৮ রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এরমধ্যে আইসিইউতে পাঁচজন ও এইচডিইউতে তিনজন। হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ২৮ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩১ জন, মার্চ মাসে ২৫ জন, এপ্রিল মাসে ৪১ জন, মে মাসে ৩৯ জন ও ১৪ জুন পর্যন্ত ১৯জন রোগী আইসিইউ ও এইচডিইউ থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন।

সদরের সাতমাইল এলাকার রহমতুল্লাহের ছেলে ঈমানুদ্দীন বলেন, আমার পিতা একজন হার্টের রোগী। তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে প্রথমে হাসপাতালের করোনারি ওয়ার্ডে ভর্তি করি। সেখানে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে অনেক চেষ্টা করেছেন ডাক্তাররা। পরে অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালের আইসিইউতে নিয়ে যায়। সেখানে বেশ উন্নত চিকিৎসা পাচ্ছেন তিনি। তিনি এখন আগের চেয়ে সুস্থ আছেন। হাসপাতালের আইসিইউর কারণে আমার পিতাসহ অনেকের জীবন রক্ষা পাচ্ছে।

শহরের রেলগেট এলাকার ফরহাদ হুসাইন নামে একজন ব্যবসায়ী জানান, ঢাকাতে আমার মাকে চারদিন আইসিইউতে চিকিৎসা দেওয়ার পর বিল এসেছিল সাড়ে তিনলাখ টাকা। বর্তমানেও দেশের যে কোন জায়গায় এরকম আইসিইউ সেবা নিলে দৈনিক কমপক্ষে লাখ টাকার উপরে বিল আসবে। সেখানে প্রায় বিনামূল্যে সেবা পাচ্ছেন এখানকার মানুষ এটা খুবই ভালো বিষয়। তিনিও দাবি করেন, এটি জাতীয় মানের আইসিইউ।

হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ ডা. মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, আমাদের আইসিইউতে রোগী আনার পর রোগীর স্বজনদের আর চিন্তা করতে হয়না। সমস্ত দায়িত্ব আমাদের সেবাকর্মীরা নিচ্ছেন। ভেতরে রোগীর যাবতীয় অসুবিধা আমাদের স্বাস্থ্যকর্মীরা দেখভাল করছেন। অনেক সময় রোগী এমনকি পায়খানা প্রস্রাব করলেও সেগুলোও পরিস্কার করে দিচ্ছেন। আমার মতে, এখানে যে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং সেবা আছে যা অন্য কোথাও নেই।

জেলা সিভিল ডা. বিপ্লব কান্তি বিশ্বাস  জানান, আইসিইউ সেবা চালুর করায় কম খরচে রোগীরা সঠিক সময়ে সঠিক সেবা পাচ্ছেন। এতে হয়রানি ও আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন অনেকে। তিনি আরোও বলেন, নতুন আইসিইউ ওয়ার্ডের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। সব ধরনের সুযোগ, সুবিধা এখানে থাকবে। যেহেতু প্রয়োজন হচ্ছে না তাই আগের টাই চালু রয়েছে। তবে প্রয়োজন হলে নতুনটাও চালু করা হবে। এখন অপারেশন পরবর্তী কোন রোগীর আইসিইউ সেবার প্রয়াজন হলে তাৎক্ষণিক সুযোগ পাচ্ছেন সরকারি এই হাসপাতালে। দায়িত্বরত চিকিৎসক ও সেবিকারা রোগীর চিকিৎসাসেবায় সব সময় আন্তরিক।

শুধুমাত্র করোনা রোগীদের কথা মাথায় রেখে এ ওয়ার্ড নির্মাণ হলেও মুমূর্ষু সকল রোগীর জন্য ব্যবহৃত হবে। তবে জনবলের ঘাটতির জন্য কিছুটা দেরি হচ্ছে। চাহিদাপত্র দেয়া হয়েছে অতি শিঘ্রই পেয়ে যাব বলে আশা করছি। 

 

মনির হোসেন/এমআইসি