ভোলায় ৬৮ শতাংশ জমি আসপিয়ার পরিবারের!

নিজস্ব প্রতিবেদক ডিসেম্বর ১১, ২০২১, ০২:০৮ পিএম
ছবিঃ সংগৃহীত

বরিশালঃ পুলিশের প্রতিবেদনে ‘স্থায়ী ঠিকানাবিহীন ও ভূমিহীন’ আসপিয়া ইসলাম কাজল কনস্টেবল পদে নিয়োগ পাবেন কিনা তা নিশ্চিত না হলেও তিনি তার জন্মস্থান বরিশালের হিজলাতে জমি ও ঘর পাচ্ছেন। এক খণ্ড জমি না থাকায় যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েও আসপিয়া চাকরি পাচ্ছেন না-এমন খবরে প্রশাসন তাকে জমি ও ঘর দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। বিষয়টি নজরে আসায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহানুভূতিশীল হয়ে তাকে জমি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। 

এ নির্দেশ পাওয়ার পর হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুক্রবার আসপিয়ার বর্তমান আবাসস্থল হিজলার খুন্না গোবিন্দপুরে যান। সেখানে তিনি আসপিয়ার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। আসপিয়ার পরিবারকে জমি ও ঘর দেওয়ার জন্য তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। 

এদিকে আসপিয়ার চাকরি না হওয়ার ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টির মুহূর্তে জানা গেছে-তার পরিবার ভূমিহীন নয়। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় আসপিয়ার দাদাবাড়িতে তাদের ৬৮ শতাংশ জমি রয়েছে। প্রতিবছর ওই জমি বর্গা দিয়ে তার মা টাকা আনেন। এদিকে কনস্টেবল পদে তার চাকরি পাওয়ার গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আসপিয়ার চাকরি পাওয়ার গুজব ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লেও এ রকম কোনো নির্দেশনা পাননি বলে জানিয়েছেন বরিশালের পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন।

বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। শুক্রবার আসপিয়ার বাড়িতে হিজলার ইউএনও বকুল চন্দ্র কবিরাজকে পাঠানো হয়েছে। আসপিয়ার পরিবার বর্তমানে হিজলার যে জায়গায় থাকে সেখানেই যাতে তাকে সরকারিভাবে জমি এবং ঘর করে দেওয়া যায় সেভাবেই চেষ্টা করছি আমরা।’

হিজলা ইউএনও বকুল চন্দ্র কবিরাজ জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে চলমান আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় আসপিয়ার পরিবারকে ঘর ও জমি দেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, নিয়োগের সময়সীমা কতদিন তা জানি না। তবে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সেই সময়সীমার মধ্যে তার বা তার মায়ের নামে জমি ও ঘর হস্তান্তর করার চেষ্টা করব।

আসপিয়ার পুলিশে চাকরি হয়েছে-এমন তথ্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও বিষয়টি গুজব বলে আসপিয়া নিজেই জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, আমার চাকরি হয়েছে-এমন পোস্ট ফেসবুকে দেখেছি। সাইবার-৭১ নামের একটি আইডি থেকে আমার চাকরি পাওয়ার পোস্ট দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এ সংশ্লিষ্ট কোনো চিঠি বা খবর আমি পাইনি।

জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় আসপিয়াদের ৬৮ শতাংশ জমি রয়েছে। প্রতিবছর ওই জমি বর্গা দিয়ে তার মা ঝরনা বেগম টাকা আনেন। হিজলা উপজেলার ভাড়াটিয়া বাসায় আসপিয়ার বাবা শফিকুল ইসলাম মারা গেলে তার লাশ চরফ্যাশনে দাদাবাড়িতে দাফন করা হয়। এ ব্যাপারে যুগান্তরকে আসপিয়া বলেন, ‘দাদাবাড়িতে কী আছে না আছে তাই নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। বহু বছর ধরে বরিশালের হিজলা উপজেলায় বসবাস করছি। এখানেই স্থায়ী হতে চাই। যেহেতু এখানে আমাদের কোনো জমি নেই। তাই স্থায়ী ঠিকানা নেই বলে জানিয়েছি। হিজলায় যে আমরা ভূমিহীন সেটা তো মিথ্যা নয়।’

বরিশালে বৃহস্পতিবার নাগাদ আসপিয়াকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে সব পর্যায়ে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ভূমিহীন হওয়ার কারণে চাকরি হচ্ছে না এ রকম একটি অভিযোগ আসপিয়া গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তুলে ধরেন। এর আগে বরিশাল জেলা পুলিশ লাইন্সের সামনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। ভূমিহীন হওয়ার কারণে স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় তার চাকরি হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তিনি নাগরিক অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। মুহূর্তে এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা প্রচার করেন সচিত্র সংবাদ। নেট দুনিয়ায় বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় উঠলে স্থানীয় পুলিশ বিভাগও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে। 

সংবাদকর্মীদের কাছে আসপিয়া দাবি করেন, হিজলা উপজেলার খুন্না গোবিন্দপুর এলাকায় তাদের বসবাস। সেখানে মেজবাহ উদ্দিন অপু চৌধুরীর বাড়িতে ভাড়া থাকে তার পরিবার। বাবা শফিকুল ইসলাম মারা গেছেন। এক ভাই, দুই বোন আর মাকে নিয়ে বহু কষ্টে চলে তার পরিবার। ভাই চাকরি করে ঢাকার একটি গার্মেন্ট কারখানায়। একজনার আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে তার পরিবার। তাই চাকরি পাবেন বলে তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশনে জাতীয় পরিচয়পত্রে দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী হিজলায় তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা না পাওয়ায় তার চাকরি হচ্ছে না। এ তথ্য ভেরিফিকেশনে যাওয়া হিজলা থানা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর আব্বাস উদ্দিন জানিয়েছেন বলে দাবি করেন আসপিয়া। এরপর তিনি ছুটে আসেন বরিশালে। পুলিশ লাইন্সের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে ছুটে যান পুলিশ সুপার এবং রেঞ্জ ডিআইজির অফিসে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আসপিয়ার দাদাবাড়ি চরফ্যাশন উপজেলার ৫নং আমিনাবাদ ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের হালিমাবাদ গ্রামে। তার বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের বসবাসও ছিল সেখানে। কাজের সূত্রে হিজলা উপজেলায় এসে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন আসপিয়ার বাবা শফিকুল ইসলাম। এখানে আসপিয়ার জন্ম হলেও দাদাবাড়ির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং আসা-যাওয়া রয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের। 

যেভাবে ‘ভূমিহীন’ হলো আছপিয়ার পরিবার

পুলিশ তদন্তে স্থায়ী আবাস না পাওয়ায় চাকরি নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হওয়া আছপিয়া ইসলাম কাজলের ‘ভূমিহীন’ হওয়ার গল্পটি জানিয়েছেন তার চাচা মোশারেফ হোসেন মাতবর। 

তিনি জানান, আছপিয়ার মা-বাবা পরিবারের অমতে বিয়ে করায় মূলত দূরত্বের সৃষ্টি হয়। আছপিয়ার বাবা মৃত শফিকুল ইসলাম ছিলেন জেদি প্রকৃতির মানুষ। সে কারণে তিনি লড়াই করে পরিবারে ফিরে যাননি। তাছাড়া আছপিয়ার দাদার আট সন্তানের জন্য যে জমি বর্তমানে রয়েছে ভাগ বাটোয়ারার পর ১০ শতাংশেরও কম পাবেন আছপিয়ার ভাই-বোন।

আছপিয়া ইসলাম স্বীকার করেছেন ভোলা জেলার চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের মৃত মকবুল হোসেন মাতবর তার দাদা এবং ব্যবসায়ী মোশারেফ হোসেন মাতবর তার আপন চাচা।

মোশারেফ হোসেন শনিবার (১১ ডিসেম্বর) সকালে বলেন, আমার বাবা মরহুম মকবুল হোসেন মাতবর ব্যবসায়ী ছিলেন। আমরা আট ভাই-বোন। এর মধ্যে ছয়জন ভাই ও দুই বোন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই আমির হোসেন মাতবর ছিলেন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের প্রকৌশলী এবং তারপরের জন হেলাল উদ্দিন মাতবর ছিলেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের থানা ইঞ্জিনিয়ার। এরপর আমি। তারপর আছপিয়ার বাবা মৃত শফিকুল ইসলাম। এরপরের ভাই অহিদুল ইসলাম মাতবর। সবার ছোট ছিলেন মৃত নিজাম মাতবর। এছাড়া আরও দুই বোন আছে আমাদের। 

মোট জমি কত আছে?

মোশারেফ হোসেন মাতবর বলেন, আমার বাবার মোট তিন কানি জমি ছিল। তবে বড় ভাই আমির হোসেন ও মেজ ভাই হেলাল উদ্দিনকে লেখাপড়া করাতে গিয়ে ফসলি সব জমি বিক্রি করে দেন। শেষে বাড়িতে ৬৪ শতাংশ জমি রয়েছে আট ভাই-বোনের জন্য। এর মধ্যে আছপিয়ার বাবার ভাগে পড়েছে ১০ শতাংশ যা থেকে পুকুর, কবরস্থান, হাঁটারপথের জমি বাদ দিয়ে ১০ শতাংশেরও কম পাবে। এই ১০ শতাংশেরও কম জমি মৃত শফিকুলের তিন মেয়ে এক ছেলে পাবে।

তিনি আরও বলেন, ওরা বাড়িতে খুব একটা আসে না। সর্বশেষ পাঁচ মাস আগে ঝরনা বেগম (আছপিয়ার মা) এসেছিলেন বড় ভাবির মৃত্যুতে। এক বছর আগে মেজ ভাবির মৃত্যুতে আরেকবার এসেছিলেন। এছাড়া শফিকুল বেঁচে থাকতে এক-দুই বছর পরপর ১-২ দিনের জন্য বাড়িতে আসত।

কেন এই দূরত্ব?

মোশারেফ হোসেন মাতবর বলেন, আমার বড় ভাই আমির হোসেন মাতবর তখন হিজলা উপজেলা গণস্বাস্থ্য প্রকৌশলী। সেখানে বাসা ভাড়া করে থাকতেন। বড় ভাইয়ের সঙ্গে শফিকুল থাকত। ১৯৯০ কিংবা ১৯৯১ সালে বড় ভাই বদলি হয়ে পিরোজপুরে যান। সেখানে তার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত ঝরনা বেগম। ঝরনা বেগমের বাড়ি পিরোজপুর সদরেই। ওই বাসায় থেকে শফিকুল ও ঝরনার মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তারা দুজনে পালিয়ে হিজলা চলে গিয়ে বিয়ে করে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের পরিবার চরফ্যাশনের প্রভাবশালী না হলেও বেশ সম্মানিত ছিল। সেখানে ভাই বড় ভাইয়ের বাসার কাজের মেয়েকে বিয়ে করেছেন, বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি পরিবার। আমার বাবা মেনে নিলেও শেষ পর্যন্ত আমি মেনে নিতে পারিনি। তখন আমি শফিকুলকে বাড়িতে উঠতে বাঁধা দেই। এই থেকেই মূলত দূরত্ব তৈরি হয়। ওরা ‘এক ধরনের ভূমিহীন’ হয়ে পড়ে। 

এরপর শফিকুল হিজলা বাজারে মেজবাহ উদ্দিন অপু চৌধুরীর সমিল, রাইচ মিলে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করত। ২০১৯ সালের প্রথম রমজানের দিন রাতে মারা যায় শফিকুল। শফিকুল মারা যাওয়ার পর ঝরনা বা ওর সন্তানদের প্রতি এখন আর কোনো রাগ নেই। আমার রাগ তো ছিল ভাইয়ের ওপর। এখন সর্ম্পক স্বাভাবিক। তবে ওরা বাড়িতে তেমন আসে না বা যোগাযোগও তেমন নেই। এখনও অপু চৌধুরীর বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকে বলে শুনেছি।

চরফ্যাশন উপজেলার আমিনাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন বলেন, আছপিয়াদের দাদার বাড়ি ২ নম্বর ওয়ার্ডে। ওর বাবা মারা গেলে তাকে এখানেই কবর দেওয়া হয়। শফিকুল বিয়ে করে হিজলাতেই থেকে যান। খুব একটা বাড়িতে আসতেন না। তবে লোক ভালো ছিলেন।

এ বিষয়ে হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বকুল চন্দ্র কবিরাজ বলেন, শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) আছপিয়া ও তার মাকে নিয়ে জমি দেখানো হয়েছে। তবে জমি হস্তান্তর করা হয়নি, প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
তাদের নামে চরফ্যাশনে জমি আছে এমন তথ্যের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশ তদন্তে উঠে এসেছে হিজলায় তারা ভূমি মালিক নন। এখন কোথাও জমি আছে এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া গেলে সরকারি জমি ও ঘর হস্তান্তর করা যাবে কি না তা খতিয়ে দেখা হবে।

আগামীনিউজ/বুরহান