যশোরঃ জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালীর ফুলচাষিরা ভালো নেই। করোনার সংক্রমণ প্রতিরোধে টানা লকডাউন তাদের মুখের হাসি কেড়ে নিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাইরে পাঠাতে না পারায় বাধ্য হয়ে কম দামে ফুল বিক্রি করছেন। ন্যায্য দামে ফুল বিক্রি করতে না পারায় চাষিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ফলে তারা হতাশ হয়ে পড়েছে।
ফুলের রাজধানী খ্যাত যশোরের গদখালী গ্রামের ফুলচাষি সুমন বিশ্বাস। দুই বিঘা জমিতে গোলাপ আর দুই বিঘা জমিতে জারবেরা চাষ করেছিলেন। প্রতি মাসে গড়ে ৭০ থেকে লক্ষাধিক টাকার ফুল বিক্রি করতেন তিনি। গত বছর করোনার প্রকোপের সময় মোটেও ফুল বিক্রি করতে পারেননি তিনি। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে তার দুই বিঘা জমির জারবেরা পলিশেড উড়ে যায়। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে শেডটি মেরামত করেন। গত বছর আগস্ট থেকে ঘুরে দাঁড়ায় ফুলের বাজার। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন সুমন। সেই স্বপ্ন আবার ভেঙে চুরমার করেছে তার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে। ফুল বিক্রিতে বিপর্যয় চলছে তার।
করোনা ও লাগাতার লকডাউন-বিধিনিষেধে ক্ষেতেই নষ্ট হচ্ছে জমিতে ফোটা ফুল। স্থানীয় বাজারে ফুলের বেঁচাকেনা ও চাহিদা না থাকায় বাধ্য হয়ে; গ্রাম থেকে ৩৫ কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে যশোর শহরে পানির দরে ফেরি করে ফুল বিক্রি করছেন তিনি। শুধু সুমন নয়, গদখালী এলাকার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার ফুলচাষি জমি থেকে ফুল কেটে শহর কিংবা গ্রামে সাইকেল বা ভ্যানে ফেরি করে ফুল বিক্রি করছেন। আবার অনেকেই সেটা না করতে পারায় ক্ষেতের ফুল কেটে গরু-ছাগলের খাদ্য হিসাবে জোগান দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি সূত্র মতে, যশোরের ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলার ৭৫টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় হরেক রকমের ফুল। ঝিকরগাছার পানিসারা-গদখালী গ্রামগুলোর রাস্তার দুইপাশে দিগন্ত বিস্তৃত জমিতে সারাবছরই লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের ফুলের সমাহার হয়ে থাকে। শত শত হেক্টর জমি নিয়ে গাঁদা, গোলাপ, গ্লাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, কসমস, ডেইজ জিপসি, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের চাষ হয় এখানে। এলাকায় উৎপাদিত ফুল বিক্রির জন্য গদখালীতে যশোর রোডের দুই ধারে রয়েছে ফুলের বাজার।
প্রতিদিন উপজেলার গদখালী-পানিসারার শত শত ফুলচাষির আনাগোনা শুরু হয় গদখালীর বাজারে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছোট-বড় পাইকাররাও সেখান থেকে ফুল কিনে নিয়ে যান। এরপর বিভিন্ন হাতবদল হয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ফুল ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও। তবে করোনার কারণে এই কার্যক্রমে ছেদ পড়েছে গদখালী-ব্যবসায়ীসহ এই সেক্টরের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর ৩০০ কোটি টাকার ফুল উৎপাদন হয় এসব মাঠ থেকে।
যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৬২৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে দেশি-বিদেশি নানা জাতের ফুলের চাষ হচ্ছে। ফুল চাষের সঙ্গে এখানকার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কৃষক এবং প্রায় এক লাখ শ্রমিক সম্পৃক্ত রয়েছেন। করোনার কারণে ফুলের বাজার বন্ধ রয়েছে। খেতে ফুল নষ্ট হচ্ছে। ফুলচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা হিসাবে আউশ ধানের বীজ, টমেটোর চারা দিয়েছি।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আবদুর রহিম বলেন, দেশের চাহিদার শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ফুল যশোর থেকে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। করোনার কারণে গত বছর ৫ মাস এবং এ বছরের ৩ মাসে ফুল বিক্রির সুযোগ না থাকায় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ফুল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে শুধু যশোর অঞ্চলে অন্তত ৩০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩০০ জন চাষিকে ২ কোটি টাকার মতো ঋণ দেয়া হয়েছে। করোনার কারণে চাষিদের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন শেষ। ফুলচাষিদের পথে বসার উপক্রম হয়েছে। উৎপাদন ধরে রাখতে চাষিরা ক্ষেতের ফুল গরু-ছাগলকে খাওয়াচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সামাজিক অনুষ্ঠানের অনুমতি ও একই সঙ্গে ফুলচাষিদের প্রণোদনা বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান কৃষক এই নেতা।