শিশুমননের বিকাশে মাতৃভাষার ভূমিকা

ডা. লেলিন চৌধুরী ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২১, ০২:২২ পিএম
ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ মানুষ এবং ভাষা এক অবিচ্ছেদ্য প্রসঙ্গ। একটি তুলনাবিহীন মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের কারণে হেমো স্যাপিয়েন্স নামের প্রাণী মানুষ হয়ে উঠেছে। জগত ও বহির্জগতে যেসব উদ্ভাবনের দ্বারা মানুষ নিজের পদচিহ্ন অঙ্কন করেছে তার মধ্যে নিঃসন্দেহে ভাষা অন্যতম। মানুষের জন্য ভাষা কেবলমাত্র যোগাযোগের একটি মাধ্যম নয়, তারচেয়েও অনেক বেশি কিছু। সমাজ ও জ্ঞানচর্চার বিবর্তনের ইতিহাসের পথরেখা ভাষার শরীরে চিহ্নিত থাকে। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী ভাষার শব্দে শব্দে বিবৃত হয়। ভাষা প্রসঙ্গে বহুল উচ্চারিত শব্দবন্ধ হচ্ছে ‘মাতৃভাষা’। 

মাতৃভাষা বলতে আমরা মূলতঃ কি বুঝি এবং বুঝিয়ে থাকি? একজন মানুষের মা যে ভাষায় কথা বলে সেটাই কি ব্যক্তিটির মাতৃভাষা? সাধারণভাবে উত্তরটি হ্যাঁ-বোধক হবে। অন্যসব দেশবাসীর মতো বাংলাদেশে বসবাসকারী মানুষের ক্ষেত্রেও বিষয়টি মীমাংসিত। যদি ব্যক্তিটি বাঙালি জাতির অন্তর্গত হয় তাহলে তার মাতৃভাষা বাংলা। যদি সে চাকমা অথবা গারো জাতির মানুষ হয়ে থাকে তাহলে নিঃসন্দেহে তার মাতৃভাষা হবে চাকমা অথবা গারো ভাষা। ধরা গেল আঠারো বছর বয়েসী একজন বাঙালি মেয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে ফ্রান্সের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো। সেখানে সহপাঠী এক ফরাসি ছেলের সাথে প্রণয়ের সাঁকো অতিক্রম করে তার পরিণয় হলো। একদা মেয়েটি গর্ভবতী হলো। ছেলেটির পরিবার উল্লসিত। নবজাতকসহ বাঙালি মেয়েটি প্যারিসের উপকণ্ঠে স্বামীর পরিবারে বসবাস করছে। অত্যন্ত আদরভরা পরিবেশে শিশুটি প্রতিপালিত হচ্ছে। ওই পরিবার ও তার চারপাশের সবাই ফরাসিভাষী। শিশুটির মা কেবলমাত্র বাংলাভাষী। শিশুটি ফরাসি কায়দা-কেতায় লালিতপালিত হচ্ছে। চারপাশের সবাই আদর করার সময় স্বাভাবিকভাবে ফরাসি ভাষা ব্যবহার করে। শুধু মা তাকে বাংলায় আদর করে। এভাবেই শিশুর বয়স বাড়ছে। অন্য আরেকটি ঘটনা। এক নিঃসন্তান ড্যানিশ দম্পতি বাংলাদেশ থেকে ছয়মাসের একটি শিশুকে দত্তক নিয়ে স্বদেশে চলে গেল। শিশুটি ডেনমার্কে বড় হলো এবং পড়াশোনা শুরু করলো। এক্ষেত্রে শিশু দুটির মাতৃভাষা কি হবে? দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আমরা একমত হবো যে শিশুটির মাতৃভাষা হবে ড্যানিশভাষা। প্রথম শিশুটির মাতৃভাষা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কেউ কেউ বলতেই পারেন শিশুটির মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা। কারণ শিশুটির মা তার সাথে বাংলায় কথা বলে থাকেন। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখবো এই শিশুর মাতৃভাষা আসলে ফরাসি, বাংলা নয়। মেয়েটি তার স্বামীর সাথে ফরাসিতে কথা বলছে। পরিবারের অন্যদের সাথে তাকে ফরাসি বলতে হয়। যদি এটি একক পরিবার হতো এবং শিশুটির মা-বাবা দুজনে বাংলাভাষী হতো তাহলে কিন্তু আমাদের ভিন্নরকম বিবেচনা করতে হতো। মাতৃভাষা কোনো বায়োলজিক্যাল ধারণা নয়, এটা সামাজিক ধারণা। শিশুর মাতৃভাষা বলতে আমরা শিশুর বায়োলজিক্যাল মায়ের ভাষাকে নয়, মূলত শিশুটির চারপাশের ঘনিষ্ঠ ভাষা-পরিবেশকে বুঝিয়ে থাকি। একই কারণে ঢাকায় বসবাসকারী বাঙালি ছেলে ও রাশিয়ান মেয়ের সন্তানটির মাতৃভাষা হয়ে যায় বাংলা। 

শিশুর ভাষা বিকাশের দুটো স্তর। একটি হলো প্রাক-ভাষিক স্তর এবং অপরটি ভাষিক স্তর। প্রাক-ভাষিক স্তরের প্রথম ধাপ হচ্ছে শ্রবণ দক্ষতার সূচনা। এটি মাতৃগর্ভ থেকেই শুরু হয়। শিশু এসময়ে পেটের ভিতরের এবং বাইরের ধ্বনি শুনতে পায়। এই ধাপে শিশুর মস্তিষ্ক প্রধানত গর্ভধারিণীর ধ্বনির সাথে পরিচিত হয়। দ্বিতীয় ধাপ হলো কথন দক্ষতা অর্জন। শুরুটা হয় শরীরী ধ্বনি যেমন কান্না, ঢেকুর তোলা ইত্যাদি দিয়ে। কিন্তু চারমাস বয়সের পর থেকে শিশু তার স্বরযন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়াস শুরু করে। চারপাশের উচ্চারিত শব্দগুলো আয়ত্ত করতে সচেষ্ট হয়। এসময়ে সে নানা শব্দ উচ্চারণ করতে সক্ষম হয়। তৃতীয় স্তরে শিশু স্বরযন্ত্রের দ্বারা শব্দের তারতম্য তৈরি করতে শিখে। প্রাক-ভাষিক স্তর গর্ভকাল থেকে জন্মের পর ১৪-১৫ মাস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। ভাষিক স্তরে শিশু প্রবেশ করে সাধারণত ১৬-১৭ মাস থেকে। এসময় থেকে সে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে শিখে। এরপর ৫ থেকে ৭ বছর বয়সের মধ্যে শিশু ভাষার প্রয়োজনীয় নিয়মকানুন আয়ত্ত করে ফেলে। এখানে ভাষা বলতে শিশুটির জন্ম ও বিকাশ যে ভাষা-পরিবেশে সেই ভাষাকে বোঝানো হয়েছে। যদি ভাষা-পরিবেশে একাধিক ভাষার উপস্থিতি থাকে তাহলে শিশু প্রধান ভাষাটিকে বেছে নেয়। কোনো শিশু প্রাক-ভাষিক স্তরে একটি ভাষা-পরিবেশে ছিল, কিন্তু ভাষিক স্তরে তাকে অন্য ভাষা-পরিবেশে সরিয়ে নেয়া হলো, সেক্ষেত্রে শিশুটির ভাষাবিকাশে কোনো সমস্যা হবে কি? নিঃসন্দেহে প্রথম অবস্থায় শিশুটির ভাষিক যোগাযোগহীনতা তৈরি হবে, তারপর হবে সমন্বয়হীনতা। তবে তার মস্তিষ্ক অতিদ্রুত নতুন ভাষা আয়ত্ত করতে সচেষ্ট হবে। শিশুটি ক্রমান্বয়ে নতুন ভাষার মানুষ হয়ে উঠবে। 

মস্তিষ্ক মানুষের সকল কাজের পরিচালক ও নিয়ন্ত্রক। শরীরের এক একটি অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ দ্বারা এক একটি কাজ সম্পন্ন করিয়ে নেয়। শিশুর মস্তিষ্ক ভাষাকে আয়ত্ত করে। তবে ভাষার প্রকাশ ঘটে প্রাথমিকভাবে স্বর বা বাগযন্ত্রের মাধ্যমে। মানবমস্তিষ্ক ভাষা শিখতে সচেষ্ট হয় নিজের চিন্তা ও বোধকে প্রকাশ করার জন্য। তাই শিশুর চিন্তন প্রক্রিয়ার বিকাশ এবং ভাষার বিকাশ সমান্তরাল। শিশুর অতি আগ্রহী মস্তিষ্ক চারপাশ থেকে নিরবচ্ছিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে। এগুলোর নিরন্তর সংশ্লেষণ-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে শিশুর জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়া চলমান থাকে। এটি শুরু হয় শিশুর গর্ভকালীন সময় থেকেই। আমরা দেখতে পাই যে বয়সে শিশু ভাষিক স্তরে প্রবেশ করে, সে বয়স থেকে তার একটি নিজস্ব মানসিক রূপ তৈরি হতে থাকে। দুই থেকে সাত বছর পর্যন্ত শিশুর জ্ঞানবিকাশের প্রাক-সক্রিয়তার স্তর সম্পূর্ণ হয়। শিশু সাত বছর বয়সের পর জ্ঞানবিকাশের সক্রিয়তার স্তরে প্রবেশ করে। এগারো থেকে বারো বছরের মধ্যে এই পর্ব সম্পূর্ণ হয়। এগারোর পর থেকে শিশুর জ্ঞানবিকাশের যৌক্তিক সক্রিয়তার স্তর শুরু হয় এবং শেষ হয় আঠারো বছর বয়সে। এসময়ে শিশুটি একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মতো বিচার-বিশ্লেষণ, যুক্তি-অনুমান, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইত্যাদি করতে সমর্থ হয়। শিশুর ভাষাবিকাশের ক্ষেত্রেও আমরা একইরকম পথরেখা লক্ষ্য করি। সাত বছর বয়সের পর থেকে শিশু ভাষার নিয়মকানুনগুলোকে ক্রমান্বয়ে নির্ভুল স্তরে উন্নীত করতে থাকে। এগারো-বারো বছরের পর থেকে শিশুর শব্দসম্ভারে বৈচিত্র্য ও ব্যবহার কুশলতা লক্ষ্যণীয়। সতেরো-আঠারো বছরের মধ্যে শিশুর ভাষাবিকাশ পূর্ণতায় প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে জ্ঞান ও ভাষার বিকাশে পূর্ণতার বিষয়টি কোনো একটি বিন্দু বা ক্ষেত্র নয়। এটি একটি সমাপ্তিহীন জগত। এ জগতে প্রবেশের পর শুধু সমৃদ্ধ হওয়া যায়। জ্ঞানজগতে অর্জিত সমৃদ্ধির দ্বারা মানুষ নিজের অকিঞ্চিৎকরতা বা অজ্ঞানতার গভীরতা অনুধাবন করতে পারে এবং জানার অসীম ক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হওয়ার দিশা পায় মাত্র। মনে রাখতে হবে ভাষাবিকাশ, জ্ঞানবিকাশ এবং চিন্তন- প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন চলমান ধারা। এগুলো আমৃত্যু কোনো না কোনোভাবে বহমান রয়ে যায়। আমরা বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য বয়সের মাইলফলকগুলো ব্যবহার করি মাত্র। মাইলফলক নির্ধারণের জন্য বয়সের গড় হিসাবকে ধরা হয়। 

আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি যে, মানুষের জ্ঞানবিকাশের মৌলিক ভিত্তিভূমি আঠারো বছর বয়সের মধ্যেই সম্পন্ন হয়। পরবর্তীকালে এই ভিত্তির উপর ভর করে জ্ঞানসৌধের বহুতল ভবন নির্মিত হয়। তার দেয়ালে দেয়ালে নানাবিধ অলংকরণ ও চিত্রকলার সমাহার ঘটে। জ্ঞান নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রকাশের পথ খুঁজে নেয়। এজন্য জ্ঞানবিকাশের সহযাত্রী হয়ে ভাষার বিকাশ হতে থাকে। দুটোর জন্য অপরিহার্য হচ্ছে চিন্তন- প্রক্রিয়া। চিন্তন-প্রক্রিয়ার জন্য একটি বাহকের প্রয়োজন হয়। মাতৃভাষা হলো সেই বাহক। মানুষ সক্রিয় অথবা অক্রিয়ভাবে মাতৃভাষায় চিন্তা করে। একজন শিক্ষিত বাঙালি যখন ইংরেজি অথবা ফরাসিতে কথা বলে বা লেখে তখন কিন্তু চিন্তন-প্রক্রিয়া বাংলাতেই ক্রিয়াশীল থাকে। কখনো কখনো এই প্রক্রিয়া এতোটা সুগভীর থাকে যে চিন্তক নিজেও সেটা অনুভব করে না। হোমো স্যাপিয়েন্সের মানুষ হওয়ার জন্য মাতৃভাষা অপরিহার্য। তাই বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষা মহত্তম অভিধায় সম্বোধিত এবং আলোচিত। 


(সীমাবদ্ধতা স্বীকার: লেখাটি সংক্ষিপ্ত এবং সরলীকৃত। লেখার সাথে দ্বিমত ও বহুমত প্রকাশের বিস্তর সুযোগ রয়েছে।)

লেখক: স্বাস্থ্য পরিবেশ ও শিশু অধিকার কর্মী


আগামীনিউজ/প্রভাত