হারিয়ে যাচ্ছে দেশী প্রজাতির পাখি

নিজস্ব প্রতিবেদক জানুয়ারি ১৯, ২০২১, ১২:২৭ এএম
ছবি; সংগৃহীত

ঢাকাঃ বনবাদারে যেসব প্রজাতির পাখি চোখে পড়তো সেগুলি হলো শালিক, ঘুঘু, সবুজ ঘুঘু, বুলবুলি, দোয়েল, টুনটুনি, চড়ুই, ফিঙ্গে, কাঠঠোকরা, মাছরাঙা, জংলি টুনি, ইষ্টিকুটুম, চন্দনা, ডালা ঘুরানি, কোকিল, চৈতার বৌ, এছাড়া হাওর, বিল, ডোবা, হাজামজা পুকুরে যেসব জলজ পাখি দেখা যেতো সেগুলি হলো ডাহুক, কালিম, লাল বক, বিভিন্ন প্রজাতির সাদা বক, কুড়াসহ নাম না জানা অসংখ্য পাখি দেখা যেতো দেশের বিভিন্ন জনপদে। এখন হারিয়ে যাচ্ছে সবই।

বাড়ির উঠোন থেকে ঘরের বারান্দায় পর্যন্ত শালিক, চড়ুই অবাধে বিচরণ করত। এখন বনজঙ্গলের গাছেও তেমন পাখি চোখে পড়ে না। জলাশয়ের পাখি তো একেবারেই বিরল। দেশের বনবাদার, হাওর, বিল, ডোবাসহ বিভিন্ন জলাশয়ে দেশীয় প্রজাতির পাখি হারিয়ে যাচ্ছে।

এক সময় দেশের বিভিন্ন জেলার জনপদে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখিরা ঘুরে বেড়াত। প্রতিটি পাড়া বা গ্রামের পেছনেই দেখা যেতো ঘন জঙ্গল, ঠাসা থাকতো নানা রকম গুল্ম, জারুল, বরুণ, মেরা, শেওড়া, গাবসহ বিভিন্ন বনজ গাছপালায়। এসব জঙ্গল মুখরিত থাকতো নানা প্রজাতির পাখির কোলাহলে। আবার বিভিন্ন বিলে বর্ষাকালে চাষ করা হতো বাওয়া ধান।

বর্ষার পানি বৃদ্ধির সাথেসাথে এসব ধানগাছও বৃদ্ধি পেত। বিভিন্ন ডোবা আর মজা পুকুরে থাকতো ঘন কচুরিপানা। এই ঘন বাওয়া ধানের ক্ষেত আর কচুরিপানায় বাসা বানাতো লাল বক, সাদা বক, ডাহুক, কালিম, কুড়াসহ নানা প্রজাতির জলজ পাখি। স্কুল পড়ুয়া শিশুরা গুলতি নিয়ে সারাদিন পাখি শিকারের নেশায় ঘুরে বেড়াত। এঁটেল মাটির গুলি বানিয়ে আগুনে পুড়ে বা রোদে শুকিয়ে হাফ প্যান্টের দু'পকেট ভরে পাখি শিকার করে বেড়াত। আবার শৌখিন পাখি শিকারিরা পোষা ঘুঘু আর দোয়েল দিয়ে বন্যপাখি শিকার করতেন। জলজ পাখিও খাঁচায় পুষে বেরিয়ে পড়তেন হাওর আর বিলে। শিকার করতেন বক, ডাহুক, কালিম, কুড়াসহ নানা রকম জলজ পাখি। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মানুষ বাড়ছে। জঙ্গল আর বনবাদার উজাড় করে গড়ে উঠছে বাড়িঘর। অন্যদিকে জলাশয়গুলোর কিছু কিছু সংস্কার করে বানানো হয়েছে কৃত্রিম মৎস্য খামার। আবার বাওয়া ধান বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক বছর আগেই। কারণ যান্ত্রিক কৃষির যুগে বাওয়া ধানের পরিবর্তে এসব জমিতে বর্ষার পর স্যালো টিউবওয়েলে সেচ দিয়ে চাষ হচ্ছে উচ্চ ফলনশীল বোরো। ফলে বনজ এবং জলজ পাখির আবাসস্থল প্রায় হারিয়েই গেছে।

এছাড়া ফসলের জমিতে ব্যাপকহারে কৃত্রিম সার এবং কীটনাশকের ব্যবহারের কারণেও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি হারিয়ে যাচ্ছে, বহু প্রজাতি বিলুপ্তির হুমকির মুখে পড়েছে। নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধিরা বহু পাখির নাম শুনছে, বইয়ের পাতায় ছবি দেখছে, কিন্তু এসব পাখি দেখার সুযোগ তাদের নেই। তবে দখলদারি, অবহেলা আর গাফিলতির কারণে খাল, বিল, নদীসহ যেসব জলাশয় নাব্যতা হারিয়ে জলজ উদ্ভিদের উর্বরক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, সেসব জায়গায় এখনও জলজ পাখি বিচরণের কিছু বিরল দৃশ্য দেখা যায়।

যেমন কিশোরগঞ্জ শহরের বুক চিরে বয়ে গেছে নরসুন্দা নদী। একসময় রেল যোগাযোগ ভাল থাকলেও সড়ক যোগাযোগের তেমন সুবিধা ছিল না। তখন নরসুন্দা নদীপথে বয়ে চলতো বড় বড় মহজনি নৌকা। নৌকাযোগে যাত্রীসহ মালামাল পরিবহন করা হত। তখন নরসুন্দা ছিল একটি প্রবহমান নদী। কিন্তু প্রায় চার দশক আগে ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তিস্থলের কাছে বাঁধ দেয়ার কারণে যেমন নরসুন্দার অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে ভূমিদস্যুর দল নদীর দু'পাড়ে দখল অভিযানে মত্ত হওয়ার কারণে নদীটি এখন একেবারে মৃত। আর এই নরসুন্দার বুকেই গড়ে উঠেছে ঘন কচুরিপানাসহ নানা জলজ উদ্ভিদের উর্বর ক্ষেত্র। এখানে যেমন নির্বিঘ্নে জন্ম দিচ্ছে মশা, আবার মাঝেমাঝে ঝাঁক বেঁধে সাদা বক ও ডাহুকসহ কিছু বিরল প্রজাতির জলজ পাখিও ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। প্রাতঃভ্রমণে যারা বের হন, তাদের কদাচিৎ সৌভাগ্য হয় এসব হারিয়ে যাওয়া পাখি দর্শনের।

আগামীনিউজ/এএইচ