ধুলায় ধূসর রাজধানী

ডেস্ক রিপোর্ট ডিসেম্বর ৪, ২০২০, ০৯:৪৮ এএম
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ শীতের শুরুতেই উড়ছে ধুলা। এতে রাজধানীতে দেখা দিয়েছে দুর্ভোগ। বাড়ছে ভোগান্তি। ঢাকার বেশকিছু এলাকার বাসিন্দা ও পথচারীরা ঠাণ্ডা, কাশি, শ্বাসকষ্টসহ নানাবিধ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনা মহামারির মধ্যে ধুলার কারণে অস্বস্তি বোধ করছেন নগরবাসী। শুষ্ক মৌসুমে ধুলা প্রকোপ অত্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা কেটে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিআরটি, ওয়াসার পানি সরবরাহ লাইন নির্মাণ, ড্রেনেজ নির্মাণসহ নানাবিধ উন্নয়নমূলক কাজ চলছে। ফলে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে যানবাহনে করে চলাচলেও কষ্টসাধ্য।

বছরব্যাপী উন্নয়নের খোঁড়াখুঁড়িতে শীত কিংবা বর্ষা সব ঋতুতেই ঢাকাবাসী পড়েন বিপদে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন বছরব্যাপী রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যখন-তখন রাস্তা কেটে পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ না হলে বিগত বছরের তুলনায় এবারো বায়ুদূষণ বাড়বে। শুধু ধুলাবালি নয়, বর্জ্য, প্লাস্টিক পোড়ানোর কারণেও বায়ুদূষণ বাড়ছে। ফলে একদিকে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ, অন্যদিকে করোনা মহামারির মধ্যে শিশু থেকে বয়স্করা শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকে বায়ুদূষণ প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকায় বাতাসের মান ঠিক রাখতে খোঁড়াখুঁড়ি নিয়ন্ত্রণে জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে প্রতিদিন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ১০টি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ৮টি গাড়িতে করে পানি ছিটানোর কাজ করছে। যা বৃহত্তম নগরীর তুলনায় খুবই নগণ্য। এ ছাড়া যেসব সড়কে পানি ছিটানো হয়, সেসব স্থানেও ধুলার পরিমাণ কমছে না। পানি  ছিটানোর ২০ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যেই তা শুকিয়ে যাচ্ছে।

দেখা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, ধানমণ্ডি, উত্তরা, বাড্ডা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। এসব স্থানে মানুষের চলাচল, বাসাবাড়ির আবর্জনাসহ বেসরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমের কারণে ধুলা-বালির সৃষ্টি হচ্ছে। যা মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। মোহাম্মদপুর-বসিলা রোডের ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন জানান, ধুলার কারণে ক্রেতাগণ আমার দোকানে আসতে চান না। সড়ক দিয়ে নিয়মিত গাড়ি চলাচল করছে। তবে গাড়ি ঠিকমতো দেখা যায় না। এতে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তার ধুলায় দোকানের মালামাল নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ বার করে দোকান মুছতে হয়।

বিল্লাহ হোসেন নামের একজন পথচারী জানান, গত কয়েক বছর ধরে মোহাম্মদপুর এলাকা ধুলার শহরে পরিণত হয়েছে। বাসস্ট্যান্ড কিংবা বেড়িবাঁধ এলাকা সবখানেই ধুলা। এতে পথচারীসহ স্থানীয়দের চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছেন। ধুলা-বালির কারণে এখানকার মানুষে মধ্যে শ্বাসকষ্টও দেখা দিয়েছে। মাটি, বালু, ইট, সুরকি সড়কের পাশে রাখা হচ্ছে। এগুলোর ধুলা বাতাসে মিশে জনজীবন বিপর্যস্ত করছে।

একই চিত্র রাজধানীর গাবতলী এলাকায়। এদিকে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় চলছে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। টঙ্গী থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত বিআরটি’র নির্মাণকাজ চলছে। এতে সড়কে উড়ছে ধুলা। মৌসুমের প্রথম দিক থেকে এখানে ধুলা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। ফলে যানবাহন ও পথচারীদের চলাচল করা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। ধুলার কারণে বাসের সিটসহ যাত্রীদের পোশাকে আবরণ পড়ে যায়।

উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা সোহানুর রহমান বলেন, করোনার কারণে মাস্ক ছাড়া বের হই না। তুবও মাস্কের উপরে ধুলার আস্তরণ পড়ে যায়। এতে আমার শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হয়। প্রায় সব এলাকায়ই চলছে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িসহ নানা উন্নয়নমূলক কাজ। এ কারণে ধুলার মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। সরকার রাজধানীতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অথচ ধুলা-দূষণ প্রতিরোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না।

এদিকে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজের কারণে মিরপুর ১২ থেকে কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, পল্টন, মতিঝিল এলাকা এখন ধুলাময়। যানবাহনের চাকার সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে পানি ছিটানো হলেও তা কোনো কাজে আসছে না।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে একজন ট্রাফিক পুলিশ জানায়, রাজধানীর এমন কোনো রাস্তা নেই যেখানে ধুলা উড়ে না। ধুলার মধ্যেই আমাদের ডিউটি করতে হয়। এতে আমাদের প্রায় সময়ই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতে হয়। সড়কে আমাদের কাজ। মাঝেমধ্যে ধুলা, বালি-কণা চোখে পড়ে। এতে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পথচারীদেরও মারাত্মকভাবে ক্ষতি হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইট এয়ার কোয়ালিটি ইনডেস্ক (একিউআই) সূত্রে  জানা যায়, অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার বাংলাদেশে দূষণের মাত্রা অনেক বেশি। যা গত অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরেই ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বায়ুমানের অবনতি হচ্ছে, কোথাও কোথাও তা বিপজ্জনক সীমাও স্পর্শ করছে। ২৯শে নভেম্বর একিউআইয়ে দেখা যায়, ঢাকার মানিকগঞ্জ শীর্ষে রয়েছে। দূষণের দিক দিয়ে যার মান ১৭০। আর রাজধানী ঢাকা রয়েছে ১৬৫। বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণা ও চার ধরনের গ্যাসীয় পদার্থ পরিমাপ করে এ সূচক তৈরি করে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটি। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য অনুসারে, রাজধানীর বায়ুদূষণের ৫০ ভাগ হয় ইটভাটা থেকে, ৩০ ভাগ হয় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সিটি করপোরেশনের বর্জ্য থেকে। ১০ ভাগ দূষণ হয় গাড়ির জ্বালানি থেকে। শিল্প কারখানার বর্জ্য থেকে ১০ ভাগ। এই দূষণ কমাতে জরুরিভিত্তিতে খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধের পাশাপাশি রাস্তাগুলোতে প্রতিদিন পানি দেয়ার ব্যবস্থা করার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন জানান, ধুলা-বালি কমাতে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রতিদিনই বিভিন্ন সড়কে পানি ছিটানো হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত পানি ছিটানোর কাজ করা হয়। এ ছাড়া সড়কের পাশে নির্মাণকাজে ব্যবহৃত বালি আমরা ঢেকে রাখার ব্যবস্থা করেছি। শহরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে কাজ করে যাচ্ছে ডিএনসিসি।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপ-সচিব) মো. রাসেল সাবরিন বলেন, শহরের ধুলা-বালি কমাতে নিয়মিতভাবে পানি ছিটানো হচ্ছে। সিটি করপোরেশন থেকে যথেষ্ট চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোকেও ধুলা নিয়ন্ত্রণ করে কাজ করতে বলা হয়েছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাছের খান বলেন, প্রতিবছরই এই সময়ে ধুলা বেড়ে যায়। ধুলা দূষণে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, এলার্জি, চর্মরোগসহ নানা জটিল রোগব্যাধি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ধুলা দূষণে জনদুর্ভোগের পাশাপাশি একদিকে যেমন স্বাস্থ্যগত সমস্যা হচ্ছে, তেমনি পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। রাজধানীতে উন্নয়ন কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি আর যানবাহন চলাচলের সময় ধুলা-বালি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় ধুলা দূষণের মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় অবিলম্বে ধুলা দূষণ বন্ধে সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এখনি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

আগামীনিউজ/এএইচ