অতিদরিদ্রদের টাকা নিয়ে চেয়ারম্যান-মেম্বারের নানা ফিকির

আগামী নিউজ ডেস্ক জুলাই ১৪, ২০২২, ০৭:৩৮ পিএম

কুড়িগ্রামঃ কুড়িগ্রামে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির তালিকায় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার এবং সরকারি চাকরিজীবীদের আত্মীয়স্বজনদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রকৃত সুবিধাভোগীদের নাম বাদ দিয়ে সচ্ছলদের নামে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এই প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।

সরেজমিনে জানা যায়, কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার নুনখাওয়া ইউনিয়নে ২০২১-২২ অর্থবছরের অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। হতদরিদ্রদের পাশাপাশি সচ্ছল ব্যক্তিদের নামের তালিকা করা হয়েছে। ইউনিয়নের সাড়ে ৩০০ হতদরিদ্রের তালিকায় অর্ধশতাধিক নামের বিপরীতে অনিয়ম হয়েছে।

এসব তালিকায় ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলামের ভাই হাবিবুল ও মোহাম্মদ আলী, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল কাদেরের ছেলে সাহাজুল আলম, এনামুল হক, পুত্রবধূ তাহমিনা বেগম, আদুরি বেগম, ৭ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার মোকারুল ইসলাম এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা, ছোট ভাই দিনাজপুরের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জাকারিয়া সরকার এবং ভাতিজা খোরশেদের নাম রয়েছে।

ইউনিয়নের বিভিন্ন সড়কসহ বিভিন্ন স্থানে মাটি কাটার ৬০ দিনের কাজ দেখিয়ে জনপ্রতি ৪০০ টাকা হারে দিন মজুরির টাকা তোলা হয়েছে। তালিকাভুক্ত এসব ব্যক্তি কখনই ওই প্রকল্পে কাজ করেননি। তালিকায় অন্তর্ভুক্ত অনেকের মোবাইল সিম ইউনিয়ন সচিব মাহাফুজার রহমান নিজের কাছে রেখে সেই টাকা উত্তোলন করারও অভিযোগ মিলেছে।

স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের এমন অবৈধ কাণ্ডে ক্ষুব্ধ ইউনিয়নের দরিদ্ররা।

ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা তালিকায় দেবর ও নিজের নাম থাকার কথা স্বীকার করে জানান, মজুরির টাকা কে পায় সে বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।

ইউপি মেম্বার আব্দুল কাদের বলেন, ‘মেম্বারেরও তো খরচ আছে, বিভিন্ন স্থানে খরচ করতে হয়। তাই সেই খরচের জন্য দুয়েকটা নাম দেয়া হয়।’

বাহুবল গ্রামের বাসিন্দা সরিফা বেগমের স্বামী মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমার বউয়ের নাম দেয়া আছে। সে শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় আমি ৪০ দিনের মাটি কাটার কাজ করেছি। প্রথম দফা ৪০ দিন এবং দ্বিতীয় দফায় ২০ দিনের কাজ করে ৪০০ টাকা হারে ৬০ দিনের ২৪ হাজার টাকা পেয়েছি।’

একই এলাকার বাসিন্দা মোস্তফা বলেন, ‘মাটি কাটার কাজে আমার নাম ছিল, চেয়ারম্যান নিজেই বলেছেন। কোদাল-ডালি নিয়া কাজ করতে গিয়া শুনি আমার নাম কেটে দিছে। এখন তালিকায় দেখি চেয়ারম্যানের ভাই, সরকারি চাকরি করে তার বউ-ভাইয়ের নাম তালিকায় আছে। হামার চায়া ওমরাই গরিব বেশি। ওমরাই খাক।’

ইউনিয়ন আনসার ভিডিপির ইউনিয়ন কমান্ডার মোহাম্মদ আলী ভোলা বলেন, ‘তালিকায় চেয়ারম্যানের ভাই, ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার, ৩ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বারের ছেলে ও পুত্রবধূর নামসহ ইউনিয়ন সচিবের ঘনিষ্ঠজনদের নাম রয়েছে। গরিব এলাকার অনেক হতদরিদ্রের নাম বাদ দেয়া হয়েছে।’

স্থানীয় রুহুল আমিন বলেন, ‘৪০ দিনের কর্মসূচি এবং ভিজিএফের তালিকায় জনপ্রতিনিধিরা টাকার বিনিময়ে নাম অন্তর্ভুক্ত করেন। যারা টাকা দিতে পারে তাদের নাম দেয়া হয়। যারা দিতে পারে না তাদের নাম দেয়া হয় না।’

নুনখাওয়া ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিধি মোতাবেক ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের নেয়া যায় না। কিছু শ্রমিকের নাম তালিকাভুক্ত করার জন্য এমনটি হয়েছে।

এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুর আহমেদ মাছুম বলেন, ‘তালিকা প্রিন্ট করে ইউনিয়নের ডোর টু ডোর যাচাই করা হচ্ছে। তালিকায় অসংগতি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সত্যতা পেলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।’

কুড়িগ্রাম জেলায় ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ উপজেলায় ২৭ হাজার ৯২৮ জন সুবিধাভোগীর জন্য ৪৪ কোটি ৬৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকাসহ নন-ওয়েজ কস্ট খাতে ২ কোটি ৫ লাখ ১৫ হাজার ১০১ টাকা এবং শ্রমিক সর্দার ভাতা বাবদ ১৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।

উপজেলাভিত্তিক সুবিধাভোগীর মধ্যে ভূরুঙ্গামারীর ৩ হাজার ৪৩২ জন, নাগেশ্বরীর ৪ হাজার ৯৪৯ জন, ফুলবাড়ির ২ হাজার ৩৬০ জন, কুড়িগ্রাম সদরের ৩ হাজার ৫০১ জন, রাজারহাটের ২ হাজার ৬৩১ জন, উলিপুরের ৫ হাজার ৭১ জন, রৌমারীর ২ হাজার ৯৩১ জন, চিলমারীর ১ হাজার ৮৫২ জন এবং চর রাজিবপুরের ১ হাজার ২০১ জন।

উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোফাখখারুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি। তালিকা থেকে সচ্ছল ব্যক্তিদের নাম যাচাই করা হচ্ছে। কেউ যদি থাকে তাহলে সেই ব্যক্তিদের সরকারের টাকা কোষাগারে ফেরত দেবার উদ্যোগ নেয়া হবে এবং ঊর্ধ্বতন স্যারকে জানানো হবে।

এসএস