
ঢাকাঃ বর্তমানের হিংসা-বিদ্বেষ ও ধর্মান্ধতা সমাজের মানুষকে সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস চরমপন্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা হঠাৎ করেই যেন প্রবলরূপ ধারণ করেছে।
হিংসা একটি ভয়ানক সংক্রামক ব্যাধি। মানুষের হীন মনমানসিকতা, ঈর্ষাপরায়ণতা, সম্পদের মোহ, পদমর্যাদার লোভ-লালসা থেকে হিংসা-বিদ্বেষের উৎপত্তি ও বিকাশ হয়। মানবচরিত্রে যেসব খারাপ দিক আছে, তার মধ্যে হিংসা মারাত্মক ক্ষতিকারক। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, ঈর্ষাকাতরতা, কলহ-বিবাদ প্রভৃতি মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনকে অত্যন্ত বিষময় করে তোলে। এতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। অন্যের সুখ-শান্তি ও ধন-সম্পদ বিনষ্ট বা ধ্বংস করে নিজে এর মালিক হওয়ার কামনা-বাসনাকে আরবিতে ‘হাসাদ’ অর্থাৎ হিংসা বলা হয়।
হিংসা মানুষকে কত অধঃপতনে নিয়ে যায়, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ঈর্ষা ও হিংসা প্রায় একই রকম আবেগ, তবে হিংসাকে বলা হয় ঈর্ষার চরম বহিঃপ্রকাশ। ঈর্ষাকাতরতা হিংসার পর্যায়ে চলে গেলে আক্রোশবশত মানুষ হত্যাকা- পর্যন্ত ঘটিয়ে ফেলতে পারে। হিংসুক ব্যক্তি অন্যের ভালো কিছু সহ্য করতে পারে না, কাউকে কোনো উন্নতি বা ক্ষমতায় অভিষিক্ত দেখলে অন্তরে জ্বালা অনুভব করে।
হিংসুকের জীবন কখনই সুখের হয় না। হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। কেননা হিংসুক ব্যক্তি সবসময় সব জিনিসের অধিকারী হতে চায়। তার সর্বদা এই চেষ্টাই থাকে যে, অন্যের কাছে যা আছে তার চেয়ে তার জিনিসটা ভালো হওয়া চাই। আর এই হিংসুক ব্যক্তি সমাজের অন্যান্য সম্মানিত ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্বকে হেয় করার চেষ্টা করে। কেননা তার দৃষ্টিতে সে একাই সমাজে সম্মানিত ব্যক্তি, বাকিরা সবাই তার চেয়ে নগণ্য। হিংসুককে কেউ ভালো দৃষ্টিতে দেখে না। সবার মাঝে তার প্রতি একটা খারাপ ধারণা জন্ম নেয়- তার কর্মকা-ের কারণে। সমাজের আর অন্য সবার সাথে বসবাস করলেও হিংসুক ব্যক্তি মানুষের মনে কোনো স্থান করে নিতে পারে না।
দৈনন্দিন জীবনে হিংসার বহুবিধ কারণ পরিলক্ষিত হয়। যেমন পারস্পরিক ঈর্ষাপরায়ণতা, পরশ্রীকাতরতা, শত্রুতা, দাম্ভিকতা, নিজের অসৎ উদ্দেশ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা, নেতৃত্ব বা ক্ষমতার আকাক্সক্ষা, অনুগত লোকদের যোগ্যতাবান হয়ে যাওয়া এবং কোনো সুযোগ-সুবিধা হাসিল হওয়া, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নীচুতা বা কার্পণ্য প্রভৃতি।
ধর্মপ্রাণ মানুষের চরিত্র গঠনে হিংসা-বিদ্বেষ বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এতে মানুষে-মানুষে ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি, হানাহানি ও দ্বন্ধ-সংঘাতের উদ্ভব ঘটে।
পারিবারিক সামাজিক অবক্ষয়জনিত একের পর বীভৎস ঘটনার সাক্ষী হয়েছে দেশ। হত্যা, ধর্ষণ, আত্মহননের মিছিলে বেরিয়ে পড়ছে সমাজের এবং নৈতিকতার বিপর্যয় এবং অধঃপতনের ভয়ানক চিত্র। প্রতিদিনই ঘটছে নানা নৃশংস ঘটনা।
আমরা ক্রমেই এক নিষ্ঠুর সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি যেখানে মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দয়া, মমতা এসব শব্দের কোনো অস্তিত্বই নেই! তার জায়গা দখল করে নিয়েছে অনৈতিকতা, অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা, হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা এ জাতীয় সব নেতিবাচক শব্দের কালো হাত।
ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনের মাত্রা যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। শিশু থেকে বয়স্ক কোনো নারীই নিরাপদ নয় ধর্ষকদের থাবা থেকে। নারীরা যেন আজ কোথাও নিরাপদ নয়। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, গৃহবধূ এমনকি অবুঝ শিশুও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। প্রতিদিনের খবরের কাগজে এমন অনেক খবর আসে, যা দেখলে যে কোনো সভ্য মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়।
গত কয়েকদিন আগে সুনামগঞ্জের শাল্লায় সাম্প্রদায়িক উগ্রমুসলিমদের দ্বারা নির্যাতিত হয় সেখানকার হিন্দুরা, পুরো একটি হিন্দু গ্রাম পুড়িয়ে দেয় হেফাজতে ইসলামের সমর্থকরা, এখন প্রর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।
শুধু গত ২৮ ফেব্রুয়ারির কয়েকটি সংবাদের শিরোনাম পড়লে অতিসহজেই বুঝতে পারব সামাজিক অবক্ষয় কোন পর্যায় গিয়ে ঠেকেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলায় মাদকাসক্ত মেয়ের কাঁচির আঘাতে মা রহিমা বেগম (৫০) নিহত হয়েছেন। ছাগলে কাঁঠালের মুচি খাওয়ায় সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায় চাচা ভুট্টো মোল্লাকে (৪০) ফালা দিয়ে খুন করে ভাতিজা শফিকুল ইসলাম (২২)। মসজিদের ধান চুরি করা নিয়ে রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলায় কোব্বাস আলী (৬০) নামে এক বৃদ্ধকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পার্বতীপুর স্বামীর মিথ্যা অপবাদ সইতে না পেরে মা রতনা বেগম ৫ বছরের শিশু হাসিকে পুকুরে ছুড়ে ফেলে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। রংপুরের বদরগঞ্জে গলাকেটে মেয়েকে হত্যার ঘটনায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন মা নুরনাহার বেগম। গাইবান্ধায় কলেজছাত্রিকে কুপিয়ে হত্যা, মা গ্রেফতার। এমন ঘটনা হয়তো আরো অনেক থাকতে পারে।
গত বছরের শুরুতে বনানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় সারা দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ-সমালোচনার সৃষ্টি হয়। মাত্র কয়েকমাস আগে সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণ, খাগড়াছড়িতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের এক প্রতিবন্ধী নারীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের এই ভয়াবহতা ভাবিয়ে তুলেছে সবাইকে।
উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে সচেতন নাগরিক এমনকি জনসাধারণের মাঝে। ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে মারার পর বরগুনার রিফাত শরীফের হত্যাকাণ্ড বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে দেশে। অবিশ্বাস্য ব্যাপার-শত শত লোকের সামনে রিফাতকে কুপিয়ে মারল সন্ত্রাসীরা, কেউ এগিয়ে এলো না তাকে বাঁচাতে। প্রাকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হচ্ছে আর আমরা দর্শকের ভূমিকা পালন করছি। মা-মেয়েকে দড়ি বেঁধে প্রকাশ্যে করা হয় নির্যাতন, ছেলে ধরার গুজবে প্রকাশ্যে এক নারীকে হত্যা করতেও আমরা দেখেছি, গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে টানা ৩২ দিন ধরে সেই পরিবারের সাথে নিষ্ঠুরতা করা হচ্ছে কিন্তু আশপাশের কেউ এগিয়ে না আসায় সহজেই উপলব্ধি করা যায় আমাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে।
বর্তমান জগতে মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা দেখা যায় তা অতি কৃত্রিম। তাতে থাকে না কোনো আন্তরিকতা, থাকে শুধু কপটতা আর স্বার্থপরতা। এ ভালোবাসা শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। বর্তমানে এ জগতের রথ চলছে মিথ্যা এবং ছল নামক ইন্ধনের দ্বারা। এ রথে যারা চলছে তাদের প্রকৃত মানব বলা যায় না। তাদের বলা যেতে পারে ভ-, পাষ-। এ ভ-ামির জন্য বর্তমান মানব সমাজ ধূলির সমতলে। এ ধূলিসম অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্য চাই প্রকৃত স্নেহ, ভালোবাসা, যার দ্বারা আমরা এ বিশ্বের মানুষের মন জয় করে প্রকৃত মানুষ বলে নিজেকে পরিচয় দিতে পারি।
একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত মানবরূপে গড়ে ওঠার জন্য নিজের ভাবাধারার পরিবর্তন ঘটানো একান্ত প্রয়োজন। যে ব্যক্তি জগতের সব ব্যক্তিকে নিজের বন্ধু, ভাই, পিতা ও মহিলাদের নিজের বোন, মাতা হিসেবে দেখেন, সে ব্যক্তিই জগতের প্রকৃত মানব। অর্থাৎ থাকা দরকার পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ। কিন্তু বর্তমান জগতে এ ভাবধারার মানুষ নিতান্তই নগণ্য। কেননা, বর্তমানে সবাই হয়ে উঠেছে স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। তাদের এরূপ চিন্তাধারার জন্যই প্রকৃত মানব ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। বর্তমান মানবের এরূপ চিন্তাধারার জন্যই বর্তমান জগৎ অবক্ষয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে যতই উন্নতি করি না কেন, প্রকৃত মানব না হতে পারলে এ উন্নতির কোনো মূল্য নেই। এ উন্নতি হয়ে পড়বে ক্ষণিক সময়ের। কেননা, একজন প্রকৃত মানবই একটি জগতের উন্নতি ঘটাতে পারে।
মানুষ মানুষেরই শত্রু হয়। এই মানুষের ভেতরে যে শত্রুতা জন্ম হয়, তা চিহ্নিত করাটা খুবই কঠিন। পৃথিবীতে 'কে- শত্রু' আর 'কে- মিত্র' তাকে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে উপলব্ধি করা যায় না। কেবলই প্রয়োজনের সময় কিংবা বিপদের মূহুর্তেই সত্যিকারের শত্রু-মিত্র চেনা যায়। গৌতম বুদ্ধ একটা কথা বলেছেন,- ''জগতে শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না, মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়।'' খুব গোপন শত্রু প্রকৃত বন্ধু বা কাছের ও দূরবর্তী মানুষের নিকটেই যেন একটা মুখোশে চিত্র। বিদ্রূপ যাকেই করা হোক না কেন তা অবশ্যই নেতিবাচক। এসমাজের ব্যক্তিত্ববান কোনো মানুষকে যদি ঠাট্টা-মশকরা করে অপমান করা হয়, তা হলে সমাজে তিনি যা দিতে পারতো তা থেকে এ সমাজ বঞ্চিত হবে। সুতরাং এতে সমাজের যে ক্ষতি হয় তাকে সচেতন নাগরিকদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন। শত্রুরাই নিজ ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যেই যেন কৌশলে মিত্রকে ঘায়েল করে শত্রুতার পথ বেছে নেয়। তাদের কাছে এই কঠিন কাজ সহজভাবেই করতে যেন বাধেনা। মনে মনে বা প্রকাশ্যে ঘৃণা করে বা ক্ষতি সাধন করে, এ ব্যক্তিরাও মানুষ মানুষের শত্রু হয়।
আমাদের এ আসন্ন পতন থেকে উঠে দাঁড়াতে হলে আমাদের অন্তর আত্মাকে উন্নত করতে হবে। আমাদের স্বার্থপরতা বিসর্জন দিয়ে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করতে হবে। তা হলে আমাদের মুক্তি নতুবা আমাদের মানব অধিকার নিরর্থক।
তবে মনে হয়, বর্তমানের এ অবস্থা (অবক্ষয়) মানব সভ্যতার শেষ নয়। নতুন সূর্যের আলো প্রতিদিন নতুন আশা বহন করে আনে। ঠিক তেমনই ভবিষ্যতের মানব সমাজ একদিন এ পৃথিবীকে নতুনরূপে, নতুন চিন্তাধারায়, নতুন মনুষ্যত্বে মানবের প্রকৃত রূপ ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হবে।
নতুন মানব সমাজ গড়ে তুলতে চাই মনুষ্যত্বের জাগরণ, আর এ জাগরণের জন্য চাই প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন। যার মাধ্যমে আমরা নিজের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটাতে পারি এবং তারই মাধ্যমে এক প্রকৃত মানব সমাজ গড়ে তুলতে পারব।
ভবিষ্যতের এ আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে সদ্যোজাত শিশুই আমাদের আগামী দিনের দিশারি। তাদের উপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে এ কলুষিত জগৎ একটি নির্মল স্বাস্থ্যবান জগতে পরিণত হবে। আর এ প্রজন্মকে উপযুক্ত দিশা দেওয়ার জন্য বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্কদের উপযুক্ত ভূমিকা নিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য শুধু স্কুলে শিক্ষা দিলে চলবে না, তার সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রজন্মকে দিতে হবে ধর্মীয় এবং বাহ্যিক শিক্ষা। যার মাধ্যমে এ নবপ্রজন্ম আহরণ করে আনবে এক পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব, এক কলুষহীন সুন্দর পৃথিবী।
লেখকঃ সাংবাদিক
আগামীনিউজ/প্রআ