
প্রাচীন বাংলার রাজধানী গৌড় নগরীর উপকণ্ঠে প্রায় পাঁচশত বছর আগে নির্মিত হয়েছিল ছোট সোনা মসজিদ। বর্তমানে রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ থানার অধীনে পড়েছে। মসজিদটিকে বলা হয় সুলতানি আমলের রত্ন। সুলতান আলাউদ্দিন শাহের রাজত্বকালে (১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ) মনসুর ওয়ালি মোহাম্মদ বিন আলি নামে এক ব্যক্তি এ মসজিদটি নির্মাণ করেন। ইতিহাসের বিভিন্ন প্রামাণিক দলিল ও এ সংক্রান্ত প্রকাশিত গ্রন্থের তথ্য-উপাত্ত ঘেটে যা পাওয়া যায় তা হলো, মসজিদ প্রাঙ্গণের চতুর্দিকে গোড়াতে একটি বের হওয়ার দেয়াল ছিল— যা এখন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
যেভাবে সোনা মসজিদ
মসজিদে ১৫টি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজগুলো সোনালি রঙের। মসজিদের দিকে তাকালে চোখ আটকে যায় সোনালি রঙের ওপর। রোদ্রস্নানে গম্বুজ আরো ঝলমলে হয়ে ওঠে। অস্তগামী সূর্যের নরম লাল আলোর ছোঁয়ায় সোনালি গম্বুজগুলো মায়াময় হয়ে উঠত। দূর থেকে মানুষের চোখকেও আকর্ষণ করতো এই রং। মানুষ বলত, ওই যে সোনালি গম্বুজওয়ালা মসজিদ। এভাবে একদিন নাম পড়ে সোনা মসজিদ। মসজিদের বাইরের দেয়ালেও সোনালি রঙের আস্তর ছিল। সূর্যের আলোতে পড়লে এ রং সোনার মতো ঝলমল করত।
মসজিদের ভেতর-বাহির
মসজিদের বাইরের অংশ বেশ নিরিবিলি ও শান্ত। পাখির কূজনে মুখরিত তরুবীথি। দূর্বাঘাসের সবুজ মাঠে বাঁধাই করা বেশ কয়েকটি কবর। মসজিদের মূল প্রাঙ্গণেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দুই বীর সন্তানের সমাধি। মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সীমানা প্রাচীরের ভেতরেই বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ও মুক্তিযুদ্ধে ৭ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মুক্তিযোদ্ধা মেজর নাজমুল হকের কবর।
মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশের জন্য রয়েছে মাঝারি আকৃতির গেট। সীমানা প্রাচীরে ধ্বংসাবশেষ কিছু বাকি আছে। মসজিদের চারপাশে চকচকে টালির ব্লেসমেন্ট। ভেতর ও বাইরের দেয়ালে রয়েছে নকশা করা পাথরের টালি। এগুলো সোনা মসজিদকে বাড়তি স্বকীয়তা প্রদান করেছে। দেশের পুরাকীর্তিগুলোতে টেরাকোটার ব্যবহার দেখা গেলেও পাথরের টালির ব্যবহার কেবল ছোট সোনা মসজিদেই দেখা যায়। ছোট সোনা মসজিদের উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। উত্তর-দক্ষিণে ৮২ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৫২.৫ ফুট চওড়া। দেয়ালগুলো প্রায় ৬ ফুট পুরু। দেয়ালগুলো ইটের হলেও মসজিদের ভেতরে ও বাইরে পাথর দিয়ে মোড়ানো। তবে ভেতরের দেয়ালে যেখানে খিলানের কাজ শুরু হয়েছে, সেখানে পাথরের কাজ শেষ হয়েছে। মসজিদের খিলান ও গম্বুজগুলো ইটের তৈরি।
মসজিদের চারকোণে চারটি বুরুজ আছে। এগুলোর ভূমি নকশা অনুযায়ী অষ্টকোণাকার। বুরুজগুলোতে ধাপে ধাপে বলয়ের কাজ আছে। এগুলোর উচ্চতা ছাদের কার্নিশ পর্যন্ত। মসজিদের ছাদের ওপর তৈরি হয়েছে মসজিদের ১৫টি গম্বুজ। মাঝের মিহরাব ও পূর্ব দেয়ালের মাঝের দরজার মধ্যবর্তী অংশে ছাদের ওপর যে গম্বুজগুলো রয়েছে সেগুলো ঘরের ছাদের আকারে নির্মিত। এদের দু’পাশে দুই সারিতে তিনটি করে মোট ১২টি গম্বুজ রয়েছে। মসজিদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, বাইরের যে কোনো পাশ থেকে তাকালে কেবল পাঁচটি গম্বুজ দেখা যায়, পেছনের গম্বুজগুলো দৃষ্টিগোচর হয় না।
মসজিদের পূর্ব পার্শ্বের দেয়ালে রয়েছে পাঁচটি দরজা। উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে তিনটি করে দরজা। উত্তর দেয়ালের পশ্চিম পাশের শেষ দরজাটির জায়গায় রয়েছে সিঁড়ি। এই সিঁড়িটি উঠে গেছে মসজিদের অভ্যন্তরে উত্তর-পশ্চিম দিকে দোতলায় অবস্থিত একটি বিশেষ কামরা। কামরাটি পাথরের স্তম্ভের ওপর অবস্থিত। মসজিদের গঠন অনুসারে এটিকে ‘জেনানা মহল’ বলেই ধারণা করা হয়। তবে অনেকের মতে এটি ছিল শাসনকর্তার নিরাপদে নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা করে তৈরি একটি কক্ষ।
আগামীনিউজ/এসএসআই