Dr. Neem on Daraz
Victory Day

আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণ: প্রস্তাবনা ও প্রাসঙ্গিকতা


আগামী নিউজ | সুজন বিপ্লব প্রকাশিত: জানুয়ারি ২৩, ২০২১, ০৫:০৬ পিএম
আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণ: প্রস্তাবনা ও প্রাসঙ্গিকতা

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি কতটা অপ্রাসঙ্গিক, তার চিত্র দেশবাসী অবলোকন করেছে। বার কাউন্সিল আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণের পদ্ধতিগত ত্রুটি-বিচ্যুতির পরিবর্তে অচলাবস্থা নিরসনে ইতোমধ্যে বিজ্ঞ ও ভুক্তভোগী মহল থেকে প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে। প্রস্তাবিত দাবিসমূহ আমলে নিতে সদিচ্ছা থাকলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে আন্দোলনকারীদের সাড়া দেওয়া উচিত। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণে দায়িত্বশীল মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মাননীয় মন্ত্রী, আইন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের পরিচালনা পরিষদ কর্তৃক সমন্বিত সিদ্ধান্তে আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতি সংস্কারে ৪ দফা দাবির বাস্তবায়ন দেখতে চায় ভুক্তভোগীরা, অভিভাবক, বিজ্ঞ মহল ও সচেতন দেশবাসী। স্নাতক পর্যায়ে আইন বিষয়ে কাম্য ছাত্রসংখ্যা নির্ধারণ করা হলে বার কাউন্সিল পরীক্ষার কোন প্রয়োজন থাকেনা। ‘গাছের গোড়া কেটে, আগায় জল ঢালা’র মতো বার কাউন্সিল পরীক্ষা পয়দা করা হয়েছে। টেনে-হিঁচড়ে, জোর করে শিক্ষানবিশদের পরীক্ষায় বসানো হয়। তাতে লাভবান কারা?

বিশেষায়িত পেশাভিত্তিক আইন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী যোগ্যতাকে শুধু প্রশ্নবিদ্ধ করা নয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও তার পাঠ্যক্রমকে হেয় প্রতিপন্ন একইসাথে ত্রুটিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করে। সেক্ষেত্রে আইন পেশাগত সংকট সমাধানে আইন বিষয়ে সিলেবাস যথোপযোগীকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কিন্তু বার কাউন্সিল এসব যুক্তি মেনে নেবে না কেন? বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ সম্পন্নকারী আইনের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারীকে স্বাধীন পেশায় আইনজীবী হিসেবে স্বীকৃতি বা অনুমতির জন্য বার কাউন্সিল পরীক্ষার মুখোমুখি করে, এইসব পরীক্ষায় অংশ নিতে মোটা অঙ্কের টাকা ফি হিসেবে দেওয়া লাগে। বেকারের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে টাকা হাতিয়ে নেওয়া বন্ধ করার উপায় আছে কি?

শিক্ষানবিশি শেষ করতে গিয়ে স্বাভাবিক চাকুরির বয়স পেরোনো বিশেষায়িত আইন স্নাতকগণ বিদ্যমান বার পরীক্ষার মারপ্যাঁচে আবার অনুত্তীর্ণ হয়ে চরম দুর্ভোগে পতিত হচ্ছে। আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণ পরীক্ষায় নব্বই ভাগ অনুত্তীর্ণ হওয়ায় আমরা আইন স্নাতক সম্পর্কে কী বার্তা পাচ্ছি? সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী শিক্ষানবিশ আইনজীবী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ আশি ভাগের বেশি সংখ্যক পেশা ছাঁড়তে বাধ্য হওয়ার ব্যাপারে বার কাউন্সিলের বক্তব্য জানতে বড় ইচ্ছে করে। আইন স্নাতকদের কর্মসংস্থান প্রসঙ্গে রাষ্ট্রনীতি নির্ধারকেরা বিকল্প কিছু ভাববেন কী?

একটি সেবামূলক বৃত্তি, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবাধিকারসংশ্লিষ্ট স্বাধীন পেশায় আইনজীবী হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন চলতি পরীক্ষার ফলে খুন হয়ে যায়। অনিয়মিত পরীক্ষা আয়োজন, পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষার উত্তরপত্র বা মূল্যায়ন ফল পুনঃনিরীক্ষণের মাধ্যমে যাচাইয়ের ব্যবস্হা না থাকা, ফলাফল প্রকাশ পরবর্তী বিলম্বিত অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়াগত জটিলতা, বর্ধিত ফি সমূহ, ব্যয়বহুল ও সময়ক্ষেপণের ঘটনা ছাঁটাই করা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। কখনো-কখনো তিন ধাপের মধ্যে একটি পরীক্ষা একবার সম্পন্ন হতে তিন-চার বছর কেটে যায়। স্নাতক পর্যায়ে আইন শাস্ত্রের বিভিন্ন শাখা কোর্স হিসেবে পড়ানো হয়। পাঠ্য বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও পেশায় প্রবেশে পুর্নবার পরীক্ষা দেওয়ার মতো দুর্ভাগ্য অন্যান্য বিশেষায়িত পেশার ক্ষেত্রে নেই। বার কাউন্সিল পরীক্ষা নিয়ে দুর্নীতি, অনিয়ম ও ভুলনীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। আবার এ পরীক্ষা পেশা জীবনে কোন প্রভাব রাখতে পারেনা। অথচ অাইনজীবী বেতনভুক্ত চাকুরে নয়। বার পরীক্ষার মাধ্যমে আইনজীবী নিবন্ধন অসঙ্গতি বলে প্রতীয়মান হয়। অন্যান্য দেশের আইনজীবী নিবন্ধন প্রক্রিয়ায় আমাদের দেশের মতো সনাতন পদ্ধতির চল নেই। বর্তমানের বিতর্কিত ও জটিল আইনজীবী নিবন্ধন পদ্ধতির ফলে আইনের ছাত্র ও শিক্ষানবিশগণ বহুমাত্রিক হয়রানির শিকার হচ্ছে। আমাদের দেশ বেকারত্ব বৃদ্ধির হারে দীর্ঘদিন বিশ্বে শীর্ষ অবস্হানে রয়েছে। জনগণের আর্থ-সামাজিক অবস্হার পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষায়িত পেশাভিত্তিক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেও ৩-৪ বছরের বেশি সময় বেকার অথবা উপার্জনহীন অবস্হার মধ্য দিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পিছে ছুটে চলা আদৌ কি সম্ভব? বিরাজমান আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতিতে মোড়লিতন্ত্র, সিন্ডিকেট ও আমলাতন্ত্র কি ‘লাভের গুড়’ খাচ্ছে না? এরকম পরীক্ষার নামে ছাঁটাই হওয়ার কারণে জনসেবাখাত আইন পেশা সংকুচিত ও কুক্ষিগত হওয়ায় জৌলুশ হারাচ্ছে। ফলস্বরুপ একদল মেধাবী, দক্ষ, চৌকস ও স্বপ্নবান তরুণের থেকে প্রাপ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনী সেবাবঞ্চিত জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণ বিঘ্নিত হচ্ছে।

জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে, জাতীয় জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে, আইন পেশার ভোগান্তি দূরীকরণ ও প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে ঝিনাইদহ জেলা আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আইন শিক্ষার্থী, শিক্ষানবিশ, আইনজীবী, অভিভাবক ও সুধীজনের সভায় ‘আইনজীবী সনদ অধিকার আন্দোলন’ নামে জাতীয় প্লাটফর্ম গড়ে ওঠে। ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত আইনজীবী সনদ অধিকার আন্দোলন তার সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যৌক্তিক বক্তব্যে সংগঠিত হওয়ার জন্য আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতি বা আইনজীবী সনদ অধিকারের লড়াই-আন্দোলনের ইতিহাসে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ৪ দফা দাবির ভিত্তিতে অগ্রসর হচ্ছে। আইন শিক্ষার্থী ও শিক্ষানবিশদের যৌক্তিক-নৈতিক অধিকার আদায়ের জাতীয় সংগঠন হিসাবে আইনজীবী সনদ অধিকার আন্দোলন সদাতৎপর রয়েছে। আইনজীবী সনদ অধিকার আদায়ে কার্যকর গণআন্দোলন গড়ে তোলার ধারাবাহিক প্রয়াস চালানো হচ্ছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষ সমীপে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন আইন শিক্ষাপীঠ, বিশ্ববিদ্যালয় ও জেলাগুলো নিয়মিত চার দফা দাবি আদায়ে কর্মসূচি চলমান আছে। অনেক যৌক্তিক দাবিও আন্দোলন-সংগ্রাম ছাড়া বাস্তবায়ন করা যায়নি। বাস্তবিক প্রেক্ষাপটে শিক্ষানবিশি অন্তে আইনজীবী সনদ অধিকার অর্জনে কার্যকর গণআন্দোলনেরও বিকল্প নেই। তাই আইনজীবী সনদ অধিকার আন্দোলন উদাত্ত আহ্বান জানান দিয়েছে। তারুণ্যের স্বপ্ন বাঁচাতে, আইন পেশা ও সেবার মান উন্নত করতে সকলের নিজ-নিজ অবস্হান থেকে ভূমিকা রাখুন, কার্যকর গণআন্দোলনের ধারায় চলমান কর্মসূচি বিজয়ের লক্ষে এগিয়ে নিন।

আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে আইন শিক্ষার্থী ও শিক্ষানবিশগণ রাজপথে সোচ্চার হয়েছে। প্রয়োজন হলে আইন শিক্ষা পদ্ধতি ও বিষয়বস্তু নিয়ে পর্যালোচনা করা হোক। শিক্ষানবিশগণ পেশায় টিকে থাকতে পারে, তদানুসারে শিখন-পরীক্ষণ পদ্ধতি প্রচলন করা জরুরি হয়ে গেছে। জটিল, ব্যয়বহুল, সময়সাপেক্ষ ও হয়রানিমূলক তিন ধাপের পরীক্ষা নামক ছাঁটাই প্রক্রিয়া বাতিলপূর্বক সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে বিশেষায়িত পেশাভিত্তিক আইন শাস্ত্রে স্নাতকের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা চাই, উপজেলা আদালত চালু ও গ্রাম আদালত পর্যন্ত আইনজীবীদের কার্যক্রম বিস্তৃত করা ২। আইন পেশায় শিক্ষানবিশকাল এক বছর করা। শিক্ষানবিশকালে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, সেমিনার ও অ্যাসাইনমেন্টে অংশগ্রহণ সাপেক্ষে আইনজীবী সনদ প্রদান করা ৩। বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সমন্বয় সভার মাধ্যমে নির্দিষ্ট মেয়াদে আইন বিষয়ে স্নাতক পর্যায়ে কাম্য ছাত্র সংখ্যা নির্ধারণ করা অথবা বিশেষ প্রতিষ্ঠান গঠন করে আইনের ছাত্র সংখ্যা, সিলেবাস ও পেশাগত সংকট সমাধানে সমন্বয়ের ব্যবস্হা করা ৪। মামলায় নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত শিক্ষানবিশের অংশগ্রহণের ব্যবস্হা, বার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে আইনজীবী অন্তুর্ভুক্তিকরণের পূর্ব পর্যন্ত ন্যূনতম শিক্ষানবিশ সম্মানী ফি নির্ধারণ ও সংশ্লিষ্ট আইনজীবী সমিতির মাধ্যমে প্রাপ্তি নিশ্চিত করাসহ ৪ দফা দাবি বাস্তবায়নে চলমান যৌক্তিক ও নৈতিক আন্দোলনে সামিল হোন। আইনজীবী হলে তো বেতন দিতে হয়না; তাহলে হাজারো বেকারমুক্ত ও কর্মসংস্থান হয়, মানদণ্ড বজায় থাকে এমন আইনজীবী অন্তর্ভুক্তিকরণ পদ্ধতি চালু করার কোন বিকল্প নেই। উত্থাপিত ৪ দফাকে বিকল্প পদ্ধতি বিবেচনা করুন অথবা নয়া পদ্ধতি বাতলে দিন। আর কোন গড়িমসি, তালবাহানা ও হয়রানি চলবেনা। অচলায়তনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন বিনির্মিত হোক, গণআন্দোলনের পথেই ইনসাফ-অধিকার রক্ষিত হবে, বিজয় অবশ্যম্ভাবী।

লেখক: আহ্বায়ক, আইনজীবী সনদ অধিকার আন্দোলন, কেন্দ্রীয় কমিটি

আগামীনিউজ/এএইচ

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে