Dr. Neem on Daraz
Victory Day

প্রগতিশীল মানুষের বিরাট শত্রু ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদ


আগামী নিউজ | এ্যাড. হাসান তারিক চৌধূরী সোহেল প্রকাশিত: এপ্রিল ১৩, ২০২১, ০৫:২৯ পিএম
প্রগতিশীল মানুষের বিরাট শত্রু ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদ

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ আপনি একবার ভাবুন। ধর্মীয় উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ যে গ্রামে কিংবা শহরে আধিপত্য তৈরি করে বসে আছে সে এলাকায় কার্ল মার্কস, লেনিন কিংবা কমিউনিজমের বাণী প্রচার করতে গেলে আপনার কি অবস্থা হতে পারে? অথবা সেই গ্রামে আপনি যদি বিজ্ঞান আন্দোলন, যুক্তিবাদী সমিতি অথবা নারীমুক্তি আন্দোলন করতে যান। তাহলে কী হবে? জঙ্গিরা কি আপনার এই মত প্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার মেনে নিবে? আপনাকে তত্ত্বগতভাবে মোকাবিলা করবে? নাকি আপনাকে কতল করবে? বাংলাদেশে যেভাবে ধর্মীয় উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ গ্রাম-শহরে বিস্তার লাভ করছে তাতে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, এই অপশক্তি গোটা বাংলাদেশের মানুষকে একটা বার্তা দিতে চাইছে। সেটি হলো, আগামী দিনের বাংলাদেশে রাজনীতির বিকল্প শক্তি তারাই।

অন্য কেউ নয়। লোকবল, অর্থবল, অস্ত্রবল, ভোটের বল, বিদেশি শক্তির বল সব বিচারেই এরা আজকের বাংলাদেশে এক তৃতীয় শক্তি। এই সত্যি কেউ মানুক বা না মানুক। তাতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। গত ২৬ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং চট্টগ্রামসহ সারা দেশে হেফাজতে ইসলাম নামের ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনের কর্মী সমর্থকরা যে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। তার ভেতর দিয়ে তারা জানান দিয়েছে যে, এটি তাদের ঘোষিত এক সর্বাত্মক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে তাদের প্রতিপক্ষ কে ছিলো? হামলার ভিকটিমদের দিকে তাকালেই প্রতিপক্ষ চেনা যাবে।

২৬ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত এই ধর্মীয় উগ্রবাদী বা জঙ্গিবাদীদের হামলার ভিডিও ক্লিপগুলো দেখুন। তাদের মিছিল কিংবা অন্যান্য প্রচারণার ছবি, নিউজ ক্লিপগুলো দেখুন। যুদ্ধটা কাদের বিরুদ্ধে সবকিছু পানির মতো সাফসুতরো দেখা যাবে। প্রামাণ্য দলিল সাক্ষ্য দিচ্ছে, এই উগ্র ধর্মীয় তাণ্ডবে আক্রান্ত হয়েছে সঙ্গীত বিদ্যালয়, বইয়ের দোকান, হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, বিভিন্ন ভাস্কর্য, রেলস্টেশন, ভূমি রেকর্ড অফিসে রক্ষিত লাখো জমির মালিকানা দলিল, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি এবং আরও অনেক কিছু। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোট সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় এই ধর্মীয় উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদী শক্তিকে সীমাহীন বেপরোয়া বাহিনীতে পরিণত করেছে।

অন্যদিকে এই ধর্মীয় উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদের সহজাত মিত্র বিএনপি-জামাতের সরাসরি মদদে এই অপশক্তি এখন শুধু গ্রামের নিরীহ-অভাবি আলেমের পর্যায়ে নেই, অথবা সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর ‘লালসালু’ উপন্যাসের ‘মজিদ’ চরিত্রের পর্যায়ে নেই, এরা এখন নিজেদের ‘রাজনৈতিক বিকল্প’ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।

মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অর্থনৈতিক রেমিট্যান্সের সঙ্গে আসা ‘সাংস্কৃতিক রেমিট্যান্স’ তাদের আদর্শকে শক্ত ভিত্তি দিচ্ছে। শুধু রাজাকার-আলবদর তকমা দিয়ে এই শক্তিকে বিচার করলে মস্ত ভুল হবে। এরা এখন প্যান ইসলামিক রেনেসাঁর অথবা গ্লোবাল ইসলামিক খিলাফত আন্দোলনের অংশ।

এদের অনুসারী তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ কোনদিন দেখেইনি। ইউটিউবের লাখ লাখ ভিউ সমৃদ্ধ ওয়াজের ভিডিও কিংবা ফেসবুকের লাইভ স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে এদের মতাদর্শ এখন কোটি মানুষের কাছে পৌঁছেছে। এই বিশাল গণযোগাযোগের একটা রাজনীতি আছে। প্ল্যান অফ অ্যাকশন আছে। একে উপক্ষা করে বামপন্থি রাজনীতি বাংলার মাটিতে কোনদিনই এগুতে পারবে না। শুধু বামপন্থি কেন? কোন গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল রাজনীতিই এদেশে বিকশিত হতে পারবে না। আজকের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি, গণফোরাম এবং ভিপি নুরের নেতৃত্বে গড়ে উঠা দলগুলো এই সত্যটি বেশ ভাল ভাবেই বুঝে।

ফলে লুটেরা এবং সুবিধাভোগী শ্রেণির দল হিসেবে তারা এই পরিস্থিতির সুবিধাটুকু হাসিল করতে চায়। ভেবে দেখুন, ধর্মনিরপেক্ষ এবং কমিউনিস্টমুক্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টির মতো দলগুলোর জন্য কত বড় এক অভয়ারণ্য। সিপিবি বাংলাদেশকে এসব হায়েনাদের অভয়ারণ্য হতে দিতে চায় না বলেই জন্মলগ্ন থেকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন লড়াই পরিচালনা করে আসছে। এজন্য সিপিবির অনেক কমরেডদের রক্ত ঝরেছে। প্রাণ দিতে হয়েছে। চট্টগ্রামে মৌলবাদীরা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শাহাদাৎকে ঘুমন্ত অবস্থায় জবাই করে হত্যা করে। এরকম আত্মত্যাগই সিপিবির গৌরবময় ঐতিহ্য।

রাজাকার বিরোধী গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনের সময় ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজত ও জামাতের যৌথ হামলার তাণ্ডবে সিপিবি কেন্দ্রীয় অফিসই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়। টার্গেট করে সুপরিকল্পিত উপায়ে গান পাউডার দিয়ে সিপিবি অফিসকে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করা হয়। সিপিবির কেন্দ্রীয় অফিস মৌলবাদীদের হামলায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হবার পরও এদেশের কোন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল সাহায্যের জন্য কিংবা সহমর্মিতা জানাতে ছুটে আসেনি। বরং পাশের দেশ ভারত, নেপাল থেকে এ হামলার নিন্দা জানিয়েছে সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টি। সুতরাং এই অভিজ্ঞতা থেকে কমিউনিস্টদের মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টি যে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে। যে ধরনের নোংরা ভোটের রাজনীতি করে।

সেই ‘ধর্মীয় ভোট ব্যাংকের’ অসুস্থ রাজনীতির মাঠে বামেদের মৃত্যুই তাদের কাম্য। উপরন্তু আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামাত, জাতীয় পার্টির মতো দলগুলো সেই নোংরা রাজনীতির পূর্ণ সুবিধা নেয়ার জন্য দেশের ধর্মনিরপপেক্ষ সংবিধান এমনকি নিজেদের দলের মেনিফেস্টো পর্যন্ত পাল্টে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের নাগরিকদের গেলানো হয় রাষ্ট্রধর্মের তত্ত্ব। সার্বজনীন সেক্যুলার শিক্ষা ব্যবস্থার বদলে হাজির হয় উগ্র ধর্মবাদী শিক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক সিলেবাস। নির্বাসিত লেখিকা তাসলিমা নাসরিন উগ্রবাদের এই বিপদ সম্পর্কে বহু আগে জাতিকে সতর্ক করেছিলেন।

কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। লেখক হুমায়ূন আজাদ, অভিজিৎ রায়’সহ অনেকের নির্মম মৃত্যু আমাদের সবার জন্য এক শেষ সতর্ক ঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে গেছে। এক বিরাট প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেছে। আগামীর বাংলাদেশ আদর্শগত এবং সাংস্কৃতিকভাবে কাদের দখলে থাকবে? আধুনিক মুক্তচিন্তার মানবতাবাদীদের নাকি মধ্যযুগীয় ভাবধারার হাতে? গত ২৬-২৭ মার্চ ঘোড়ায় চড়ে তলোয়ার হাতে যেসব জেহাদি ছবি সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। তার রাজনৈতিক তাৎপর্য অনেক।

ভারতের বজরঙ্গ দল, শিব সেনা এভাবেই এসেছিলো। গেরুয়া কাপড়ে, কৃপাণ কিংবা ত্রিশূল হাতে। তখন অনেকেই পাত্তা দিতে চায়নি। ভারতের কমিউনিস্টরা চিৎকার করেছিলো। কেউ শোনেনি। আজ গান্ধী, নেহেরু, আম্বেদকর, মাওলানা হাসরত মোহানির ভারতে হিন্দু মৌলবাদ বা গেরুয়াতন্ত্র দেশটির দুইশত বছরের সমস্ত অর্জনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। অস্তিত্ব বাঁচাতে ভারতের কমিউনিস্টদের এখন নির্বাচনী জোট বাঁধতে হচ্ছে বুর্জোয়াদের সঙ্গে। ধর্মীয় মৌলবাদের বিপদ এমনই।

যদি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডবকে আমরা কেসস্টাডি ধরে নেই তাহলে দেখবো, সাম্প্রদায়িক নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে আগমনের প্রতিবাদে মাদ্রাসার আলেমদের প্রতিবাদের সূচনা। সাধারণভাবে এই প্রতিবাদ করার গণতান্ত্রিক অধিকার তাদের এবং সকলেরই আছে। কিন্তু এই প্রতিবাদের ভয়াবহ রুপান্তর লক্ষ্য করুন। প্রথমে সাধারণ মিছিল, পরে লাঠি মিছিল, তারপর সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীত বিদ্যালয়ে হামলা, তারপর মুক্তিযোদ্ধা পাঠাগার, হিন্দু মন্দির, রেলস্টেশন এবং সরকারি অফিসে হামলা অগ্নিসংযোগ। সবশেষে বঙ্গবন্ধুর ছবি পোড়ানো এবং পুলিশ ফাঁড়ি লুটের চেষ্টা। এখানে উল্লেখ করার বিষয় হলো, এই ঘটনার সময় পুলিশ কোন স্থাপনাকে হামলার হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি। সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ হামলার প্রস্তুতি সম্পর্কে কোনো আগাম তথ্য দিতে পারেনি। মহাশক্তিধর ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কাউকেই হামলা ঠেকাতে রাজপথে দেখা যায়নি।

বরং তারা গর্তে লুকিয়েছিলো। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সময়ে পার্লামেন্ট নির্বাচনের সময় দেখা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়েই এই মৌলবাদী শক্তির সমর্থন নিতে সর্বোচ্চ কনসেশন দিয়েছে। অথচ, সামান্য শক্তি নিয়ে স্বাধীনতা দিবসের ৫০ বছর পালনের নির্ধারিত কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে ছিল সিপিবির ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কর্মীরা। লজ্জার বিষয় এই যে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মৌলবাদী তাণ্ডবের বিরুদ্ধে একদিকে সিপিবি রাজপথে প্রতিবাদ করে, অন্যদিকে সুশীল সমাজ কিংবা বামজোটের শরিক কেউ কেউ জাতীয় প্রেসক্লাবে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলামের হরতালে সমর্থন দেয়। এই সমস্ত ব্যক্তিরা হয়তো ভুলে গেছে ইরানি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের সংগ্রাম এবং তাদের রাজনৈতিক ভ্রান্তির ইতিহাস।

বামদের ভ্রান্তির সুযোগে ইরানে মোল্লাতন্ত্র পাকাপোক্ত হবার ইতিহাস। মোল্লাতন্ত্রের হাতে হাজার হাজার কমিউনিস্ট নিধন এবং ইরানের কমিউনিস্ট পার্টি (তুদেহ পার্টি) কে নিষিদ্ধ করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়ার ইতিহাস। ফলে যারা ১৭শ শতকের কুতুবউদ্দিন আহমেদ ইবনে আবদুর রহিম ওরফে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভির ফুক্কা কুল্লে নেজামিন কিংবা মওলানা ভাসানীর ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব খান’ মার্কা রবুবিয়াতের চশমা দিয়ে হেফাজতে ইসলামের মধ্যে বিপ্লব খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারা ভুল করছেন নাকি ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন, সেই প্রশ্ন এখন উঠছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যে শক্তি এ তাণ্ডব ঘটালো তারা মোটেই রাজনীতি বিবর্জিত নয়।

আজ এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তাদের একটা সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নের দিকেই তারা এগিয়ে চলছে। যখন তারা ইরানের মতো রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর্যায়ে যাবে তখন এই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়েই যদি মৌলবাদীদের ‘বি’ টিমে পরিণত হয় তাতে অবাক হবার কিছু থাকবে না। জাতির এই মহাবিপদকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেই সিপিবি তার সর্বশেষ কংগ্রেসে যে চারটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ নির্ধারণ করেছে তার একটি হলো, ‘সাম্প্রদায়িকতা, সশস্ত্র সাম্পদায়িক শক্তির বিপদ, রাষ্ট্রের প্রবণতা, গণতান্ত্রিক অধিকার সংকুচিত করার চেষ্টা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার অপচেষ্টা প্রভৃতিকে গুরুতর বিপদ বলে বিবেচনা করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে আপসহীন, দায়িত্বপূর্ণ ও অগ্রবর্তী ভূমিকা পালন করার কথা বলেছে।

লেখকঃ আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট

আগামীনিউজ/প্রভাত

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে