Dr. Neem on Daraz
Victory Day

শিল্পরূপের পরিবর্তন


আগামী নিউজ | লুৎফর রহমান প্রকাশিত: এপ্রিল ১১, ২০২১, ০৩:৪০ পিএম
শিল্পরূপের পরিবর্তন

ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ আমাদের চারপাশ প্রকৃতি। প্রকৃতির হুবহু চিত্রায়ন ফটোগ্রাফি। শিল্পী প্রকৃতি ও মানুষের সমাজকে দেখেন এবং আত্মস্থ করেন। তারপর নিজের মনের রঙ মিশিয়ে তা বাইরে প্রকাশ করেন। তখন সেটা আর প্রকৃতির থাকে না শিল্পীর নিজের হয়ে যায়। তাঁর সৃষ্টি যখন সকলের হয়ে ওঠে তখনই তা শিল্প হয়, যা মানবিক সুন্দর এবং চিরকাল মানুষকে আনন্দ দেয়।শিল্পের আকৃতি, ধরন, পরিবেশ-কল্পনা ও প্রকাশভঙ্গির মধ্যে সম্পর্ক সৃষ্টি হলে শিল্পী ও সাধারণের মাঝে সম্পর্ক তৈরি হয়, একেই বলে শিল্পরূপ। শিল্পীর জীবন-দর্শনের ওপর শিল্পরূপের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ভর করে।শিল্প সবসময় একটি গতিশীল ব্যাপার। তাই যুগে যুগে শিল্পরূপে পরিবর্তন আসতে বাধ্য। মূলত তিনটে কারণে এমনটা হয়। যথা-

এক.

শিল্প একটি সৃজনশীল বিষয়। শিল্পী তাই প্রচলিতের পুনরাবৃত্তি করে চলতে পারেন না। গতিশীলতা শিল্পের প্রয়োজনেই এসে যায়। এই গতিশীলতাই শিল্পরূপের পরিবর্তনের প্রধান কারণ। 

দুই.

সাধারণের পরিমাণগত ও গুণগত চাহিদা শিল্পীর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা নতুন বৃত্ত রচনা করে যা শিল্পরূপের প্রচলিত বৃত্তগুলোকে ভেঙ্গে দেয়। কারণ মানুষের চিন্তা থেমে থাকে না, বস্তুজগতের অবিরাম পরিবর্তন এর কারণ। 

তিন.

শিল্পরূপের পরিবর্তনের তৃতীয় কারণটি এর প্রকাশভঙ্গি।নতুন বিষয়বস্তু সব সময় চায় নতুন প্রকাশভঙ্গি। শিল্পীকে তাই বাস্তব কারণে সাবেক শিল্পরূপ ভাঙ্গতে হয় নতুন শিল্পরূপের জন্য। জীবনের অবিরাম প্রবাহের সাথে গভীর সংযোগ রেখে একটা সঠিক সমতায় পৌঁছতে হয় জীবনশিল্পীকে। এখানে সে বেখেয়াল বা অতি সতর্ক কোনোটাই হতে পারে না। অর্থাৎ বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। শিল্পরূপের পরিবর্তনে এ বিষয়টিও কাজ করে। আরো একটি কথা বলতে হয় কোনো শিল্পরূপই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। সামগ্রিক জীবনের গুণগত পরিবর্তনের সাথে শিল্পরূপের পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। দাসসমাজে এসে আদিম সাম্যবাদী সমাজের বৈশিষ্ট্য আর বজায় থাকলো না। সুতরাং শিল্পরূপের পরিবর্তন হয়ে গেলো। তারপর পুঁজিবাদে এসে নতুন নতুন আবিষ্কার ও শিল্পবিপ্লবের কারণে সমাজ পণ্যোৎপাদন ব্যবস্থায় উপনীত  হলো। এই ব্যবস্থায় সামন্তযুগের রূপকথা, কিংবদন্তী, উপাখ্যান ও কেচ্ছার একক জবানবন্দীর ধারাকে বহুজনের জবানবন্দীর ধারায় বদলে দেয় উপন্যাস। রূপকথা, কিংবদন্তী ইত্যাদি থেকে মানব জীবনে ফিরতে শিল্পীকে উপন্যাসে নানা কৌশল নিতে হয়েছে। নানা রঙঢঙ, কৌতুকের পথে হাঁটতে হয়েছে।যুগে যুগে শিল্পরূপের পরিবর্তন-প্রক্রিয়ায় আরো কিছু উপাদান ভূমিকা রেখেছে। যেমন-

বিস্তৃত বাস্তব:

মানুষ শিল্পে তার চারপাশকে দেখতে চায়, নিজেকে দেখতে চায়, এটাই বিস্তৃত বাস্তব। ফলে সামন্তযুগের শিল্প থেকে পুঁজিবাদের শিল্প এবং পুঁজিবাদের শিল্প থেকে সমাজবাদের শিল্প পৃথক হতে পেরেছে সে তার শিল্পরূপ বদলিয়েই।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র:

প্রত্যেক শিল্পীর রয়েছে একটি স্বাধীন অস্তিত্ব অর্থাৎ সে সব সময় স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। শিল্পী মুক্ত মনের মানুষ। সে তাঁর ওপর আরোপিত কিছু মানতে রাজি নয়। এটাই তাঁর স্বাতন্ত্রবোধ। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র যখন গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে যুক্ত হয় তখন তা সুদূরপ্রসারী হয়ে ওঠে। আর মানুষের আকাঙ্ক্ষা সতত পরিবর্তনশীল, যে কারণে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র শিল্পের পরিবর্তনে একটি বিশেষ উপাদান হিসেবে কাজ করে। 

লোকজ বিষয়:

গণমানুষের ভাষা, সাধারণের আচরণ, মানব চরিত্র, ভাবাবেগ, তার আশা-আকাঙ্ক্ষার পেছনে কর্মযজ্ঞ অর্থাৎ জীবনসংগ্রাম মিলিয়ে গড়ে ওঠে লোকজ দিক যা প্রতিনিয়ত সময়ের পরিক্রমায় বদলাচ্ছে। প্রকৃতি আর মানুষের সমাজ নিয়েই শিল্পের কারবার। সুতরাং শিল্পরূপের পরিবর্তনে লোকজ বিষয় একটি উপাদান হিসেবে বরাবর কাজ করে। কারণ একই প্রকাশভঙ্গি ও ধারায় গণমানুষের এসব বিষয় ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব। শিল্প সৃষ্টিতে কাজ করে শিল্পীর অপরিমিতিবোধ এবং পরিমিতিবোধ। অপরিমিতিবোধ মানে শিল্পীর মনের অসংযত ভাব। শিল্প সৃষ্টি করতে গিয়ে শিল্পী পরিমিতির কথা ভাবেন না, সেখানে কাজ করে তাঁর মনের চাওয়াটা। সেটা হতে পারে শিল্পের আকৃতির বা প্রকাশের ভঙ্গির ক্ষেত্রে। অন্যদিকে শিল্পীর মধ্যে কখনো এমন একটি ধারণার জন্ম হয়, পরিমিতিবোধ শিল্পকে সুন্দর করবে সংহত করবে। সে সংযত হয়। আবার পরিমিতি ও অপরিমিতি দুই বিপরীত বিষয় হলেও দেখা যায় একই সময়ে কোনো শিল্পে একত্রে বিরাজ করে সমৃদ্ধ শিল্পরূপ প্রকাশ করছে। কারণ এ বিপরীত দুয়ের অবস্থান ও সংঘর্ষ শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যায় এবং শিল্পরূপের পরিবর্তনকে নিশ্চিত করে বস্তুজগতের পরিবর্তনের সাথে মিলিয়ে। যান্ত্রিকতা শিল্পের সংকট। শিল্প শিল্পীর মনোবাস্তব। এখানে যান্ত্রিকতা অন্তরায়। এটা শিল্পীকে নিম্নমুখী করে যেখানে মানবজীবন বিকশিত হয় ঊর্ধ্বমুখী হয়ে। এর সমাধান হলো শিল্পরূপের পরিবর্তন যা শিল্পীকে এই সংকট থেকে বের করে আনতে সক্ষম। শিল্পরূপের পরিবর্তন শিল্পীকে মনোকেন্দ্রিকতা থেকে বের করে এনে স্থাপন করে মানব-চরিত্রের বাস্তব বৈচিত্র্যে। এতে জনসাধারণ ও শিল্পীর মধ্যে গড়ে ওঠে সুসম্পর্ক আর এখানেই নতুন শিল্পরূপের সার্থকতা।মানবীয় বাস্তবতা, অনুভূতি প্রবণতা এবং আবেগোচ্ছল প্রকৃতি-প্রেম একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে শিল্পরূপ যা শিল্পী ও সমষ্টির মাঝে ঘটায় সমন্বয় এবং আমরা প্রত্যক্ষ করি শিল্পরূপের শ্রেষ্ঠত্ব যেখানে মৌলিকভাবে কাজ করে শিল্পীর আপন জীবন-দর্শন। 

লেখকঃ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্যিক

আগামীনিউজ/প্রভাত

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে