Dr. Neem on Daraz
Victory Day

প্রচারমাধ্যম, পণ্য-প্রচার এবং পৌরুষ


আগামী নিউজ | অধ্যাপক ড. মানস চৌধুরী প্রকাশিত: মার্চ ৪, ২০২১, ০৫:০৭ পিএম
প্রচারমাধ্যম, পণ্য-প্রচার এবং পৌরুষ

ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ পৌরুষ আপাতঃগ্রাহ্যে কোনোমতেই প্রচারমাধ্যম-নির্মিত প্রপঞ্চ নয়। অন্ততঃ নির্মাণ প্রক্রিয়ার সচলতা এবং বহুমুখিনতা নিয়ে বাড়তি সজাগ না থাকলে, এটা বিপজ্জনক প্রস্তাবনা হতে পারে যে মিডিয়া পৌরুষ তৈরি করছে। এই বিশেষ জিজ্ঞাসায় মিডিয়ার গুরুত্ব বরং একদম স্বতন্ত্র। দৃশ্যগত সামগ্রীর শক্তিমত্তাকে মাথায় রাখলে, সমকালীন প্রচার মাধ্যমের রয়েছে পরিসর বানাবার সুবিশাল সামর্থ্য। যাকে কিনা মুদ্রণ-পুঁজিবাদ বলা হচ্ছে সেখান থেকে এই নবোত্থিত মাত্রা উদ্ভূত এবং উৎসুক হয়েছে। মিডিয়া, যুগপৎ যোগান ও যোগাযোগের উপায় হিসেবে, প্রবল লিঙ্গের প্রতি একটা দ্বিমুখী সহায়তা দিয়ে থাকে।

প্রথমতঃ, নবোদ্ভূত পরিসর বিদ্যমান বিষম সম্পর্কে ইতোমধ্যেই সুবিধাভোগী প্রবল গোষ্ঠীকে বাড়তি ধরনের ভোগের ধরন যোগান দিতে সমর্থ।

দ্বিতীয়তঃ, মিডিয়া পরিবেশনরীতি নির্মাণ করে যা, যদি না প্রতিরোধ করা হয়, বিদ্যমান অসমতার মধ্যে প্রক্রিয়া করে, এবং পরিশেষে একে আরও মজবুত করে। এই বিশেষ প্রক্রিয়াই পুরুষ সত্তা বা পরিচয়কে পুনর্গঠন করে এবং পৌরুষকে উত্তুঙ্গ রাখে।

একই সঙ্গে, এটা সাধারণজ্ঞানের পর্যায়েই পড়ে যে প্রচার মাধ্যমের উত্তুঙ্গ বিকাশে বহুজাতিকসংস্থার ভূমিকা কেন্দ্রীয়, এর সহগ ভূমিকায় রয়েছে স্থানীয় বাণিজ্যসংস্থাগুলো। দেশী ও বহুদেশী সংস্থাগুলোর মিথোজীবী ভূমিকা এক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বিগত কয়েক বছরের বাংলাদেশে, কিংবা ‘উন্নয়নশীল বিশ্বের’ অন্যত্রও, দুটো স্বতন্ত্র প্রক্রিয়া দেখা গেছে যেগুলো আবার পরস্পর-সম্পর্কিত।

একটা হচ্ছে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের দ্রুত প্রবৃদ্ধি এবং অন্যটা হচ্ছে বাণিজ্যসংস্থাগুলোর উৎপাদসমূহের বিজ্ঞাপনী কার্যক্রমের বিস্তার। এসবের মধ্য দিয়ে কিছু অনুবর্তী-ফল দেখা দিয়েছে। প্রথমতঃ, সরকার-নিয়ন্ত্রিত জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের রাষ্ট্রব্যাপী একমাত্র দৃশ্য-শ্রুতি মাধ্যম হিসেবে গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে। দ্বিতীয়তঃ, বাণিজ্য সংস্থাগুলো পরিসরের এই বৃদ্ধি উদযাপন করছে তাদের উৎপন্নগুলোকে তুলনায় আরও বেশিসংখ্যক দর্শকের কাছে বিজ্ঞাপন করতে পারছে বলে।

তৃতীয়তঃ, দেশজ ‘সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’ বিষয়ক একটা বিতর্ক উদ্ভূত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, বাণিজ্য সংস্থাগুলো প্রায়শঃই এমন আইকনপ্রণালী প্রয়োগ করতে সচেষ্ট যাতে ‘স্বদেশী’ এবং ‘জাতীয়তা’ ইত্যাকার বিষয় পরিবেশিত হয়; সেটা বহুজাতিক সংস্থাগুলোর তরফে বরং অধিকতর সজাগ তৎপরতা।

অধিকন্তু, একটা সমরূপীকরণ প্রক্রিয়া লক্ষ্য করবার আছে রাষ্ট্রসীমা ভেদ করে একটা বৈশ্বিক ভোক্তাকুলের উদ্ভব যুগপৎ বস্তুরাজি ও দৃশ্যগত সামগ্রি ভোগ করবার বেলায় তাদের প্রকৃতির বিচারে। আমার উপলব্ধি হচ্ছে, বৈশ্বিক ভোক্তাকুলের উদ্ভব সত্তা (আইডেন্টিটি) সংগঠনের একটা প্রক্রিয়া এবং এর একটা লিঙ্গায়িত বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পরন্তু, ‘স্বদেশী’ বা ‘জাতীয়তা’র পরিবেশনও একটা লিঙ্গায়িত প্রক্রিয়া। এই পুরো বিষয়টির দিকে অনুসন্ধানী মনোনিবেশ সমকালীন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়া অনুধাবনের জন্য জরুরি। এই সামান্য রচনাটি একটা বিনম্র প্রচেষ্টামাত্র।

পুরুষ আদলসমূহ
বিজ্ঞাপনী দৃশ্যে পরিবেশিত পুরুষ ইমেজগুলোকে কেবলমাত্র শ্রেণীর প্রেক্ষিতেই পাঠ করা সম্ভব। ইমেজগুলো একটা নির্দিষ্ট পণ্য এবং এর টার্গেট ভোক্তাকুলের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর থেকে অনায়াসে এরকম ঢালাও কিছু ভাবা সম্ভব নয় যে পণ্যনির্মাতারা বহুজাতিক কিংবা বাংলাদেশী কেবল মধ্যবিত্ত পুরুষের ইমেজ বানিয়ে চলেছেন।

কী ইমেজ গড়ে তোলা হবে তা উৎপাদন সংস্থার নয় বরং টার্গেট ভোক্তার শ্রেণীর সাপেক্ষে নির্ধারিত। এই প্রেক্ষিতে, চলতি প্রবণতায় পুরুষ আদলগুলোকে মোটাদাগে দুটো ভাগে ভাগ করা যায় গ্রামীণ ও শহুরে। গ্রামীণ ইমেজ তৈরি করার ক্ষেত্রে একটা সহজ ফর্মুলা লক্ষ্য করা যায়। এখানে, খেয়াল করবার আছে যে, ‘গ্রামীণ’ পদটি যাকে কিনা ‘স্বদেশী’ বলা হয়ে থাকে তার সঙ্গে অদলবদলযোগ্য হিসেবে প্রয়োগকৃত হয়।

গ্রামীণ পুরুষেরা সচরাচর নির্মিত হন এমন পোশাকে যেগুলো নাগরিক দর্শকের কাছে যা ‘গ্রামীণ’ পোশাক বলে অনুধাবিত হয়ে থাকে লুঙ্গি ও গামছা। এদের একটা খুব আজব বাংলা উচ্চারণ রয়েছে যাকে গ্রামীণ ধরে নেয়া হয়, এবং বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলেই যে ধরনের বাংলা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এটাও উল্লেখের দাবিদার যে গ্রাম্যপনাকে তুলে ধরার জন্য মেকআপও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দাড়িওয়ালা মুখমণ্ডল, এলোমেলো চুল কিংবা চামড়ার ঘন রঙ। এসব আদলে অভিনয়ের জন্য নিয়োগপ্রদান এই প্রক্রিয়া আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। খুব বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া, গ্রামীণ পুরুষ চরিত্রে যেসব মডেল অভিনয় করেন তাঁরা প্রায়শঃই নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর।

অন্যদিকে নাগরিক পুরুষদের ইমেজ২ হচ্ছে মডেলদের জন্য সত্যিকার কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা যা তাঁরা অভিনয় করতে চান। যাহোক, এটা উল্লেখ করা অপ্রয়োজনীয় হতে পারে যে মডেলিং সাম্প্রতিককালে ক্রমশঃ গ্রহণযোগ্যতা-পেতে-থাকা একটা পেশা এবং এটা বিশেষভাবে একটা নাগরিক মধ্যবিত্ত পেশা। বিজ্ঞাপনী দৃশ্যাবলিতে নগর-পুরুষেরা, ‘বাস্তব’ জীবনের মতোই, কামানো-দাড়ি এবং পরিপাটি চুলসমেত, প্রায়শঃই ফুলহাতা জামা পরে হাতে একটা মোবাইল-ধরা, প্রসন্ন হাসিমাখা মুখ যথার্থ এক্সিকিউটিভ মুখাবয়ব।

যদি আরও তদন্ত করি, এই বিশেষ মুখোপস্থিতি সামগ্রিক সমাজে পুরুষের সম্ভাব্য নির্বাহী ভূমিকার সঙ্গে শর্তযুক্ত। ফলতঃ, এই পুরুষ আদলগুলো বৈষম্যপূর্ণ লিঙ্গীয় সম্পর্কের পাটাতনেই কেবল অর্থপূর্ণ হয় এবং পঠিত হতে পারে। অন্যভাবে বললে, পারিবারিক সম্পর্কসমূহে নির্বাহ করবার ভূমিকা, মোটাদাগে, রোজগার করবার সামর্থ্য এবং বিজ্ঞাপনগুলোতে সেটাই পুনরুৎপাদিত হয়ে থাকে। এটা আমি বোঝাতে চাইনি, সেরকমটা ইচ্ছেও নয় যে, গ্রামীণ পুরুষৃব ন্দ একটা অসম লিঙ্গীয় সম্পর্কের উপর সংগঠিত নয়। আমার লক্ষ্য হচ্ছে বিজ্ঞাপনে নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আধিপত্যকে স্পষ্ট রাখা। এবং, আমি আরও বলতে চাইছি, গ্রামীণ পুরুষদের ইমেজ পরিবেশন শহুরে পুরুষদের ইমেজ পরিবেশনের সমার্থক গুরুত্ব বহন করে না। সারাংশে, বিজ্ঞাপনী দৃশ্যাবলিতে গ্রামীণ ও শহুরে পুরুষ- ইমেজের যেকোনো তুলনার জন্য পয়লাতে শ্রেণীসম্পর্কের বিশ্লেষণ থাকা জরুরি।

গ্রামীণ-নাগরিক ডিকোটমি: কাক্ষিত পৌরুষ
যদিও বিজ্ঞাপনে অধিকতর পরিবেশিত নয়, তথাপি গ্রামীণ পুরুষ-আদলের বিশেষ তাৎপর্যময় ভূমিকা রয়েছে নাগরিক ইমেজ বানানোর ক্ষেত্রে, যা কিনা খদ্দের মধ্যবিত্তের জন্য কাঙ্ক্ষিত পুরুষ সত্তা। এক্ষণে গ্রামীণ ইমেজসমূহ, পরিসরের সংকুচিত ব্যবহার করে, দৃশ্যগত মাধ্যমে নাগরিক পুরুষদের চিত্রিত হবার জন্য বিশাল পরিক্ষেত্র খালি রেখে দেয় এবং সেই সুবাদে সম্ভাব্য তুলনাটাকেও অলখে চাঙ্গা রাখে। বিপ্রতীপতা বা প্রতিতুলনাটি বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করে। একটা গুরুতর ফলাফল হয় এতে।

বাহ্যতঃ গ্রামীণ-নাগরিক বিপ্রতীপটি কোনোরকম প্রশ্নব্যতীতভাবে বিজ্ঞাপনে জায়গা করে নেয়। অন্য ভাষায় বললে, পণ্যের রকমফেরের উপর আদল নির্মাণ প্রক্রিয়াটি সাফাইযোগ্য ও সাফাইকৃত হয়ে পড়ে। যেহেতু অধিকাংশ উৎপাদই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভোগের জন্য, নগর-ইমেজ তুলে ধরার এটাই সবচেয়ে বড় যুক্তি হতে পারে। বলাইবাহুল্য, আমি এখানে গ্রামীণ এবং/বা দরিদ্র মানুষজনের বিজ্ঞাপনে বঞ্চনার প্রসঙ্গ তুলছি না, কিংবা আমার অভিপ্রায় নয় সরল এমনকিছু বলা যে বিজ্ঞাপনে ইমেজের অধিকতর অংশগ্রহণ বা পুনরুৎপাদন কার্যক্ষেত্রে অধিকতর ভোগদখলের নিশ্চয়তা দিতে পারে। বরং, আমার তিনটা স্পষ্ট যুক্তি এবং/বা পর্যবেক্ষণ এখানে হাজির করার আছে।

প্রথমতঃ, যে প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞাপন মধ্যবিত্ত পুরষ আদল পুনরুৎপাদন করে এবং অধিকন্তু একটা নির্দিষ্ট ধরনের পৌরুষকে নর্ম বা আদর্শমান হিসেবে সমুন্নত করে তাকে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। দ্বিতীয়তঃ, কিছু গ্রামীণ ইমেজ যা ধনী হিসেবে প্রতিভাত হয় সেগুলো কেবল নাগরিক আদলের সম্পূরক হিসেবে যৌগ ভূমিকা বহন করে থকে এবং অতি অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট উৎপাদ/পরিষেবার ভোক্তাকুলের গ্রামীণ সংস্করণ হিসেবে পরিবেশিত হয়ে থাকে। ৩ এবং তৃতীয়তঃ,আগেরগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত, পরিবেশন প্রণালী সাধারণভাবে ‘আধুনিকতাবাদী’ একটা জমিনে প্রোথিত।৪ এখানে দৃশ্যগত মিডিয়ায় শহুরে পুরষ ইমেজের কিছু গঁৎবাঁধা ধরনের দিকে নজর দেয়া যেতে পারে। খসড়া একটা উদ্যোগ হিসেবে মুখ্য ধরনগুলোকে ছক আকারে দাঁড় করানো যায়: অবশ্যই, এখানে যেসব পর্যবেক্ষণ জড়ো করা হলো সেগুলো খুব সাধারণ পর্যবেক্ষণ এবং লক্ষণগুলো পুনরাবৃত্তির কারণে স্বতন্ত্র গুরুত্ববহ।

পৌরুষ এখানে উদ্যাপিত হয় পণ্য খরিদের মধ্য দিয়ে, এবং ‘সুখী’ পরিবারটির সদস্যদেরকে জিনিসপাতি সরবরাহ করতে পারার ভূমিকার মধ্য দিয়ে। কিন্তু এই সরল বিষয়টা বিদ্যমান লিঙ্গসম্পর্কে বিশেষ তেমন অর্থ বহন করে না যদি না একে সাপেক্ষিকভাবে পঠন করা হয়। গ্রামীণ পুরুষ ইমেজ যেভাবেই বা যেসকল ক্ষেত্রেই পরিবেশিত হোক না কেন, শহুরে পুরুষ-চারিত্র্য (পণ্য খরিদ ও জিনিসপাতি সরবরাহ) নেতিকরণের একটা প্রক্রিয়ার উপর দাঁড়ানো: মানুষজনের সামাজিক অস্তিত্বের নেতিকরণ, বিশেষতঃ ‘অপর’ পুরুষের, যাঁরা সমরূপ ভূমিকাদি নিতে অক্ষম। আর সামাজিক অস্তিত্ব একটা নৈর্ব্যক্তিক বস্তুগত দশা, এমন একটা সম্পর্করাজিতে প্রোথিত যার মধ্যে মানুষজন বসবাস করেন, এবং তাঁদের অভিপ্রায় যাই হোক না কেন তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন সেটা।

অধিকন্তু এটা নেতিকরণ করে একই শ্রেণীর নারীদের সংগ্রামকে যাঁরা বিশেষভাবে পুরুষাধিপত্যের একটা পেশাজগতে আত্মপ্রতিষ্ঠায় প্রচেষ্ট। একই ধরনের বিজ্ঞাপনমালায় নারীর ইমেজ অবশ্যই পুরুষ বীক্ষণের সাপেক্ষে সুন্দর ও আকর্ষণীয়, তবে এখানে সেটা আলোচ্য নয়।৫ এই নেতিকরণ প্রক্রিয়া পৌরুষ রচনা প্রক্রিয়ার আবশ্যিক দিক, ফলতঃ ডিসকার্সিভ, এবং একে পণ্যের সামাজিক জীবনের৬ বয়ানের অংশ হিসেবে দেখতে হবে। পণ্যবয়ান ও পৌরুষ এখানে বিযোজ্য নয়।

প্রসঙ্গসূত্রে, পুরুষ ইমেজ পরিবেশনে গ্রামীণ-শহুরে বিপ্রতীপ তাই কিছু উহ্য ঘটনাবলি দ্বারা নির্মিত এবং প্রবল কিছু অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত। উপরের ছকের একদম ডানদিকের কলামটি এক্ষেত্রে স্মরণযোগ্য। যদিও আপাতঃদৃষ্টে সরল, কিন্তু এর থেকে স্পষ্ট অনুধাবন সম্ভব যে কীভাবে কিছু সামর্থ্য ও অনুশীলন পরিবেশন-প্রণালীর জন্য একেবারে ভিত্তিভূমিক। ছকটা ইঙ্গিত করতে পারে কীভাবে ইমেজের মধ্য দিয়ে পৌরুষের বিশেষ নির্মাণ হয় এবং কী বিশেষ ধরনে নাগরিক মধ্যবিত্তের প্রবল ভাবনায় এটা কাঙ্ক্ষিত। আপাতঃগ্রাহ্যে মনে হয়, দরিদ্র ও গ্রামীণ মানুষজনের বিপরীতে ইমেজেরএই ধরনগুলো সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা দিচ্ছে।

কিন্তু বিজ্ঞাপনগুলোর দিকে, একই সঙ্গে খোদ মধ্যবিত্তের দিকে, গভীরতর মনোযোগ দিলে উপলব্ধি করা যায় যে কাঙ্ক্ষিত পৌরুষের অর্থনির্দেশনা সমৃদ্ধিকে ছাপিয়ে যাওয়া একটা প্রসঙ্গ। কেবল খরিদ করবার সামর্থ্য নয়, বরং সঠিক জিনিস৭ সম্বন্ধে জানতে পারা, চিনতে পারা ও বাছাই করতে পারার যোগ্যতা পৌরুষকে সুনিশ্চিত করে, অবশ্যই এরকমটা করবার অভিপ্রায় সমেত।


বৈশ্বিক ভোক্তা হিসেবে পুরুষ সত্তা
বিজ্ঞাপনী দৃশ্যাবলিতে প্রদর্শিত প্রক্রিয়া কাণ্ডসমূহকে একটা সহজ উপায়ে বিশ্লেষণ করা যায়। এখানে আমি ভোগ ধারণাটির প্রয়োগ করতে চাইছি। আমার বক্তব্য কিন্তু এই নয় যে অনুধাবনের জন্য ভোগ একটা সরল প্রক্রিয়া, কিংবা এটাও আমার বক্তব্য নয় যে বিজ্ঞাপনী দৃশ্যসামগ্রি পঠিত হওয়া সম্ভব শুধুমাত্র ভোগের প্রেক্ষিতেই। আমার লক্ষ্য হচ্ছে বড়জোর ইমেজের একটা পরিবেশন রীতি হিসেবে ভোগের গুরুত্ব তুলে ধরা এবং এই রীতি যে পুরুষ আদলের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে তা উল্লেখ করা। কিন্তু ভোগ প্রত্যয়টির প্রয়োগ কিছু সংশয়ের জন্ম দিতে পারে যা নিয়ে গোড়াতেই নিশ্চিত থাকা দরকার।

এখানে ভোগপ্রণালীকে শনাক্ত করা সম্ভব অন্ততঃ তিনটা পর্যায়ে: ক) বিজ্ঞাপন হিসেবে যেসব দৃশ্যগত ইমেজ তৈরি হচ্ছে সেগুলোর ভোগ, খ) মিডিয়াতে বিজ্ঞাপিত পণ্যাবলির ভোগ, গ) পণ্যকে বিপণনের স্বার্থে বিজ্ঞাপনে দৃশ্যায়িত ভোগ। এখানে আমি ভিস্যুয়াল নিয়ে আলাপে এই শেষোক্তটির কথা বলছি।

বিজ্ঞাপনে ভোগকে একটা পরিবেশনরীতি হিসেবে প্রয়োগ অবশ্যই বোধগম্য। কোনো একটা পণ্য বিকোতে গিয়ে এটা দেখানোই সবচেয়ে সহজ উপায় যে কীভাবে মানুষজন পণ্যটাকে খুশি মনে ও আগ্রহের সঙ্গে ভোগ করছেন। কিংবা, যেটা ইদানীং বেশ সাধারণ একটা প্রবণতা, কীভাবে একজন মিডিয়া-তারকা ওই উৎপাদটি ব্যবহারে করে পরিতৃপ্ত থাকছেন। এখানে স্পষ্ট হবার দরকার আছে যে সমকালীন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়৮ পণ্যের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে যাকে অর্থশাস্ত্রের নিপাট পরিভাষায় ‘চাহিদা’ বলা হয়ে থাকে তার সঙ্গে সামান্যই সম্পর্ক আছে। ফলতঃ, পণ্যপ্রচারকদের৯ পক্ষে পণ্যকে ‘মর্যাদাবস্তু’ হিসেবে প্রদর্শন করবার চাপটা থাকেই। ‘মর্যাদা-বস্তু’ এবং ‘সঠিক জিনিস’ এর মধ্যকার ডিলেমাটাকে ভোক্তা তরফে সামলাতে পারবার ব্যাপার আছে। কিন্তু বিজ্ঞাপনী সংস্থাসমূহ এবং উৎপাদকৃবন্দও বটে সবসময়েই এই দুইকে কায়দামতো উল্টেপাল্টে সামনে রাখছেন।

ফলে স্বচ্ছল শ্রেণীর পুরুষেরা কোনোরকম অহেতুপনার দায় থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। এই প্রক্রিয়াটি, আমার বক্তব্য, নতুন ধরনের পৌরুষকে গঠন করছে। আমার লক্ষ্য হচ্ছে এই বিষয়টাকে ঠাহর করা যে এই গঠনপ্রক্রিয়ার কিছু বৈশ্বিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, ফলে রয়েছেও পৌরুষেরও। হালের সময়ে বহুজাতিক সংস্থা উৎপাদিত পণ্য রকমফের ও পরিমাণে একটা উত্তুঙ্গ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তথাপি, একে কেবল এমন সহজ কিছু হিসেবে অনুধাবন করা ঠিক হবে না যে বিশ্বব্যাপী কিছু মর্যাদাকর ব্র্যান্ড১০ ছড়িয়ে পড়েছে। বরং, ভোগপ্রণালী কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সেটাও পঠিত হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। উৎপাদনের ব্যাপকতা এবং বিপণনের সামর্থ্য বিচারে বহুজাতিক সংস্থাগুলো বিশেষ গুরুত্বের দাবিদার। স্থানীয় সংস্থাগুলোর গুরুত্ব ভোগপ্রণালী রূপায়নে সম্পূরকের, দেশজতাকে নির্দেশ করবার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শকের।

আমার লক্ষ্য ছিল ভোগবাদকে যুগপৎ একটা পরিবেশনরীতি এবং, বিশেষতঃ, পুরুষ সত্তার বিকাশমান একটা স্থপতি হিসেবে ঠাহর করা। নারী ভোক্তার বিশ্বব্যাপী উলম্ফনকে আমি এখানে আলোচনায় আনিনি এবং পূর্বতন বক্তব্যকে দাঁড় করাতে সেটা জরুরি শর্তও নয়। আমি বড়জোর বলবার চেষ্টা করছি এই যে পুরুষকুল নয়া সত্তা উদ্যাপন করছেন নয়াপৌরুষ এমন একটা প্রক্রিয়া বর্তমানে যার বৈশ্বিক ধরন রয়েছে।

একই সময়ে, স্বদেশীপনার একটা আশু কাঁদুনি শুরু হয়েছে। সেটাকে বৈশ্বিক সত্তা গঠন প্রক্রিয়ার প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা চলবে না। যেমনটা কিনা গ্রামীণ-শহুরে ডিকোটমির বেলায়ও, বৈশ্বিক এবং দেশজ একটা অখণ্ড পরিবেশন প্রক্রিয়ায় কাঠামোগতভাবে যুক্ত।

পাদটীকা:
১। নানা কারণে এই রচনাটি বহু বছর হয়ে ওঠেনি। এবং এখন যা হলো সেটা আমার লক্ষ্যের তুলনায় একটা খুব সাধারণ খসড়াই হলো। কিন্তু এতদিন না-হয়ে উঠবার পিছনে এবং এখনো কাঙ্ক্ষিতভাবে না-হবার পিছনে কিছু একান্ত কারণ আছে। আমি আশাকরি সামনে কাজটাকে আরও দাঁড় করাতে পারব যেখানে প্রসঙ্গের জটিলতাকে একাধিক পাটাতনে দেখবার চেষ্টা করা সম্ভব হবে। বিভিন্ন সময়ে আমার সহকর্মী কিছু বন্ধুর কাছে কাজটার সূচনাকাল থেকে আমি ঋণী।

২। এই রচনায় আমি ‘শহুরে বা নাগরিক পুরুষ’ বলতে আমি ‘মধ্যবিত্ত পুরুষ’ও বোঝাচ্ছি। এখানে এটা স্পষ্ট করবার দরকার আছে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর গঠন ঔপনিবেশিক কাল থেকেই নগরায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংমিশ্রিত যার অত্যন্ত কর্কশ সব অনুবর্তী ঘটনাপ্রবাহ রয়েছে। মহানগরের শ্রমিক শ্রেণীর ব্যাপারে আমি সম্যক সচেতন আছি, এবং সেজন্যেও আমি বলতে চাইছি যে, ‘অন্য’ যেসকল শ্রেণী বিজ্ঞাপনী দৃ শ্যাবলিতে প্রদর্শিত হয় তাদেরকে দেখানো হয় গ্রাম থেকে নগরে ‘আগত’ হিসেবে। প্রক্রিয়া হিসেবে এই পরিবেশনরীতিকে অবশ্যই বাংলাদেশের নগরে শিল্পভিত্তির অভাবের পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে হবে। ইউরোপ বা আমেরিকার মতো বছরের পর বছর ধরে পেরি-আর্বানে শ্রমিক বসতি পাকাপাকিভাবে গড়ে তুলতে এখানে হয়নি।

৩। একটা বিজ্ঞাপনের কথা এখানে বিশেষভাবে মনে পড়ছে। প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করবার একটা প্রাইভেট গবেষণাগারের বিজ্ঞাপন এটা। বাণিজ্যিক স্বাস্থ্য পরিষেবার দ্রুত প্রবৃদ্ধিকে যদি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে থাকি, তাহলে এটা অবশ্যই পরিষ্কার যে নবোদ্ভূত সকল ধরনের প্রাযুক্তিক কায়দা গ্রামদেশেও এর খদ্দের খুঁজে নিয়েছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা ও বাজার সম্পর্কের জটিল সম্বন্ধের বাইরেই আমি বিজ্ঞাপনটির মূলসার নিয়ে উৎসাহী এখানে। গ্রামের একজন শিশুরুগীর মা-বাবা, দুশ্চিন্তিত এবং দরিদ্র অবয়বের, পরামর্শ পাচ্ছেন বাহ্যৃদৃষ্টে ‘জ্ঞানী’ একজন ¯া’ নীয় পুরুষের মনে হয় একজন স্কুলশিক্ষক যাতে তাঁরা ওই বিশেষ ল্যাবে গিয়ে সঠিক পরীক্ষাগুলো করান। বিজ্ঞাপনটি শেষ হয় এরকম একটা বাণীতে: ‘নয়া জীবনের সন্ধান’ ‘সার্চ ফর আ নিউ
লাইফ’।

৪। ভুল বোঝাবুঝিতে এটা বেশ বিপজ্জনক বক্তব্য হতে পারে। পরিশেষে দর্শকশ্রোতৃমণ্ডলে যেসব মূলবক্তব্য সঞ্চালিত হয় তার যেকোনো একটা নিয়ে ভাবা যায়। আজকালকার দিনের জন্য জরুরি উপায় (মীনস) হিসেবে প্রদর্শিত কোনো পণ্যের যদি খরিদ-সামর্থ্য কারো থাকে তাঁর কি আসলে কোনো ‘চয়েস’ আর অবশিষ্ট থাকে সেটা খরিদ না-করবার? টাকা পয়সা আছে এমন কারো পক্ষে কি, ধরা যাক, গুরুতর প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষাগারে না-গিয়ে থাকা সম্ভব সংশি- ষ্ট সময়কালে?

৫। একটা স্বতন্ত্র আলোচনায় এটা চিত্তাকর্ষক বিশে- ষণ হতে পারত যে কীভাবে বিজ্ঞাপিত সমর্থ পুরুষের সামর্থ্য বিজ্ঞাপিত মোহনীয় নারীর লাবণ্যের সঙ্গে কাঠামোগতভাবে সম্পর্কিত।

৬। Appadurai, A. 1986: The Social Life of Things: Commodities in Cultural Perspective. Cambridge: Cambridge University Press.

৭। পুরুষদের আড্ডায় সঠিক পণ্য/জিনিস চিনতে-পারার/কিনতে-পারার আত্ম-গরিমা একটা বহুলচর্চিত বিষয়। পণ্য যাই হোক, পরিশেষে এই গরিমার মূল বার্তা হলো ‘তার’ সজাগতা ও প্রযতড়ব। এক্ষেত্রে, গেরস্থালি কাজের জন্য ‘ভাল’ জিনিস কিনতে-পারা অর্থনির্দিষ্ট হয় ‘স্ত্রী’র প্রতি ভালোবাসা যতড়বআত্তি হিসেবে। একটা বিশেষ আড্ডায়, হয়তো মিশ্রলিঙ্গ আড্ডায়, এটা এমনকি অন্যান্য পুরুষের জন্য ঈর্ষার বিষয়ও হতে পারে।

৮। শাস্ত্রীয়ভাবে এখানে উৎপাদন প্রণালী (মোড অব প্রডাকশন) না-বলে ব্যবস্থা বলাটা আমার তরফে ইচ্ছাকৃত। যেহেতু মার্ক্সীয় শাস্ত্রে ‘উৎপাদক শক্তি’র সবচেয়ে মুখ্য উপাদান হচ্ছে শ্রম, এবং যেহেতু যে প্রμিয়ার কথা আমরা বলছি সেটাতে এই প্রপঞ্চই নিদারুণ অনুপস্থিত, সেহেতু তার সঙ্গে একটা দূরত্ব রাখার প্রচেষ্টা এটা।

সমকালীন পুঁজিবাদকে উপলব্ধির জন্য বিশ্বব্যাপী স্বচ্ছল ভোক্তাশ্রেণীর উদ্ভবকে খতিয়ে দেখবার দরকার রয়েছে। এটা সযতড়বভাবে মাথায় রাখা দরকার যে জমাকাক্সক্ষী উদ্বৃ ত্ত শ্রেণীর থেকে, নয়া জমানার, ভোগকাক্সক্ষী উদ্বৃ ত্ত শ্রেণী গুরুতরভাবে স্বতন্ত্র Ñ অন্ততঃ এই কারণেও যে পুনর্বিনিয়োগে শ্রমসংযুক্তির সুযোগ/দখল দ্বিতীয় পুঁজি নেয় না। এটা সম্পর্কস্থাপন করে আরও শক্তিশালী বহুজাতিক পুঁজির উৎপাদনের সঙ্গে। সনাতনী অর্থশাস্ত্রের প্রাথমিক বইগুলো থেকে ‘চাহিদা’ ‘উপযোগ’ এসব অর্থবৈকল্যের পদগুলো উঠে গেলে বোধহয় আখেরে ভাল হয়।

যাহোক, একদম ভিনড়ব পাটাতনে, ও প্রয়োজনে, ভোগপ্রণালী বা মোড অব কনসাম্পশন নিয়ে শক্তিশালী সব কাজ চলছে। আমার এই মুহূর্তে অধ্যাপক রিৎজারের কাজ স্মরণ পড়ছে।

Ritzer, G. 1996: The McDonaldization of Society: An Investigation into the Changing Character of Contemporary
Social Life. Thousand Oaks, CA: Pine Forge Press.
Ritzer, G. 1999: Enchanting a Disenchanted World: Revolutionizing the Means of Consumption. Thousand
Oaks, CA: Pine Forge Press.

৯। বিশেষতঃ তৃতীয় বিশ্বের প্রান্তিক পুঁজিবাদী সমাজে কেবল বিজ্ঞাপনী সংস্থা এবং পণ্যোৎপাদকের পরিবেশনরীতিক সম্পর্ক প্রায়শঃই অভিনড়ব বাজার উপলব্ধির উপর দাঁড়ানো বলে মনে হয় না।

১০। বাংলাদেশে বরং একদম ভিন্ন। দৃ শ্যগত বিজ্ঞাপনী পরিজগতকে লক্ষ্য করলে এটা বিশেষ বিস্ময় তৈরি করবার মতো জিজ্ঞাসা যে কেন হালের বাংলাদেশে, পুরুষদের নানারকম ‘প্রেস্টিজ পণ্য’ উত্তুঙ্গ বাজার সৃ ষ্টি করলেও টেলিভিশন মাধ্যমে সেসব পণ্যের বিপণন তেমন নেই বললেই চলে।

বহুজাতিক ও দেশীয় সংস্থাগুলোর সম্পূরক ও মিথোজীবী ভূমিকার বিষয়টাই এতে আরও স্পষ্ট হয়। স্যাটেলাইটের রাষ্ট্রভেদী দর্শকপ্রাপ্তিতে বিদেশী প্রচারচ্যানেলগুলোতে এই পণ্যসমূহের বিজ্ঞাপন সেই প্রয়োজনটা মিটিয়ে দেয়। আবার দেশজ রূপনির্মাণের চাপ নিতে হয় না।

লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


এই লেখাটি লেখকের একান্তই নিজস্ব মতামত, এর দায়-ভার কোন ভাবেই আগামী নিউজ কর্তৃপক্ষ বহন করবে না।  


আগামীনিউজ/প্রআ

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে