Dr. Neem on Daraz
Victory Day

সের্গেই আইজেনস্টাইন মানুষের কথা বলতো যাঁর চলচ্চিত্র


আগামী নিউজ | ঋদ্ধ অনিন্দ্য গাঙ্গুলী প্রকাশিত: জানুয়ারি ২১, ২০২১, ০২:৫৮ পিএম
সের্গেই আইজেনস্টাইন  মানুষের কথা বলতো যাঁর চলচ্চিত্র

ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ বিশ্ব চলচ্চিত্রে মন্টাজের ব্যবহার এখন সর্বত্র। ইন্টারনেটজুড়ে মন্টাজের ওপর বিভিন্ন গবেষণাপত্র খুঁজে পাওয়া যাবে চাইলেই। অল্প সময়ে অনেকগুলি ফ্রেমের ব্যবহার করে একটি বৃহৎ সময়কাল বা ঘটনাপ্রবাহকে বড় পর্দায় সহজে ফুটিয়ে তোলার এই অভিনব পন্থাটি যার আবিষ্কার করা, তাঁর নাম সের্গেই আইজেনস্টাইন। 

আইজেনস্টাইনের জন্ম এক মধ্যবিত্ত পরিবারে, ১৮৯৮ সালের ২২ জানুয়ারি, লাটভিয়ার রাজধানী রিগা’তে। ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন, স্ট্রাইক, অক্টোবর -এর মতো বহু বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রের নির্মাতা সের্গেই আইজেনস্টাইন। প্রথম চলচ্চিত্রকার, যিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন, চলচ্চিত্রও হতে পারে পঠনের বিষয়, শেখার বিষয়। আইজেনস্টাইন শুধু নির্মাতাই নয়, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন চলচ্চিত্রের একজন পদ্ধতিগত তাত্ত্বিক হিসেবে, যিনি চলচ্চিত্রকে ব্যাখ্যা করতে শিখিয়েছেন নানা আঙ্গিকে এবং বেশ কিছু লেখালেখির মাধ্যমে চলচ্চিত্রভিত্তিক পাঠ্যক্রমে নিয়ে এসেছিলেন কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন। 

সের্গেই আইজেনস্টাইনের পিতা মিখাইল ওসিপোভিচ আইজেনস্টাইন ছিলেন একজন প্রখ্যাত স্থপতি। তাঁর কর্মসূত্রেই সের্গেই আইজেনস্টাইনকে পরিবারের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হয়েছে। কোনোখানেই বেশিদিন থাকা হতো না তাদের। পরিবারের উৎসাহেই বাবার মতো স্থপতি হতে চেয়েছিলেন আইজেনস্টাইন। সে ইচ্ছা থেকেই স্কুলজীবন শেষ করে পেট্রোগ্রাদ ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্থপতিবিদ্যা নিয়ে ভর্তি হন তিনি। কিন্তু ১৯১৮ সালে বাবার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে রুশ বিপ্লবে শামিল হওয়ার জন্য তিনি লালফৌজে যোগ দেন। 

১৯২০ সালে আসেন মস্কোতে। আইজেনস্টাইনের শিল্পী সত্তার বিকাশ পূর্ণাঙ্গ হওয়া শুরু করে যখন মস্কো এসে তিনি আগ্রহী হন থিয়েটারে। দ্রুতই থিয়েটারকর্মী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন তিনি। নাম ছড়িয়ে গোটা শহরে। থিয়েটারপাড়ায় আইজেনস্টাইনের উপস্থিতি অন্য মাত্রা এনে দিতো সকল আড্ডায়, সকল আসরে। 

শিল্প তাত্ত্বিক হিসেবে আইজেনস্টাইন আত্মপ্রকাশ করেন ১৯২৩ সালে, “মন্টাজ অব অ্যাট্রাকশন” বই দিয়ে। একই বছর “গ্লুমভস ডায়েরি”-র মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র দিয়েই তাঁর কাজের শুরু। তবে তিনি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ১৯২৫ সালে, যেটির নাম ছিলো “স্ট্রাইক”। এই চলচ্চিত্রটি কাহিনী গড়ে ওঠে বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ার একটি কারখানা ধর্মঘট নিয়ে। একই বছর নির্মিত হয় “ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন”, যে চলচ্চিত্রটিকে অনেকেই শুধু আইজেনস্টাইনের নয়, ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলোর একটি মনে করেন। এই চলচ্চিত্রটিই আইজেনস্টাইনকে আন্তর্জাতিক মহলে পরিচিত করে তোলে। ডাক আসতে থাকে হলিউড’সহ বিভিন্ন জায়গার প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে। তবে আজীবন বিপ্লবী আইজেনস্টাইন প্রস্তাবগুলো বাছাই করেন অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। কোনোকিছুই তিনি কখনো তাঁর আদর্শের বিপরীতে গিয়ে করেননি। “ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন” বিশ্বব্যাপী এতটাই সমাদৃত হয় যে, ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ম্যাগাজিন “সাইট অ্যান্ড সাউন্ড” এটিকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের তালিকায় ১১তম অবস্থানে রেখেছে। চলচ্চিত্রটির একটি প্রখ্যাত দৃশ্য “দ্যা স্টেপ সিকোয়েন্স” নামে চলচ্চিত্র মহলে আজও পরিচিত এবং বহুল বিশ্লেষিত। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এ দৃশ্যটি একটি বিশেষ অংশজুড়ে রয়েছে। 

এর পরপরই রুশ বিপ্লবের দশম বার্ষিকী উপলক্ষে আইজেনস্টাইন নির্মাণ করেন “অক্টোবর : টেন ডেইজ দ্যাট শুক দ্যা ওয়ার্ল্ড”। এই চলচ্চিত্রটিকে রুশ বিপ্লবের একটি অনন্য দলিল হিসেবে গণ্য করা হয়।  ১৯৪০-এর দশকে আইজেনস্টাইনের অন্যতম কৃতিত্ব “ইভান ট্রায়োলজি”। ট্রায়োলজির তিনটি চলচ্চিত্রের প্রথমটি “ইভান দ্যা টেরিবল”। এই চলচ্চিত্রটির জন্য তিনি ১৯৪১ সালে সোভিত ইউনিয়নের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্ট্যালিন পুরস্কারে ভূষিত হন। 

আইজেনস্টাইনের বিশেষ আগ্রহ ছিলো বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, ভাষাতত্ত্ব এবং সাহিত্যে। নিজের আগ্রহকে কখনোই দমিয়ে না রেখে এই সবগুলি ক্ষেত্রকেই বিশেষভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহও তৈরি হয় এরই ধারাবাহিকতায়। আইজেনস্টাইন বুঝেছিলেন, চলচ্চিত্রই একমাত্র শিল্পমাধ্যম, যাতে তার আগ্রহের সবগুলি ক্ষেত্রকে একসাথে এনে তিনি কাজ করতে পারেন। শিল্পের অন্যান্য ধারা, যেমন সঙ্গীত, চিত্রাঙ্কণ এবং ভাস্কর্যেও বিশেষ আগ্রহী ছিলেন আইজেনস্টাইন। একইসাথে, আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রে বিভিন্ন সংস্কৃতি ও নানা মনস্তত্ত্বের দৃশ্যায়ন মুগ্ধ করতো বড় পর্দার দর্শকদের। ফ্রয়েড, মার্ক্স এবং মায়াকোভস্কির লেখালেখি ও দর্শন বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলো আইজেনস্টাইনকে। 

মন্টাজের উদ্ভাবন ও ব্যবহারের জন্য চলচ্চিত্র-জগৎ বিশেষভাবে স্মরণ করে তাঁকে। তবে এই মন্টাজের আবির্ভাবের পেছনেও থেকে গিয়েছে একটি মজার গল্প। বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির পঠন-পাঠন বিশেষভাবে টানতো আইজেনস্টাইনকে। এ কারণেই এশিয় বিভিন্ন ভাষা নিয়ে ছিলো তাঁর পড়াশোনা। জাপানের একটি বিশেষ লেখন পদ্ধতি অধ্যয়ন করতে গিয়ে আইজেনস্টাইনের মাথায় প্রথম মন্টাজের ধারণার আবির্ভাব ঘটে। জাপানি ওই লেখন পদ্ধতি ছিলো আইডিয়োগ্রাম ভিত্তিক। একাধিক চিহ্ন ব্যবহার করে, একটি লম্বা বাক্য লেখা এড়ানো যেতো এই পদ্ধতিতে। এখান থেকেই আইজেনস্টাইন ভাবেন, একাধিক ছোট ছোট শটকে একসঙ্গে জোড়া লাগিয়ে অল্প সময়ের ব্যবহারে বড় পর্দায় ফুটিয়ে তোলা যায় একটি লম্বা সময়ের ঘটনাপ্রবাহ। আইজেনস্টাইনের প্রখ্যাত বই “ফিল্ম ফর্ম”-এর একটি গোটা অধ্যায় আরো সুন্দর ব্যাখ্যা করে মন্টাজ ও এর ইতিহাসকে। চলচ্চিত্রের নানা পদ্ধতিগত দিক নিয়ে আইজেনস্টাইনের তত্ত্ব ও বিশ্লেষণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তাঁর পরবর্তী সময়ের প্রায় সমস্ত নির্মাতাদের। ডিজিটাল ফিল্ম আর্কাইভ মোতাবেক, আইজেনস্টাইনের “ব্যাটেলশিপ পোটেমকিন” এবং তাঁর মন্টাজ থিয়োরি পরবর্তীতে আলফ্রেড হিচককের “সাইকো”, স্টিভেন স্পিলবার্গের “শিন্ডলার’স লিস্ট”-সহ অসংখ্য বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্রের অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। 

১৯৪৮ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি, মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান চলচ্চিত্রকার। 

অসময়ে মৃত্যু হলেও তাঁর কর্মজীবন এখনও পর্যন্ত মুগ্ধ করে চলচ্চিত্র নির্মাতাদের। আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্র বেঁচে থাকে মানুষের মনে। এখনও দ্রোহের ভাষা হয়ে ফুটে ওঠে পর্দায়। 

লেখক : সাংস্কৃতিক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে