Dr. Neem on Daraz
Victory Day

পেঁয়াজ কেন কাঁদে


আগামী নিউজ | ভূঁই শাহ প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২১, ০৪:০২ পিএম
পেঁয়াজ কেন কাঁদে

ছবি: আগামী নিউজ

ঢাকাঃ পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর বরফ মালকিনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ফ্রিজ থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন ছিল স্নিগ্ধ রোদ। বাইরের আবহাওয়া ছিল খুবই চমৎকার। ফুরফুরে হাওয়া বইছে। তিন বন্ধুই খুব খুশি। ফ্রিজের ঠান্ডা আবহাওয়া আর অন্ধকারের মধ্যে থাকতে থাকতে তাদের জীবন একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। আর বাইরের দুনিয়াটা কী সুন্দর, ঝলমলে! তারা হাঁটছে-ফিরছে, দৌড়াচ্ছে। 

আহা কী আনন্দ আকাশে-বাতাসে! কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বাঁধল বিপত্তি! দেখা গেল, বরফ কাউকে কোনোকিছু না বলে গলতে শুরু করল! পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা কোনোকিছু বুঝে উঠার আগেই বরফ বাতাসে গলে জল হয়ে গেল! পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কার সেকি কান্না। তাদের এতদিনের বন্ধু বরফ এইভাবে না বলে চলে গেল! বরফকে হারানোর বেদনা দুই বন্ধু কিছুতেই ভুলতে পারে না। সারাদিন তারা মনমরা হয়ে পড়ে থাকে। তাদের কিছুই ভাল লাগে না। বন্ধু বরফের জন্য তাদের হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে গেছে! বরফের মৃত্যুর শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আবার বিপদ এসে হাজির হলো পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কার সামনে।

বলে না, বিপদ যখন আসে সবদিক থেকে আসে! একদিন বিকেলবেলায় দুই বন্ধু মিলে রমনা লেকের পাড় ধরে হাওয়া খাচ্ছিল। হঠাৎ করেই দুজন একসঙ্গে পানিতে পড়ে গেল। পেঁয়াজ তো পড়েই টুপ করে ডুবে গেল। কিন্তু কাঁচালঙ্কার মাথাটা মানে ডাঁটাটা পানির উপরে ভেসে রইল। কিছুক্ষণ পর সেখানে এক পেঁয়াজু বিক্রেতা তাঁর পেঁয়াজ আর অন্যান্য বাসনকোসন ধুয়ে নিতে আসেন। তিনি তার জিনিসের সঙ্গে সেই কাঁচালঙ্কাকেও নিজের দোকানে নিয়ে গেলেন। তারপর ভাল করে বেসনের সঙ্গে মিশিয়ে গরম তেলে ভেজে খরিদ্দারের প্লেটে তুলে দিলেন। খরিদ্দার বেশ আয়েশ করে সেই কাঁচালঙ্কার ইহজীবন সাঙ্গ করে দিলেন! পেঁয়াজ একা, জলের নীচে। বরফের মৃত্যু না হয় মেনে নেয়া গিয়েছিল। পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা দুই বন্ধু মিলে গলা ধরাধরি করে বন্ধু বরফের জন্য কেঁদেছে! কিন্তু কাঁচালঙ্কার মৃত্যুর শোক বইবার ক্ষমতা যেন আর পেঁয়াজের নেই। 

বন্ধুর শোকে অনবরত কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল তো শুকিয়েই যেত, যদি না সে জলের মধ্যেই বাস করত। কী দরকার ছিল- ফ্রিজ থেকে বের হয়ে আসার! তিন বন্ধু মিলে তো ফ্রিজে বেশ ভালই ছিল। কোন অলুক্ষণে যে ধরেছিল আর তাদের বাইরে বেরিয়ে আসার সাধ জেগে উঠেছিল! এখন বোঝ, দুনিয়াটা কেমন! দুনিয়া মানেই পদে পদে মৃত্যু, এটা পেঁয়াজ খুব ভাল করেই টের পাচ্ছে এখন। পেঁয়াজ বন্ধুর জন্য শুধু কেঁদেই চলেছে। সেই কান্না শুনে একদিন দয়াপরবশ হয়ে তার সামনে এক ঋষি এসে হাজির। ঋষি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, তুমি কাঁদছো কেন?’ পেঁয়াজ বলল, ‘দেখুন ঋষি, আমরা তিন বন্ধু মিলে বেরিয়ে ছিলাম। 

যখন বরফ মারা গেল তার জন্য আমি আর কাঁচালঙ্কা দুজনে মিলে কেঁদেছিলাম। এখন কাঁচালঙ্কা মারা গেছে, আমি একা তার জন্য কাঁদছি। কিন্তু আমি মরে গেলে আমার জন্য কে কাঁদবে।’ ঋষি বললেন, ‘খুবই কঠিন প্রশ্ন রে। এর উত্তর যে কী হবে সেটা তো আমি বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমি তোকে একটা বর দিতে পারি। বল তুই কী চাস? তুই কি অমরত্ব চাস?’ পেঁয়াজ বলল, ‘না ঋষি, আমি অমরত্ব চাই না। আমি শুধু চাই, আমি মরার সময় কেউ যেন আমার জন্য কাঁদে।’ ঋষি বললেন, ‘ঠিক আছে, এখন থেকে যে-ই তোকে মারতে আসুক, সেই তোর জন্য চোখের জল ফেলবে, কাঁদবে।’ এরপরই ঋষি উধাও হয়ে গেলেন। আর তারপর থেকেই পেঁয়াজ কাটতে গেলে মানুষ পেঁয়াজের জন্য অশ্রু বিসর্জন দেয়। আমরা, মানে বাঙালিরা- খুবই আবেগপ্রবণ জাতি, কঠিন বন্ধুবৎসল; পেঁয়াজের জন্য আমাদের চেয়ে বেশি শোক আর কেউ করতে পারবে না।

কথায় বলে, মরা ভাদ্রে পেঁয়াজ গতিশীল। কারণ, সেই সময়ে পেঁয়াজের আবাদ কম। বাজার অর্থনীতির নিয়ম, যোগান কম হলে কী কী যেন বাড়ে! যে দেশ থেকে পেঁয়াজ আসে তারা নানান খেলাধুলা করে! মরা ভাদ্র থেকে পেঁয়াজ নিয়ে চার মাস ধরে আমাদের কান্নাকাটি আমরা বিশ্ববাসীকে জানাতে পেরেছি। সেই যে ভারতচন্দ্র বলেছিলেন, ‘কান্দি কহে ঘেসেড়ানী হায়রে গোঁসাই/এমন বিপাকে আর কভু ঠেকি নাই।’ আমরা পৃথিবীতে সবজি উৎপাদনে তৃতীয় হলেও, পেঁয়াজের জন্য শোকের বোঝা বইতে বইতে পৃথিবীতে প্রথম স্থান অধিকার করবো। এই শিরোপার ধারকাছে আমরা আর কাউকে ভিড়তে দেবো না। পেঁয়াজের কেজি ২০ টাকা থেকে এক লাফে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকালেও আমাদের কিছু যায় আসে না। (আমরা, মানে জনতা, মানে সরকার। সরকারেরও কিছু যায় আসে না!) টাকা দিয়ে কোনো অবস্থাতেই আমাদের কান্নার বাঁধ থামানো যাবে না, দমানো যাবে না! প্রয়োজনে কাঁদতে কাঁদতে আমরা এক নদী যমুনা করে ফেলবো; তবু ‘পেঁয়াজ-শোক-শিরোপা’ আমরা অর্জন করবোই, করবো! আমরা একা না! ভারত আমাদের সঙ্গে থাকবে- এটা আমাদের ‘ভাবাবেগের মধ্যে’ একটা বিরাট শক্তির দিক! পেঁয়াজের দাম যে এভাবে বেড়েছে, এতে মানুষের একটু কষ্ট হয়েছে। 

যদি তারা পেঁয়াজ না খেতো তাহলে তাদের এতো কষ্ট করতে হতো না। রাষ্ট্রের কত বড় বড় মানুষ পেঁয়াজ না খেয়ে থেকেছে! এতে কি তাদের ঝাঁজ কমে গেছে? আসলে এই দামের ফলে কিছু ভাল দিকও বিশ্বের কাছে তুলে ধরা গেছে। আমরা উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাচ্ছি। পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা, এটা কোনোভাবেই ‘গরিবি’ কোনো লক্ষণ না। এটা উন্নয়নের প্রতীক। আগামীতে বিশ্ব গণিত অলিম্পিয়াডে যদি প্রশ্ন আসে, এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৩০০ টাকা হলে, একটা পেঁয়াজের ঝাঁজ কত? এই জটিল অংকের উত্তর শুধু আমাদের ছেলেরাই দিতে পারবে! বিসিএসে মনে হয় এমন প্রশ্ন আসবে না। আবার বলা যায় না, আসতেও পারে। তখন হয়তো প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়ে আসবে, এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৩০০ টাকা হলে, বাংলাদেশের উন্নয়নের তোলা কত ডলার করে! পেঁয়াজের দাম তো বাড়বেই। পেঁয়াজ তো লুঙ্গিপরা পা ফাটা-দাদওয়ালা টাইপের কেউ না। সেই যে ছোটবেলায় শোলক ধরতেন না- ‘বাজার থেকে সাহেব এলেন কোট-প্যান্ট পরে/ কোট-প্যান্ট খুলতে গেলে চোখ জ্বালা করে।’ পেঁয়াজ হচ্ছে, কোট-প্যান্ট পরা ভদ্রলোক। তার তো একটা মর্যাদা আছে! মর্যাদার সঙ্গে বাঁচার অধিকার জগতের সকল প্রাণের আছে। এই তো একজন তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম এখন ২০০ টাকা। বর্তমানে আমার বাসায় দুই কেজি সমপরিমাণ পেঁয়াজ রয়েছে। ভাবছি সেগুলো রান্নাঘরে না রেখে আলমারিতে তালা দিয়ে রাখবো।

কারণ পেঁয়াজের খোঁজে যদি আবার চোর-ডাকাত বাসায় চলে আসে!’ সরকার খুবই দায়িত্বশীল আচরণ করেছে, এই জন্যেই বলেছে, পেঁয়াজ না খেলে কী হয়? পেঁয়াজ না খেলে তো বাসায় পেঁয়াজ আনতে হবে না। তখন এই মহামূল্যমান পেঁয়াজের লোভে চোর-ডাকাতও আসবে না! নাগরিকদের নিরাপত্তার দিক থেকে চিন্তা করলে সরকারের এই আহ্বান খুবই মুখরক্ষাদায়ক। কিন্তু সাধারণ মানুষের তো সেটা বোঝার ক্ষমতা নেই। তারা মনে করে, পেঁয়াজের দাম বাড়ানোর পেছনে অতি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের কারসাজি রয়েছে। এর পেছনে সরকারি দলের লোকজনের হাত রয়েছে। বন্ধুরাষ্ট্রের ‘পলিটিকস’ আছে। এই তো সেদিন এক নেতা এক সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন, কেন আমাদের কম পেঁয়াজ খাওয়া উচিত।

কেন আমাদের রান্নাতে পেঁয়াজের ক্ষেত্রে ‘অর্ধেকটা হলেই ভাল হয়, একটাই বেশি নয়’ নীতি বাস্তবায়ন হওয়া উচিত। বেশি পেঁয়াজ খেলে যে ইন্দ্রিয়ের ক্ষতি হতে পারে- সেটাও তিনি বুঝিয়ে বললেন। তিনি মানুষকে বেশি করে পেঁয়াজ না খেতে উৎসাহিত করলেন। বললেন, পেঁয়াজ একটা অপ্রয়োজনীয় সবজি। খুব শিগগিরই এর দাম কমে আসবে। পেঁয়াজ নিয়ে যদি কেউ আর কোনোদিন কারসাজি করার চেষ্টা করে তাহলে তাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। সে আমাদের দলের হলেও ছাড় নেই! (কী হুঁশিয়ারি, শুনলে তো যে কারো আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে পালাবে! তবু লোকে বলবে, সরকার মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের, মজুতদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না! আচ্ছা, আর কতোটা কঠোর হতে পারে সরকার!) সেই সংবাদ সম্মেলনে পেঁয়াজ নিজেও উপস্থিত ছিল। নেতার কথা শুনে সে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। সবাই তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞস করল, ‘কী হয়েছে, পেঁয়াজ তুমি কাঁদছো কেন।’ সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি একটু আগে সালমান শাহর ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবি দেখে এসেছি। এতে আমার ধারণা হয়েছে, পৃথিবীতে সবকিছুর মৃত্যু হলেও সত্যের কখনো মৃত্যু হয় না। সত্য অমর। 

কিন্তু নেতার কথা শুনে মনে হচ্ছে, সত্যও মারা গেছে। এ কারণে সত্যের জন্য কাঁদতাছি, শোক করতাছি। সারাজীবন আমিই মানুষকে কাঁদায় আসছি। এখন নেতার কথা শুনে আমারই কান্না আসতাছে। হাউমাউ কইরা কান্না আসতাছে!! দুই মাস আগেও ঢাকার বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা কেজিতে। সেই দাম বেড়ে প্রথমে একশো ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে আড়াইশো টাকা কেজি দরে। বাংলাদেশে এর আগেও পেঁয়াজ শেষের মৌসুমে পেঁয়াজের দাম একশো পার হলেও, কখনোই দুইশো টাকার ঘর অতিক্রম করেনি। 

এর মধ্যেই পেঁয়াজ ছাড়া রান্না এবং পেঁয়াজ কেনা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। অনেকেই লিখেছেন, তারা এখন পেঁয়াজ ছাড়া রান্না করতে শুরু করেছেন। বিপ্লব হান্নান একটি ছবি প্রকাশ করেছেন, রান্নায় এক পেঁয়াজের বেশি নয়, অর্ধেক হলে ভালো হয়! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেষ হাসিনার বাসভবনে পেঁয়াজ ছাড়া রান্না হয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা। গোলাম সামদানি লিখেছেন, দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে বিভিন্ন দেশ থেকে বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশের সরকার। 

লেখক: সাংবাদিক, কালামিষ্ট

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে