Dr. Neem on Daraz
Victory Day

নিরাপদ খাদ্য কীটনাশকের বিষাক্ত চাদরে ঢাকা, দেখার কেউ নেই


আগামী নিউজ | রিপন আশরাফ  প্রকাশিত: জুন ৬, ২০২০, ১১:৩২ এএম
নিরাপদ খাদ্য কীটনাশকের বিষাক্ত চাদরে ঢাকা, দেখার কেউ নেই

রিপন আশরাফ

প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংস করে এবং মানুষের চলমান জীবন বিপন্ন করে উন্নয়ন মডেল তৈরি করা অসম্ভব। জীবনমান উন্নয়নে যখন কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হয় তার আগে পরিবেশগত বিপর্যের সমীক্ষা ও সম্ভবনা বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হয়। যাতে করে চলমান কিংবা ভবিষ্যত উন্নয়ের নামে গৃহীত কর্মকাণ্ড যেন কোনো ভাবেই পরিবেশ ও জনগণের ক্ষতি সাধন না হয়। 

উন্নয়ন কার জন্য? নিশ্চয়ই বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য। সেই প্রজন্মই যদি পরিবেশ বিপর্যায়ের শিকার হয়ে বসবাসের পরিবেশের অযোগ্যতার মধ্যে নিপাতিত হয়, তাহলে সে উন্নয়নধারা দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার সময়ের ব্যবধানে বঞ্চিত। দেশের কৃষিব্যবস্থায় এক ধরনের নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে। যেন তেন প্রকারে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে বিদেশী কোম্পানির হাইব্রিড ও জিএমও বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি ব্যবস্থা এবং কৃষকদের বিদেশী এগ্রো-কেমিক্যাল কোম্পারির হাতে জিম্মি করে ফেলা হয়েছে, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণ ও বাছ-বিচারহীনভাবে রাসায়নিক সার, পেস্টিসাইড, ফাঙ্গিসাইড, হার্বিসাইড তথা বিষ ব্যবহারের মাধ্যমে মাটি, পানি, বাতাস, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য ও জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। 

বিশ্ব এখন ক্রমবর্ধমান যখন রোগ-বালাই ও জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন নতুন ঝুঁকিতে। দেশে দেশে কৃষিজমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং পরিবেশ দূষণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে ধরিত্রীকে আগামী শতকের বাসযোগ্য রাখতে অর্গানিক ফার্মিং, বিকল্প পরিবেশ বান্ধব বালাইনাশক ব্যবহার, জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার ও রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে উঠেছে, তখন বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে রাসায়নিক কীটনাশকের নিরাপদ সীমার অতি উপরে উচ্চ ব্যবহারে। 

পরিবেশ ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বহু আগেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে,  Syngenta , ACI , Corp Care সহ অনেক বিদেশী কোম্পানির এমন অনেক কীটনাশক আছে যেগুলি অনৈতিক অশোভন ভাবে তীব্র প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের বাজার দখল করেছে। এ কাজে শোনা যায় কৃষিবিদ অ্যাসোসিয়েশনের কিছু নেতাকে এবং খামারবাড়ি হতে শুরু করে জেলা লেভেলের উপ-পরিচালক লেভেলে স্পীড মানি দিয়ে তারা ম্যানেজ করে তাদের প্রাণ প্রকৃতি বিনাশী কীটনাশকের বহাল তবিয়তে মার্কেটিং করে যাচ্ছে বিগত ১৫ বছর ধরে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যবহারের আগে বা পরের পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা মূল্যায়ন ছাড়াই বর্তমানে বাংলাদেশে ৪,২০০’র বেশি ব্রান্ডের নানাজাতের কীটনাশক আমদানী ও ব্যবহার হচ্ছে। কৃষিখাতে ব্যবহৃত কীটনাশক আমদানী ও ব্যবহারের অনুমোদনের পূর্বে কৃষি বিভাগ, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংস্থার তরফ থেকে এমআরএল (মেক্সিমাম রেসিডিউ লিমিট) টেস্টিং বা পরিবেশের উপর ইম্প্যাক্ট এসেসমেন্ট একটি অনিবার্য বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া। কিন্তু এখানে হাজার হাজার ব্রান্ডের কীটনাশক ও রাসায়নিক কৃষি উপকরণ আমদানী ও ব্যবহার হচ্ছে কোন রকম এমআরএল টেস্ট ছাড়াই।  

তথ্য অনুসারে, দেশে প্রায় সাড়ে ৫৫০ এর অধিক কীটনাশক ব্রান্ডের নিবন্ধন রয়েছে, যেগুলোকে জনস্বাস্থ্য বান্ধব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু কোন প্রকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই আমদানী ও ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের প্লান্ট প্রটেকশন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, এমন ঝুঁকিপূর্ণ কৃষি উপকরণ বা কৃষিতে ব্যাপক হারে ব্যবহৃত কীটনাশক ওষুধগুলো ছাড়পত্র দেয়ার আগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার কোন রকম ল্যাবরেটরি সুবিধা বা ব্যবস্থা তাদের নেই। এমনকি কীটনাশক ব্যবহারের সময় এবং ফসল তোলার পর মাঠ পর্যায়ে এবং পরবর্তী সময়ে ভোক্তা পর্যায়ে মনিটরিং ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও বাংলাদেশে কোন পর্যায়েই কীটনাশক ও রাসায়নিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে টেস্টিং ও তদারকির ব্যবস্থা কোন সংস্থার হাতেই নেই। 

বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ ইতিমধ্যেই নানা রকম স্বাস্থ্য জটিলতার শিকার হয়ে পড়েছে। পানি দূষণ, বায়ু দূষণ, মাটি দূষণের ফলে আমাদের খাদ্যচক্রে মারাত্মক বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া দেশে খাদ্য নিরাপত্তা আইন বলবৎ বা কার্যকর না থাকা এবং নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও দফতরের প্রয়োজনীয় তদারকি না থাকায় প্রিজারভেটিভের নামে, এডিটিভের নামে, ফরমালিনসহ নানা রকম রাসায়নিক উপাদানের লেবেলে প্রতিটি খাদ্যপণ্যে মিশ্রিত হচ্ছে বিষ। এর ফলে কোটি মানুষ কিডনি সমস্যা, নানা ধরনের ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, পরিপাকতন্ত্রের নানা জটিলতার শিকার হচ্ছে। কীটনাশক আকারে অপরীক্ষিত উচ্চমাত্রার রাসায়নিক বিষ ফসলি জমিতে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে অল্পদিনের মধ্যে মাটির উর্বরতা যেমন নষ্ট হচ্ছে একইভাবে হাজার হাজার টন কীটনাশক দ্রব্য বৃষ্টি ও বর্ষার পানির সাথে মিশে দেশের নদ-নদী ও জলাশয়ের পানির সর্বনাশ করে ফেলছে। যার প্রভাবে ইতিমধ্যেই অনেক প্রকার দেশীয় মাছ  এবং পোকামাকড়ের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। 

জনস্বাস্থ্য, জীব-বৈচিত্র্য ও পরিবেশগত প্রভাব ও নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য করে শুধুমাত্র কীটনাশক প্রস্তুতকারক ও বাজারজাতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর দেয়া তথ্যাবলীর উপর নির্ভর করে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল অবাধে কীটনাশক আমদানী, বিপণন ও ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে যা আমাদের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত ও অপরীক্ষিত কীটনাশক ওষুধের সাথে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ডিডিটি বাংলাদেশের কৃষকরা এখনো ব্যবহার করছে কিনা তাও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছেনা সরকারি মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকা বা সমীক্ষা না হওয়াতে। মারাত্মক পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে বিশ্বের দেড় শতাধিক রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক কনভেনশনের মাধ্যমে ডিডিটি নিষিদ্ধ ও এর ব্যবহার রোধের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। 

অন্যদিকে, বাংলাদেশের কৃষিতে যথেচ্ছ কীটনাশক ব্যবহার এবং তার প্রতিক্রিয়া কখনো কখনো আন্তর্জাতিক গবেষণার বিষয় হয়ে উঠেছে। প্রায় একদশক আগে বিশ্বব্যাংকের পরিচালিত এক গবেষণাপত্রে বাংলাদেশকে পেস্টিসাইড হটস্পট হিসেবে তুলে ধরা হয়েছিল। দেশের কৃষি, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে অনিয়ন্ত্রিতভাবে কীটনাশক আমদানী ও ব্যবহার জরুরি উদ্যোগ নিয়ে বন্ধ করতে হবে। জীবন-প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংস করে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব এই কথার মূল্য আর কত চরম ক্ষতির মূল্যে আমাদের বুঝতে হবে।

লেখক: রিপন আশরাফ 
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক  

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে