Dr. Neem on Daraz
Victory Day

অনেক গল্পের ভিড়ে আর একটি গল্প


আগামী নিউজ | ড. শেখ মহঃ রেজাউল ইসলাম প্রকাশিত: এপ্রিল ২৬, ২০২০, ১১:১১ পিএম
অনেক গল্পের ভিড়ে আর একটি গল্প

মাঝে ফিজা ডানপাশে লামিয়া,বামপাশে ওদের মামা

ফিজা আর লামিয়া দুই বোন।কোন ভাই নাই তাদের।পড়তো ঢাকার মনিপুর স্কুলে।বাবা ব্যবসায়ী।অত্যন্ত সুখের জীবন ছিল তাদের।ঢাকায় থেকে একটা ভাল স্কুলে পড়ালেখা করা আর স্বাচ্ছন্দে বেড়ে ওঠা। লামিয়া বড় আর ফিজা ছোট। লামিয়া ক্লাস এইট এবং ফিজা ক্লাস সেভেন এ পড়তো।ওরা দুই বোন আর বাবা মা মোট চার জনের সুখের সংসার।থাকতো ঢাকার মিরপুর এলাকায়।
অত্যন্ত স্বছল ও সুখের পরিবার ওদের। ঢাকার মত একটা শহরে খুব ভালোভাবে চলছিলো ওদের জীবন। চোখে ছিল আকাশচুম্বী স্বপ্ন, ওরা লেখাপড়া করে বড় হবে, ভালো চাকুরী করবে।দুই বোনই খুব মেধাবী ছাত্রী ছিল।
কিন্তু ওদের সুখের সংসারে আচমকা ঝড়ো হাওয়া সবকিছু ভেঙে চুড়মাড় করে দিল একদিন।
ঘটনাটা ২০১৩ সালের প্রথম দিকের।ফিজা আর লামিয়াকে বাসায় রেখে ওদের বাবা মা একদিন মটর সাইকেলে ওদের খালাত বোনের বিয়ে খেতে যাচ্ছিল।পথে একটি বেপরোয়া ট্রাক ওর বাবা মাকে চাপা দেয়।ঘটনাস্থলেই ওর বাবা মা মারা যান।আচমকা ঝর ওদের সব স্বপ্ন মুহূর্তের মধ্যে ভেংগে চুড়মাড় করে দিল।এক সাথে বাবা মাকে হারিয়ে ওই মেয়ে দুটো পাগল প্রায়,পায়ের নিচে মাটি নাই।কি করবে? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?ঢাকায় আর পড়ালেখা করা সম্ভব হল না। ওই রাতেই বাবা মায়ের লাশের সাথেই মেয়ে দুটো রওনা হলো ওদের গ্রামের বাড়ি নড়াইলে। সাথে শুধু ওদের খালু। একবার ভাবুনতো ঢাকায় বসবাস করা সুন্দর একটা সংসার।সবকিছু চলছিলো সুন্দর ভাবে।একই লাশবাহী ভ্যানে বাবা মায়ের লাশ,সাথে দুটি এতিম বাচ্চা,যাচ্ছে নড়াইলে।একদিকে বাবা মা হারানোর কষ্ট, আরেক দিকে আর্থিক অনটন।অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। ছাড়তে হল ঢাকা,পরাজয় মানতে হল বাস্তবতার কাছে। গিয়ে উঠলো বাবা মার ভিটে নড়াইলে।কি খাবে?কি পরবে?কিভাবে পড়ালেখা করবে?বিপদের দিনে কেউ পাশে থাকতে চায় না, এটাই বাস্তবতা। আর পাশে থাকা মানুষের সংখ্যা খুবই কম।

এই অবস্থায় পাশে এসে দাঁড়ালেন ওদের খালু আবুল কালাম আজাদ।উনিও ঢাকায় সামান্য একটা বেতনের চাকরি করেন।তিনিই বা কতটুকু করতে পারবেন? নড়াইলে বাবা মা ছাড়া এতিম মেয়ে দুটোর খেয়ে না খেয়ে দিন চলছিলো। বাবা মায়ের মৃত্যুর পর পড়াশোনা ও ঠিকমতো চলছিলো না।ভতি' হয়েছিল গ্রামের একটা স্কুলে।

এরই মধ্যে পুরনো কাগজপত্র ঘেঁটে ওদের খালু দেখলেন ওদের আব্বা একটা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে (নাম বলতে চাচ্ছি না) বিমা পলিসি খুলেছিলেন।আর তখনই ইন্স্যুরেন্স এর দাবির টাকা পাওয়ার জন্য চেস্টা করতে লাগলেন।কিন্তু সমস্যা----অনেক সমস্যা!!!!। কি আর করা? বীমা কোম্পানীটি নানান ওজুহাতে ওদের বাবার বীমার টাকা ফেরত দিতে চাচ্ছিলো না। সময় মত দরখাস্ত করে নাই,এ কাগজ নাই ও কাগজ নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে বলে রাখি,এ ধরনের কান্ডজ্ঞানহীন ইন্সুরেন্স কোম্পানির সংখ্যা খুবই কম। যাইহোক কোন কাজ হয় নাই। ওদের খালুও ছেড়ে দেবার পাত্র নয়।তারপর কোটে মামলা।পাল্টাপাল্টি মামলা।যুক্তিতর্ক! এভাবে চললো ৪/৫ বছর।
কিন্তু লামিয়া আর ফিজার অবস্থাতো শেষ!অবশেষে দরখাস্ত আসলো আমাদের কাছে মানে বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রন কতৃ'পক্ষের Insurance Development and Regulatory Authority ( IDRA) কাছে। অর্থ মন্ত্রনালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠানটি অত্যন্ত শক্তিশালী।এই প্রতিষ্ঠানের বীমা সংক্রান্ত অভিযোগ আমি দেখভাল করি।সারা বাংলাদেশের যত অভিযোগ আমার টেবিলে আসে।আমাদের একটা শক্তিশালী টীম কাজ করছে এ ব্যাপারে। আমাদের কাছে অভিযোগ করলে আমরা উভয় পক্ষকে শুনানির জন্য ডাকি।

যথারীতি সেদিন ছিল লামিয়া আর ফিজার বাবার ইন্সুরেন্স সংক্রান্ত অভিযোগের শুনানির দিন। এবং সেটা ছিল প্রথম শুনানির দিন।
সকালে অফিসে এসে লামিয়া ফিজাদের অভিযোগ সংক্রান্ত ফাইলটি বেশ স্টাডি করলাম।আমি খুব আশ্চর্য হলাম এই টাকাগুলো না পাওয়ার কোন কারনই নাই।যাইহোক সেই অভিযোগের শুনানির জন্য বসেছি।শুনানিতে আমাদের টীমের সামনে উপস্থিত ছিলেন ইন্সুরেন্স কোম্পানিটির এমডি সাহেব অন্যান্য অফিসারসহ,ফিজা,লামিয়া আর ওদের খালু।
আমি বললাম কি হয়েছে মা বলতো?এমন কথা শুনেই খুশিতেই মনে হয় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ছোট বোন ফিজা।আমিও কেঁদে ফেলেছিলাম, একথা স্বীকার করতেই হচ্ছে।আমিতো কারো কষ্ট সহ্য করতে পারি না ভাই কি করব?এই কাহিনী শুনে কেন কান্না আসবে না?? বড় বোন লামিয়া চুপচাপ । ছোট বোন ফিজা বর্ণনা করলো ওদের করুন কাহিনী। ইন্সুরেন্স কোম্পানির এমডি সাহেবকে বললাম, এই ধরনের গাফিলতি কেন করা হলো? যার জন্য এই এতিম মেয়ে দুটো আজ ৪/৫ টা বছর পথে পথে ঘুরছে!যাইহোক আমার কথায় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীটিও বেশ উদারতার পরিচয় দিলেন।সুরাহা হলো ৪/৫ বছরের একটা সমস্যা। পেয়ে গেল ওদের দাবির টাকা। অনেকগুলো টাকা। রায়ের পর ইন্স্যুরেন্স এর অফিসার এবং ওদেরকে এক জায়গায় করে বলে দিলাম ব্যাংক একাউন্ট করে দুইবোনের যুক্ত নামে টাকাগুলো দিতে। পরম তৃপ্তির হাসি দুবোনের মুখে। আমরাও আনন্দিত। খুশি হলাম খুব খুশি।কিন্তু ওদের জীবনের একটা বিশেষ সময় নষ্ট হয়ে গেল।ফিরে কি পাবে সেসব দিনগুলো? টাকা পাওয়াটা বড় কিছু না।কিন্তু বাবা মা হারানো মেয়ে দুটোর কি ভবিষ্যৎ?? ওদের একটু পাশে দাঁড়াতে পারাটাই আমার তৃপ্তি।হাসিখুশী পরিবারটিতে হঠাৎ ঝর এসে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিল।টাকাগুলো হয়তো ওদের সামান্য কাজে লাগতে পারে।কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল ওদের জীবনে! একটা মানুষের জীবনে যখন তখন যেকোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে এ বিষয়টা সবাই মনে রাখলে আমরা সমাজে কেউ নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠতাম না,সম্পদের পাহাড় গড়ার অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতাম না।আমি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিককেও দেখেছি কিছু খেতে পারে না। অসহ্য! সব কিছু অসহ্য! কিচ্ছু ভাল লাগে না! তাহলে কেন এতো বাহুশক্তি প্রদর্শন? কেন এতো ক্ষমতার বড়াই?লামিয়া আর ফিজার গল্পের মত হাজার হাজার গল্প আমাদের সমাজে আছে। আমি ওদের পাশে দাঁড়াতে চাই।আসুন আমরা সবাই এইসব অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কতৃ'পক্ষ (IDRA) এই ধরনের কাজই করে থাকে। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির প্রতি মানুষের আস্থা দিনদিন বাড়ছে।এর দিকে সবাই আসুক আমরা এটা চাই।ইন্সুরেন্স কোম্পানীগুলোর দায়িত্ব সবার ভিতর একটা পজিটিভ ধারণা আনার চেষ্টা করা। অনেকটা সফলও তারা।দেশের জিডিপিতে কম ভুমিকা রাখলেও দিন দিন এটা বাড়ছে। বর্তমান সরকারের আমলে ২০১১ সালে IDRA এর যাত্রা শুরু। এ পয'ন্ত কয়েক হাজার কোটি টাকা IDRA এর মাধ্যমে বিমা দাবি পরিশোধ করা হয়েছে। বিমাখাতে সরকারের এক বিরাট সাফল্য এটি।

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে