Dr. Neem on Daraz
Victory Day

নকল ও ভেজালে ছেয়ে গেছে পুরো দেশ: উৎপাদক ও বিক্রেতা উভয়ই সুবিধাভোগী


আগামী নিউজ | নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশিত: নভেম্বর ২৬, ২০২০, ০৪:৪৫ পিএম
নকল ও ভেজালে ছেয়ে গেছে পুরো দেশ: উৎপাদক ও বিক্রেতা উভয়ই সুবিধাভোগী

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকাঃ ভেজাল ও নকলের মাত্রা বেড়েছে। বিশেষ করে করোনাকালে এর মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ। রাজধানীসহ সারাদেশেই প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল খাদ্যদ্রব্য এবং বাহারি নকল পণ্য। রাজধানীর পুরান ঢাকার অলিগলিতে প্রস্তুতকৃত নকল ও নিম্নমানের হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ডেটল, স্যাভলন, সাবান, মাস্ক, চন্দন, মেছ্তা-দাগ নাশক ক্রিম, নানা প্রসাধনী, তেল, পারফিউম সবকিছুই পাইকারী ও খুচরা বিক্রি হচ্ছে। একই সাথে বিক্রি হচ্ছে নকল চানাচুর, বিস্কুট, গুঁড়োদুধ, চাপাতা, ঘি, দই থেকে শুরু করে পানের জর্দাও। এসব ভেজাল ও নকল সামগ্রীর প্যাকেট বা বোতলে সাঁটানো বিভিন্ন ব্রান্ডের লেবেল।

ফার্মেসীতে নকল ঔষধ রাখায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা। ছবিঃ সংগৃহীত 

বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন’ (বিএসটিআই) এর তদারকি ও ভেজালবিরোধী অভিযান দূর্বল হয়ে পড়ায় দিন দিন ভেজাল ও নকলের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এতে একদিকে জনস্বাস্থ্য যেমন হুমকীর মুখে পড়ছে, তেমনি ক্রেতা বা ভোক্তারা নকল জিনিস কিনে ঠকছেন।

রাজধানীর সবধরণের মার্কেট ও বাজারে এখন নকলের বাহার। গত বছর ভেজাল ও নকলের মাত্রা কিছুটা কমলেও করোনার পর থেকে এর মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষ করে করোনায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অবাধে নকল হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, স্যাভলন, ডেটল, মাস্ক, স্প্রে মেশিন, হ্যান্ড গ্লাভসসহ বিভিন্ন সুরক্ষা পণ্য। একইভাবে করোনার মধ্যে ভেজালবিরোধী অভিযান বন্ধ থাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ভেজাল কারবারীরা। শিশুদের চকলেট ও গুঁড়ো দুধ, ঘি, আটা, তেল, সাবান, মধু, মসলা, দই, মিষ্টি থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী, নিত্য ব্যহারের কসমেটিকস, এনার্জি সেভিং বাল্ব, মোবাইল ফোন, টিভি, ফ্রিজসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী, গাড়ি ও কম্পিউটারের পার্টস সবই নকল হচ্ছে। নকল সামগ্রী মানেই কোনো ব্রান্ডেড কোম্পানীর সামগ্রী হুবুহু প্যাকেট করে বাজারজাত করা। চোখ ধাঁধানো নকল সামগ্রীর ঝকমকে প্যাকেটের সামনে আসল পণ্য পাত্তায় পায় না। হাইটেক সামগ্রীসহ সবধরনের নকল পণ্য রাজধানীর ফুটপাতেও পাওয়া যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে জীবন রক্ষাকারী ঔষধও। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে নকল কারখানায় তৈরি ওরস্যালাইনে হাটবাজার, ফার্মেসী সয়লাব।

রাজধানীতে নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার জব্দ। ছবিঃ ডিএমপি নিউজ 

বিশেষজ্ঞদের মতে, নকলের প্রবণতা বন্ধ করতে হলে আইনের সঠিক প্রয়োগসহ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার। ভোক্তারা যদি সচেতন হয়ে সংঘবদ্ধভাবে নকল পণ্য বা ভেজাল খাদ্যকে বর্জন করে তাহলে এর দাপট আর থাকবে না। যারা অধিক মুনাফার আশায় এগুলো তৈরী করছে তারা নিরাশ হতে হতে একদিন এই ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।

রাজধানীর মহাখালীতে বসবাসকরা করা একজন শিল্পপতি একটি  অভিজাত বিপনিবিতান থেকে সেভিং রেজার ক্রয় করেছে ‘জিলেট’ এর যথাযথ দামও পরিশোধ করেছেন। বাসায় এসে যখন তিনি তা ব্যবহার করবেন তখন দেখছেন মোড়কে লেখা ‘জিলেটি’। মোড়ক দেখে বোঝার উপায় নেই এটা নকল। প্রথম শ্রেণির নাগরিক হয়েও এরা নকল কারবারীদের হাতে প্রতিনিয়ত এভাবেই প্রতারিত হচ্ছেন।

বামে নকল শেভিং রেজার জিলেটি, ডানে আসল জিলেট
বামে নকল শেভিং রেজার জিলেটি, ডানে আসল জিলেট। ছবিঃ আগামী নিউজ 

জানা গেছে, একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ীরা জেনে শুনেই অতি লাভের আশায় নকল পণ্য বিক্রি করেন। প্রতারিত হন ব্যবহারকারী বা ক্রেতারা। থাইল্যান্ডের বিখ্যাত হেড অ্যান্ড শোল্ডার, যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্যান্টিন প্রো-ভি শ্যাম্পু ও ডাভ ক্রিম বা ভারতের গার্নিয়ার শ্যাম্পুসহ বিভিন্ন ব্রান্ডের ক্রিম, লিপস্টিক, লোশন দেদারছে বিক্রি হচ্ছে রাজধানীর চকবাজার ও মৌলভীবাজারে। সেখানকার শতাধিক পাইকারি দোকানে এসব পণ্য মূল দামের অর্ধেক দামে বিক্রি হয়। তবে এগুলো সবই নকল। পণ্যের প্যাকেট বা বোতল ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করেও আসল-নকল বোঝারও উপায় থাকে না। ভুক্তভোগীদের মতে, বিএসটিআই-এর নির্লিপ্ততাই নকল সামগ্রীর দাপটের জন্য দায়ী। শিল্প মন্ত্রালয়ের অধীন সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই বিভাগটি যুগ যুগ ধরে জনবল সংকটের দোহাই দিয়ে দায় এড়িয়ে চলছে। ভুক্তভোগীরা মনে করেন, বিএসটিআই’র অভিযান অব্যাহত থাকলে নকল পণ্যের দাপট কমতে বাধ্য।

এদিকে, দেশে খাদ্যদ্রব্য, বিভিন্ন পণ্যে সেবা ও ভেজালের মাত্রা বাড়লেও জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) তদারকি কার্যক্রম দিন দিন দুর্বল হচ্ছে। বিগত চার বছর তিন মাসে বিএসটিআই পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের সংখ্যা, জরিমানার পরিমাণ ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বিবেচনায় নিলে এই চিত্র ফুটে ওঠে।

পরিসংখ্যান বলছে, বিগত চার বছর তিন মাসে জরিমানাকৃত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও কমেছে ৮১ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মোট এক হাজার ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কমে হয় ৮৯৮টি, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে কমে হয় ৩৯৮টি, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কমে হয় ৩৭৪টি ও চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জরিমানাকৃত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১১৩টি। তবে বিগত চার বছর তিন মাসে বিএসটিআই খাদ্যদ্রব্য ও বিভিন্ন পণ্যে ভেজাল ও মানহীন শনাক্ত হওয়ায় ১৯৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। এ সময় ৯৮টি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে।

আশুলিয়ায় বিএসটিআই এর অভিযানে ২০ লাখ টাকার নকল টাইগার-স্পীড জব্দ। ছবিঃ সংগৃহীত

বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বিএসটিআই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে ৭৮১টি, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে কমে দাঁড়ায় ৬৪৫টি, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে আরও কমে হয় ৩৪৬টি, তবে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে সামান্য বেড়ে ৪২৪টি হলেও চলতি অর্থ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১৮টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালিত হয়। বিগত পাঁচ বছরে মামলা দায়েরের সংখ্যাও কয়েকগুণ কমেছে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে মামলা হয়েছে এক হাজার ৬২টি, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ৯১০টি, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৩৯৫টি, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ৩৭০টি ও চলতি অর্থ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১৮টি। বিএসটিআইয়ের অভিযানে দেখা গেছে, অনুমোদনবিহীন পণ্য উৎপাদন করায় বেশিসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা ও জরিমানা হয়েছে।

বিএসটিআইয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিগত চার বছর তিন মাসে জরিমানার পরিমাণও কমে এসেছে। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে জরিমানা করা হয়েছে প্রায় চার কোটি ৯৮ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে চার কোটি ৮৩ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা কমে হয় প্রায় চার কোটি তিন লাখ টাকা, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কমে হয় দুই কোটি ৯৪ লাখ টাকা এবং চলতি অর্থ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক কোটি প্রায় ১৮ লাখ টাকা।

‘জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন’ (বিএসটিআই)। 

বিশেষজ্ঞদের মত, এসব নকল কারবারীদের দৌরাত্ম্য থামানো না গেলে আগামী কয়েক বছরে নকল এবং আসল পণ্য কোনটি তা বের করা প্রশাসনের জন্যই কঠিন হয়ে যাবে।  এর জন্য বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করতে হবে।

এ বিষয়ে ‘জাতীয় মান সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন’ এর পরিচালক তাহের জামিল আগামী নিউজকে জানান, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। বাজার থেকে বিভিন্ন পণ্যের নমুনা সংগ্রহ করে তার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ব্যবস্থা নিচ্ছি। নকল ও ভেজাল কারবারীদের দৌরাত্ম ঠেকাতে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এর উপ-পরিচালক আতিয়া সুলতানা কে ফোন করা হলে তিনি সরকারি পরিচালক শাহনাজ সুলতানাকে ফোন করতে বলেন। তবে শাহনাজ সুলতানা এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি নন।

আগামীনিউজ/এএইচ

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে