Dr. Neem on Daraz
Victory Day

“আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম” মানবতার শেষ আশ্রয়


আগামী নিউজ | মোক্তার হোসেন, গাজিপুর জেলা প্রতিনিধি প্রকাশিত: জুলাই ২৭, ২০২১, ০৫:০৩ পিএম
“আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম” মানবতার শেষ আশ্রয়

ছবি : আগামী নিউজ

গাজীপুরঃ ঈদ বা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিনসমূহে স্বজনদের কেউ পাশে না খাকলেও মানবতার সম্পর্কের টানে কাছে আসা মানুষের কোনো অভাব হয়না। মানুষ হিসেবে মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া মানুষগুলো খোঁজ খবর নিতে আসেন। হাতে মেহেদী লাগিয়ে দেন, ফল বা রান্না করা খাবার নিয়ে কুশলাদি জানতে আসেন।

তাঁদের মধ্য থেকে একজন করোনা মহামারির এ সময়ে চোখের চিকিৎসা জনিত কারণে ঢাকায় অবস্থান করার সময় টীকা গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাঁর সাথে থাকা অন্যান্য বয়স্ক মানুষদের টীকার ব্যাপারে তাঁর অনেক আগ্রহ। তাঁর দাবী অনেকেরই হয়তো জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। রেজিস্ট্রেশন বা টীকা কেন্দ্রে যাওয়ার সক্ষমতা নেই। তাঁদেরকে টীকাদান নিশ্চিতের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারকে দায়িত্ব পালনের অনুরোধ করেন।

যাদের সাথে পরষ্পর পরষ্পরের কোনোদিন উঠাবসা বা পরিচয় ছিল না, আজ তাঁদের সাথেই একত্রে বসবাস। তাঁদের ঈদ,পার্বন এখন পারিবারিক ও সামাজিক গন্ডি ছেড়ে মানবতার গন্ডিতে ছড়িয়ে পড়েছে। জীবনের দুঃখ গ্লানি ছাপিয়ে করোনা মহামারীর এ সংকটেও তারা বেশ ভাল আছেন।

তাঁদের মধ্যে কেউ ব্যবসা, কেউ রাজনীতি, কেউ চাকুরী থেকে অবসর, আবার কেউ বা স্বামী হারা, স্ত্রী হারা বয়োবৃদ্ধ। গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার টোক ইউনিয়নের “আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম” বয়ষ্ক পুনর্বাসন কেন্দ্র-ই যেন তাঁদের আমৃত্যু ঠিকানা। তাঁদের অনেকেই এখন আর জীবনের পেছনের কথা স্মরণ করতে চান না। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের আদর ভালোবাসা যেন প্রত্যেকেরই অটুট থাকে সেটা চান।

তাদের বেশিরভাগ জন্মগ্রহণ করা গ্রাম, উপজেলা বা জেলার নাম বলতে ততটা আগ্রহী নন। পেছনে ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি মনে করতে চান না তারা। যেখানে জীবনের শেষ সময়টা খেয়ে পরে কাটিয়ে দিচ্ছেন সেটাই যেন হয় তাদের জীবনের শেষ ঠিকানা এটাই তারা প্রার্থনা করেন। তবে এটা তারা অন্য কারও জন্য কামনা করেন না।

চাঁদপুর জেলা সদরের বাসিন্দা শামসুল হুদা (৬০) একটি দুর্ঘটনায় পঙ্গু জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি যাদের জীবনের বোঝা বহন করেছেন পঙ্গু হয়ে তিনি তাদেরই বোঝা হয়ে উঠেন। তিনি প্রিয়জনদের জীবনের বোঝা বহন করলেও এখন তাঁর বোঝা কেউ বহন করতে চান না। এখানে না আসলে হয়তো তাকে ভিক্ষা করতে হতো। অবশেষে মানুষের ভালবাসায় নিজের পঙ্গুত্ব বিলীন হয়ে গেছে। এখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। ধর্মীয় পরিচয় বড় হয় না। ধর্ম নিরপেক্ষতাই এখানে মূখ্য। তাঁর মতো ভিন্ন ঘটনার শিকার হওয়া মানুষদের সাথেই এখন তাঁর বেঁচে থাকা।

সুশান্ত সেনগুপ্ত (৬৫)। নারায়ণগঞ্জের একটি কাপড়ের দোকানে চাকুরী করতেন। তিনি বলেন, দুনিয়াতে তাঁর কেউ নাই। শরীরের একপাশ অকার্যকর। লাঠি ভর করে হাঁটেন। তবে এ বয়সে তাঁর বন্ধুরা খোঁজ খবর নেন। যেখানে এখন বেঁচে আছেন সেটাই তাঁর আমৃত্যু এবং শেষ ঠিকানা। বৃদ্ধাশ্রমকে নিজের বা বৃদ্ধদের বাড়ি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়ার আছিয়া খাতুন (৮৫)। তিনি বলেন, দুনিয়াতে দুই কন্যা বেঁচে আছেন। কিন্তু কেউ খোঁজ নেয় না। দুনিয়াতে কেউ না থাকলেও মানুষ আছে, এলাকাতেও মানুষ আছে। সেই মানুষেরাই আরও মানুষের কাছে এনে দিয়েছে। মানুষ মানুষের সাথে বেঁচে থাকবে, এটাইতো নিয়ম।

আরেকজন শামসুল হুদা (৬৬)। জন্ম পরিচয় জানতে গেলে বলেন, দুঃখ স্মরণ করে কী লাভ ? এটাই আমার জীবন এবং এখানেই আমার শেষ ঠিকানা। যাদেরকে আঙুল ধরিয়ে হাঁটতে শিখিয়েছি, আঙুল ছোট হওয়ায় হয়তো তারা এখন আঙুল ছেড়ে দিয়েছে। নতুন প্রজ¤েœরে জন্য কিছু বলতে বলা হলে তিনি বলেন প্রজন্মের কাছে আমার বার্তা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বই-পুস্তক, গণমাধ্যম সব জায়গা থেকেই শেখানো হচ্ছে। সবখানেই পিতা-মাতার প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নির্দেশনা দেওয়া আছে। ¯্রষ্টার পরে কাউকে সেজদা করার বিধান থাকলে পিতা-মাতার প্রতি তা কার্যকর থাকত। সেই শিক্ষা কাজে লাগেনি। তবে এর আগে মানুষ হতে হবে, মানুষের হৃদয় থাকতে হবে। আমারও হয়তো ভুল হয়েছে। কিন্তু এ বয়সে আমার থেকে প্রতিশোধ নেওয়াটা উচিত কেন?

মহারাজ বেগম (৯৫)। নামে যেমন চিন্তাও তেমন। তিনি মনে করেন তাকে সুস্থ হয়ে উঠার জন্য স্বজনেরা হাসপাতালে রেখে গেছেন। যেদিন সুস্থ হবেন সেদিন বাড়ি ফিরে যাবেন। মাঝে মধ্যে সন্তান ও নাতিরা তাকে দেখতে আসেন। উল্টো তাদেরকে বুঝিয়ে দেন সুস্থ হলেই বাড়ি ফিরবেন, তাঁর জন্য যেন কেউ দুশ্চিন্তা না করে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও স্কুল শিক্ষক মমতাজ উদ্দিন বলেন, বয়ষ্ক মানুষজন তাঁরও প্রতিবেশী। তিনিও নিয়মিত বৃদ্ধদের খোঁজ খবর রাখেন। অনেকটা শিশু সুলভ আচরণ তাঁদের। প্রতি সপ্তাহে দুদিন একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক “আব্দুল আলী সেবাশ্রম-বৃদ্ধাশ্রম” বয়ষ্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে এসে বৃদ্ধদের চিকিৎসা সেবা দেন। স্থানীয় বহিরাগতদেরও এদিন বিনামুল্যে ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হয়।

আব্দুল আলী সেবাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ড. মো: শাহজাহান দেশের বিভিন্ন জায়গায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), জেলা প্রশাসক (ডিসি), যুগ্ম সচিব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। ২০০৬ সনে তিনি চাকুরী থেকে অবসরে যান। অবসরের এককালীন অর্থ দিয়ে গড়ে তোলেন মানুষের জন্য সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধাশ্রম। বাবা আব্দুল আলীমের নামে নামকরণ করেন আব্দুল আলী সেবাশ্রম। নারী পুরুষ মিলে বর্তমানে ২০জন বয়ো:বৃদ্ধ অবস্থান করছেন এ বৃদ্ধাশ্রমে। তাঁদের বেশিরভাগ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন।

তিনি জানান, ২০১১ থেকে পুরোদমে প্রথমে ৪/৫ জন দু:স্থ মানুষকে সেবাদানের মাধ্যমে তাঁর আশ্রম চালু করেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ সমাজের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে তাঁর সন্তান ও জামাতারা অবস্থান করছেন। তাঁর তিন কন্যাসহ স্বজনেরা এ আশ্রমে সাহায্য সহযোগিতা করেন। তাঁর দর্শন মানুষের সেবার মধ্যেই বেহশত নিহিত। মসজিদ-মন্দির নির্মাণে বেহেশতি সনদ রয়েছে কিনা তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু মানুষের সেবার মধ্যে বেহেশত নগদে পাওয়া যায়। সমাজের মানুষের প্রতি তার বার্তা-আলাদা করে পিতা-মাতার প্রতি সেবা বা শ্রদ্ধা প্রদর্শনের প্রয়োজন থাকবে কেন? মানুষের প্রতি ভালবাসা থাকলেই পিতা-মাতার প্রতি ভালবাসা চলে আসবে।

প্রায় ২৫টি ডেস্কটপ কম্পিউটার রয়েছে তার আশ্রমে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুসজ্জিত ল্যাবে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীরা বিনামুল্যে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে পারেন। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড অনুমোদিত ৬ মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণশেষে সনদও প্রদান করা হয়। 

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে