Dr. Neem on Daraz
Victory Day

সমাজে দলিত যারা


আগামী নিউজ | প্রভাত আহমেদ কায়সার প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১০, ২০২০, ০৫:১৪ পিএম
সমাজে দলিত যারা

ছবি: সংগৃহীত

১. এই সমাজে যারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও সবচেয়ে বেশি কর্মঠ্য যারা,তারাই সমাজে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত, দলিত।

বলছিলাম হরিজনদের কথা; যাদের আমরা মেথড়, মুচি, ধোপা কিংবা নাপিত বলেই চিনে থাকি!ধরুন আপনি একজন সচিব, রোজ অফিস করতে সচিবালয়ে যাচ্ছেন,আর আমি একজন হরিজন, আমি রোজ আপনার অফিসের সামনে গুয়ে-মুতেসহ জমে থাকা ময়লা পরিস্কার করে অফিসের সামনের জায়গাটিকে ধবধবে করে রাখছি। আপনি সুন্দর মনোরম পরিবেশে শীতাতপনিয়নন্ত্রিত রুমের মধ্যে বসে অফিস করেন, আর আমি বাহিরে রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে আপনার কারা ময়লা পরিস্কার করি। দুটোই কাজ, কিন্তু এই সমাজে আমার কাজের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় আপনার কাজকে। আপনার মধ্যে আর আমার মধ্যে তফাৎ শুধু এইটুকু; আপনি যে বয়সে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন, আমি সেবয়সে রাস্তা, বাজারঘাট ঝাড়ু দিয়েছি। আপনি পড়ালেখা করেছেন,আর আমি? আমি আপনার স্কুলে যাওয়ার রাস্তা, আপনার স্কুলের খেলার মাঠ, আপনার ক্লাসরুম ঝাড়ু দিয়েছি, আপনার বাদামের খোষা, চিপস আর আইস্ক্রিম খেয়ে করে রাখা ময়লা পরিস্কার করেছি।

ধরুন, হঠাৎ রাতের বেলা ভীষণ ঝড়-বৃষ্টি হলো,সকালে আপনি অফিসে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে বের হলেন, আপনার বাসার সামনে গুয়ে-মুতে ভরা এক কোমর জল, তখন কি করবেন? তখন নিশ্চই অপেক্ষা করতে হবে হরিজনের জন্য, তাই না? হ্যা, যতক্ষণ না পর্যন্ত হরিজন এসে গুয়ে-মুতের জল পরিস্কার না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি সচিবালয়ে অফিস করতে যেতে পারবেন না। তাহলে বুঝা যায়, একজন সচিবের চেয়েও গরুত্বপূর্ণ সমাজে একজন হরিজন।

হরিজনরা এই সমাজে আপনার আমার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে ভালোমানের কর্মটিও হরিজন করে থাকে, ‍কিন্তু এই সমাজ ময়লা অপসারণ বা পায়খানা পরিস্কারকে দেখে সবচেয়ে নিচু কাজ হিসেবে, মূলত এটাই আসল কাজ যা এই অপদার্থ সমাজের বুঝার মতো ক্ষমতা নেই। পড়ালেখা সবাই করতে পারে এটা তেমন কঠিন কিছুই নয়, যদি বই-খাতা কলম হাতে ধরিয়ে দেওয়া যায় বা সেরকম সুযোগ ও পরিবেশ সাবার জন্য প্রস্তুত থাকে। পড়ালেখা জানলেই বা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার ডিগ্রী পাশ করলে, অনেক টাকার মালিক হলেই কেবল উঁচুতলার মানুষ হয় না। উঁচুতলা বা নিচুতলা বলে কিছুই ছিলো না, সবই মানুষের তৈরী করা নিয়ম।

২. হিন্দু বা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জাতিভেদ প্রথাটির বিষবৃক্ষ রোপণ করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আর্যরা।

তারপর বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠী জাত-পাতের বিভাজন করেই গেছেন। জাত-পাতের বিভাজন সামাজিকভাবে এমন নির্যাতনে রূপ নিয়েছিল যে, সমাজে নিম্নবর্গের মানুষের টেকাই দায় হয়ে উঠেছিল। ভারতবর্ষে এই বিভাজনের মধ্য দিয়ে বিস্তৃতি ঘটে বৌদ্ধ ও ইসলাম ধর্মের। কিন্তু জাত-পাতের সংকট ভারত-বাংলাদেশ থেকে আজো যায়নি। এখনো জাত-পাতের তাম্রলিপিতে দলিত সম্প্রদায় রয়ে গেছে। মহাত্মা গান্ধী দলিতদের মেথর, সুইপার না বলে ‘হরিজন’ বলার অমোঘ বাণী দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের সমাজ ও সামাজিকতার মূল সমাজের সঙ্গে যুক্ত করেননি। অর্থাৎ এক একজন শাসক জাতি বিভাজন করলেও তাকে টিকিয়ে রেখেছেন ব্রাহ্মণ সমাজ। মহাত্মা গান্ধীর ‘হরিজন’ তার একটি প্রকাশ মাত্র। দেবদাসী প্রথা দক্ষিণ ভারতে এখনো টিকে আছে। এসব দেবদাসীরা অধিকাংশই হরিজন সম্প্রদায়ের থেকে আসা। ব্রাহ্মণরা তাদের দিনের পর দিন ভোগ করলে জাত যায় না। জাত যায় তাদের হাতের জল খেলে। বাংলাদেশের দলিত হরিজনরা এখনো মূল স্রোতের সঙ্গে মিশতে পারেনি। ফলে তারা কলোনিভিত্তিক জীবনযাপন করে যাচ্ছে ব্যাপক অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে। ঢাকা শহরের একটু বাইরে গেলেই দেখা যাবে দলিত-হরিজনরা যেন অস্পৃশ্য। এখনো প্রায় দেখা যায়, তারা জল খেতে দোকানে গেলেও গ্লাস নিয়ে যেতে হয়। এ অবস্থার পরিবর্তন না হলে দেশের বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয় অবদানকে অস্বীকার করা হবে। তাই এদের মূল স্রোতে নেয়ার জন্য ভাবা উচিত। নতুবা এরা শিক্ষিত হলেও এদের অচ্ছুত রাখা হবে। এত বড় একটা জনগোষ্ঠীকে অচ্ছুৎ রাখলে কাদের লাভ সে কথায় নাই গেলাম। শুধু দাবি করছি এদের মূল স্রোতে আনার।

৩. দলিত সম্প্রদায় জন্ম ও পেশাগত কারণে বৈষম্য এবং বঞ্চনার শিকার মানুষরা আন্তর্জাতিক পরিসরে বিশেষ করে পণ্ডিতদের কাছে ‘দলিত’ নামে পরিচিতি পায়।

তারই ধারাবাহিকতায় দেখি- বাংলাদেশে দুই ধরনের দলিত জনগোষ্ঠী রয়েছে (১) বাঙালি দলিত (২) অবাঙালি দলিত। বাংলাদেশে বসবাসরত দলিতদের সংখ্যা বর্তমানে ৩.৫ মিলিয়ন। বাঙালি দলিত বলতে সমাজে যারা অস্পৃশ্য তাদের বোঝায়, যেমন- চর্মকার, মালাকার, কামার, কুমার, জেলে, পাটনী, কায়পুত্র, কৈবর্ত, কলু, কোল, কাহার, ক্ষৌরকার, নিকারী, পাত্র, বাউলিয়া, ভগবানীয়া, মানতা, মালো, মৌয়াল, মাহাতো, রজদাস, রাজবংশী, রানা কর্মকার, রায়, শব্দকর, শবর, সন্ন্যাসী, কর্তাভজা, হাজরা প্রভৃতি সম্প্রদায় সমাজে অস্পৃশ্যতার শিকার। এসব সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। ইসলাম ধর্ম জাতিভেদকে অস্বীকার করলেও এই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে অনেকে পেশার কারণে সমাজে পদদলিত হয়ে রয়েছে, যেমন- জোলা, হাজাম, বেদে, বাওয়ালি।

৪. অবাঙালি দলিত বলতে আমরা বুঝি ব্রিটিশ শাসনামলের মাঝামাঝি (১৮৩৮-১৮৫০) বিভিন্ন সময়ে পূর্ববঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মী, চা-বাগানের শ্রমিক (১৮৫৩-৫৪), জঙ্গল কাটা, পয়ঃনিষ্কাশন প্রভৃতি কাজের জন্য ভারতের উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, উড়িষ্যা, কুচবিহার, রাচি, মাদ্রাজ ও আসাম থেকে হিন্দি, উড়িষ্যা, দেশওয়ালি ও তেলেগু ভাষাভাষী মানুষের পূর্ব পুরুষদের নিয়ে এসেছিল। অভাবি এই অভিবাসীরা দেশের সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা কর্মী এবং সিলেটে চা-শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। ভূমিহীন ও নিজস্ব বসতভিটাহীন এ সব সম্প্রদায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে স্থানীয় সরকার কর্তৃক প্রদত্ত জমি, রেলস্টেশনসহ সরকারি খাস জমিতে বসবাস করছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো : হেলা, মুচি, ডোম, বাল্মিকী, রবিদাস, ডোমার, ডালু, মালা, মাদিগা, চাকালি, সাচ্চারি, কাপুলু, নায়েক, নুনিয়া, পরাধন, পাহান, বাউরি, বীন, বোনাজ, বাঁশফোর, ভূঁইয়া, ভূমিজ, লালবেগী, জনগোষ্ঠী। এসব জনগোষ্ঠী তেলেগু, ভোজপুরী, জোবালপুরী, হিন্দি, সাচ্চারী ও দেশওয়ালি ভাষায় কথা বলে। এই সম্পপ্রদায়গুলোই মূলত অবাঙালি দলিত শ্রেণি। 

৫. নারায়ণগঞ্জ হরিজন পল্লীঃ চাষাঢ়া থেকে রিকশায় টানবাজার থামতেই হরিজন পল্লীর অবস্থান। ঢুকতেই মনে হবে দেশের প্রচলিত কোনো এলাকা থেকে ভিন্ন এলাকায় ঢুকছি। চিপা গলি, আধো আলো আধো অন্ধকার- জলে ভেজা-স্যাঁতসেঁতে ছোট ছোট খুপরি ঘর, উন্মুক্ত ড্রেন- থেকে ভেসে আসছে ময়লা-দুর্গন্ধ। তার মধ্যেই খেলছে হরিজন পল্লীর শিশু-কিশোররা। এমনই এক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বেড়ে উঠছে তারা। এরা পেশায় সুইপার। পৌরসভা গার্মেন্টস ও হাসপাতালে এরা চাকরি করে। এদের বেতন শুনলে অবাক হতে হয়। ঝাড়–দার ৪ হাজার টাকা। হাতল গাড়ি ৫ হাজার। ড্রেন ম্যান ৪ হাজার আর সিটি কর্পোরেশনের ট্রাকে থাকলে ৬ হাজার টাকা। পূজায় বোনাস নেই। কালিপূজা ও দুর্গাপূজায় এডভান্স ২ হাজার টাকা দেয়। তাও মাসে মাসে কাটে ২০০ করে। মারা গেলে ৫ হাজার টাকা। বোনাস স্কেল কিছু নাই।

তাদের এখানে অনেক অনিয়ম ছিল যেগুলো পঞ্চায়েতরাও মেটাতে পারত না। পঞ্চায়েত মানে ৫ জনের একটা কমিটি। এ কমিটি পল্লীর ভেতরকার সালিশি, মীমাংসা বিচার-আচার করে। পাঁচজনের কমিটি বলেই এর নাম পঞ্চায়েত। তবে এরা কোনো কাজ করলে তরুণ, বুদ্ধিমান ব্যক্তিদেরও ডেকে নেয়। একটা সময় ছিলে যখন এসব পঞ্চায়েতদের সামনে দিয়ে কেউ হাঁটতো না। নারীরাতো সামনেই আসতো না। ঘরের বাইরে এলেও বড় ঘোমটা টেনে কাজ সেরে। কোনো নারী একটু অসতর্কভাবে এদের সামনে দিয়ে হাঁটলে পঞ্চায়েতরা সেব পরিবারের পুরুষদের ডেকে শাসিয়ে দিতো। নারীরা ঘরের বাইরে যেতে পারতো না। অভাব অজীর্ণতে মরে গেলেও নারীদের এসব ঘরে বসে দেখতে হতো। এরা পুরুষদের দ্বারা প্রাত্যহিকভাবে নির্যাতিত হতো তবুও নারীরা সামনে আসতে পারতো না। পঞ্চায়েতরা বিচারে বসে কখনো নারীদের কথা শুনতে হলে ২ সদস্যের একটা ঝুরি কমিটি ছিল। ঝুরি কমিটির সবই ছিল পুরুষ ফলে নারীর কথা শুনতে কেউ আসতো না। এক সময় নারীদের সেখানে এক অবরুদ্ধ জীবনযাপন করতো। অনেক নারী ভোর বেলা গিয়ে কাজ করে ৬টার মধ্যেই ঘরে ঢোকে। কাজের বেতন স্বামীর হাতে তুলে দিতে হয়।

হরিজনরা খুবই উৎসবপ্রবণ একটা সম্প্রদায়। এদের বারো মাসে তের পার্বণতো আছেই। তাছাড়াও দেল উৎসব, কালী পূজা, দুর্গা পূজা, হুলকা পূজা, সূর্য পুপায়ায় এরা খুবই আনন্দ করে সাংস্কৃতিকভাবে এদের মান খুবই উন্নত। কিন্তু এরা মূল স্রোতের সঙ্গে নেই বলে এদের উৎসব বা এদের মধ্যে যে খুব মান সম্পন্ন কণ্ঠশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী রয়েছে সে কথা জানে না কেউ। এবং শিল্পীরা জাতীয়ভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে দেশের সংস্কৃতির জন্যও সেটা হতো সুসংবাদ। এরা যে পরিবেশে থাকে সেখানে বসে অন্যকিছু চিন্তা করা কষ্ট কর। তাই নারায়ণগঞ্জের হরিজনদের দাবি- কলোনিটা ভেঙে যদি বহুতল ভবন করা। সরকার এ ব্যাপারে এসব বঞ্চিত মানুষদের পাশে কি দাঁড়াতে পারেন না? আবাসন সংকটে এরা আর কতকাল ভুগবে, কতকাল অপুষ্টি-অজীর্ণ নিয়ে বেড়ে উঠবে এদের শিশুরা?

হরিজন পল্লী বাংলাদেশের বাইরের কোনো এলাকা না। কিন্তু এ পল্লীতে ঢুকলে মনে হয় না এটা বাংলাদেশের কোনো এলাকা। মনে হয় কোনো ভিন গ্রহে আছি। রাষ্ট্রীয় অধিকারের সামান্যও নেই এদের মধ্যে। অথচ এরা সবাই ভোটার। নির্বাচনে ভোট দেয়। প্রার্থীরা আসে। মাথায় হাত বুলায়। তাদের সমস্যা-সংকট নিরসনের আশ্বাস দেয়। নির্বাচন শেষ হলে হরিজনদের আর চেনে না। এ অভিযোগ হরিজন পল্লীর মানুষদের। হরিজনদের বেতন-কাঠামো বদল করা থেকে আবাসনে পরিবর্তন আনলে ১৬ লাখ হরিজনের এই দুর্দশার অবসান ঘটে। বিষয়টি নিয়ে ভাবার কি কেউ নেই? 

আগামীনিউজ/এমকে

আগামী নিউজ এর সংবাদ সবার আগে পেতে Follow Or Like করুন আগামী নিউজ এর ফেইসবুক পেজ এ , আগামী নিউজ এর টুইটার এবং সাবস্ক্রাইব করুন আগামী নিউজ ইউটিউব চ্যানেলে