Dr. Neem on Daraz
Victory Day

হলুদ তরমুজে আনোয়ারের স্বপ্নপূরণ


আগামী নিউজ | শাহাজাদা এমরান প্রকাশিত: মে ৭, ২০২১, ০৪:৩৬ পিএম হলুদ তরমুজে আনোয়ারের স্বপ্নপূরণ

কুমিল্লাঃ ছোট বেলায় ইচ্ছে ছিল পড়াশুনা করে এমন অফিসার হবো, যাতে সারা দেশের মানুষ এক নামে চিনে। কিন্তু দারিদ্রের কষাঘাতে নিমজ্জিত বাবা পারেননি সন্তানকে প্রাইমারি গণ্ডি পার করতে। পড়াশুনা করতে পারেননি ফলে হননি অফিসার। আনোয়ার তার স্বপ্ন ভুলেননি। ধার দেনা করে কেনেন একটি স্মার্ট ফোন। স্মার্ট ফোনে ইউটিউবে গিয়ে বার বার দেখেন বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক বিষয়াবলী। 

হঠাৎ করে তার নজরে এলো মালচিং পদ্ধতিতে তরমুজ চাষ। বার বার দেখে নজরে এলো হলুদ তরমুজের। এই হলুদ তরমুজ চাষ করেই আজ সারা দেশের মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠতে যাচ্ছেন কৃষক আনোয়ার হোসেন। 

আজীবন লালিত স্বপ্ন সত্যি হতে দেখে অর্থের অভাবে অফিসার না হওয়ার ব্যথা ভুলে গিয়ে গর্ব নিয়ে সফল চাষি আনোয়ার বলেন, আমার ক্ষেতে এখন অনেক অফিসার আসেন। 

কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার গলিয়ার দক্ষিণ ইউপির বলরামপুর গ্রামের চাষি আনোয়ার হোসেনের বয়স এখনো ৪৫ এর কোটা পেরোয়নি।  

আনোয়ার বলেন, স্বপ্ন ছিল বড় অফিসার হবো। সারা দেশের মানুষ আমারে চিনব। কিন্তু ৫ ছেলে ও ২ মেয়ের বড় সংসারে গরিব বাবা আমাদের পড়াতে পারেননি। ছোট কাল থেকেই বাবার সঙ্গে ক্ষেতে খামারে কাজ করা শুরু করি। বড় হয়েছি, বিয়ে করছি সন্তানও আছে। কিন্তু সংসার উন্নত হচ্ছে না। আগের মতো ধান চাষে তেমন লাভ হয় না। কষ্ট করে একটা স্মার্ট ফোন কিনে ইউটিউবে বিভিন্ন চাষাবাদ দেখতে লাগলাম। ধান চাষ বাদ দিয়ে চাষ করতে শুরু করি বিভিন্ন সবজি। বেশি লাভ না হলেও ধান থেকে ভালো হচ্ছে। 

তিনি বলেন, ‘ইউটিউবে দেখলাম, মালচিং পদ্ধতিতে থাইল্যান্ডে তরমুজ চাষ হচ্ছে। সময় কম লাভ বেশি উৎপাদনও ভালো হয়। ইউটিউব থেকেই সিরাজগঞ্জের শাহিনের ঠিকানা পেলাম। শাহিন ভাই বীজ থেকে শুরু করে সার্বিক সব বিষয়ে সহযোগিতা করলেন। ২০২০ সালে ২০ শতক জমিতে এই মালচিং পদ্ধতিতে এ তরমুজ চাষ শুরু করলাম। মাত্র ৫২ দিনে ফলন এলো। জমি থেকেই খুচরা ক্রেতারা সব তরমুজ কিনে নিলো। বাজারে কিংবা পাইকারদের দেয়ার সুযোগও হয়নি। 

এবার শুরু করলাম কালো তরমুজের সঙ্গে হলুদ তরমুজ চাষ। এই হলুদ তরমুজ একমাত্র চুয়াডাঙ্গা ছাড়া আর কোথায়ও হয়নি। 

এই হলুদ তরমুজের বীজ দেশের বাহির থেকে আসে। বীজগুলো থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা হয়। এর আগে নির্দিষ্ট জমিকে তরমুজ চাষের জন্য উপযোগী করা হয়। এক হাত দূরত্ব রেখে পুরো জমিতে হাফ হাত উঁচু বেড করা হয়। এই মাটির বেডগুলো মালচিং পলিথিন শিট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। যখন চারা লাগানো হয় তখন মালচিং পলিথিন শিট দিয়ে মোরানো মাটি গোল করে কেটে কাটা স্থানে ওই তরমুজের চারাটি লাগানো হয়। এর পর গাছ যখন বড় হতে থাকে তখন বিভিন্ন সবজি জমির মত মাচা তৈরি করে দেয়া হয়। তরমুজ গাছ মাচার বিভিন্ন পর্যায়ে ছড়িয়ে যায়। তরমুজ বড় হলে যাতে মাটিতে পড়ে না যায় সেই জন্য পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে দেয়া হয়। বিভিন্ন ছত্রাকের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। ৫২ দিনের মাথায় তরমুজ খাওয়ার উপযোগী হয়। একেকটি তরমুজ দুই থেকে চার কেজির মতো বড় হয়। এই তরমুজ কেজির ধরে বিক্রি করা হয়। 

দেশীয় তরমুজ মাটিতে শুয়ে বড় হয়। ফলে আকারে এটি ১০-১২ কেজি কখনো এর থেকেও বড় হয়। আর এই মালচিং পদ্ধতির তরমুজ যেহেতু মাচায় বড় হয় তাই এটি সর্বোচ্চ ৪ কেজির মতো ওজন হয়। এর চেয়ে বড় হলে মাচাসহ ভেঙে পড়ার উপক্রম হবে। হলুদ তরমুজ দেখতে ভাঙ্গির মত হলুদ হলেও ভেতরে অনেক লাল এবং রসালো হয়। বলা যায় রসে ভরা তরমুজ। খেতে যেমন মিষ্টি তেমনি সুস্বাধু। এক কথায় স্বাধে মানে অনন্য। 

তরমুজ চাষি আনোয়ার হোসেন বলেন, এবার ৬৫ শতক জমিতে তরমুজ উৎপাদন করেছি। এর মধ্যে বেশির ভাগই হলুদ তরমুজ। এবার মানুষের আগ্রহও বেশি। এ পর্যন্ত জমি প্রস্তুত, সার, বীজ, মাচা, সুতা ও জাল বাবদ খরচ হয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। গত কয়েক দিন ধরে তরমুজ বিক্রি শুরু করেছি। এবার সব খরচ বাদ দিয়ে কমপক্ষে ১২ লাখ টাকা লাভ হবে।

তিনি বলেন, এই পর্যন্ত চার হাজার পাঁচশ তরমুজে পলিথিন দিয়েছি। আরো তরমুজ পলিথিন দেয়ার অপেক্ষায় আছি। এই তরমুজ বিক্রি করেই স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছি। পড়া লেখা না করতে পারার আর কোনো দু:খ নেই। এই হলুদ তরমুজের কারণে আজ সারা দেশের মানুষ চিনতে পারছে। এটাই আমার শান্তি। কৃষি বিভাগ আমাকে সহযোগিতা করছেন। এ তরমুজের গায়ের রং হলুদ। ভেতরে লাল টকটকে। শিলাবৃষ্টি ও বৈরী আবহাওয়া না থাকলে অন্তত ১২ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারব ইনশাআল্লাহ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সবুজের পাতার ভেতর মাচায় ঝুলছে হলুদ তরমুজ। তা দেখতে প্রতিদিন মানুষ ভিড় করছেন কৃষক আনোয়ার হোসেনের খেতে। আনোয়ারও মনের আনন্দে সবাইকে ঘুরে ঘুরে তরমুজ দেখাচ্ছেন। 

সদর দক্ষিণ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মজুমদার বলেন, হলুদ তরমুজের পুষ্টিগুণ বেশি, মিষ্টিও বেশি। কুমিলার মাটি তরমুজ চাষের জন্য উপযোগী। আনোয়ার উদ্যোমী কৃষক। তার আগ্রহ থেকেই কুমিলায় প্রথমবারের মতো চাষ হচ্ছে হলুদ তরমুজের। আমরা তাকে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছি। 

কৃষক আনোয়ার বলেন, দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি করার ইচ্ছা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন অর্থ। সরকার যদি বিনা সুদে ঋণ দেয় তাহলে এই হলুদ তরমুজকে দ্রুত রফতানি পর্যায়ে নিয়ে যেত পারবো। অনেকেই এই হলুদ তরমুজ চাষে উদ্যোগী হবেন। 

কুমিল্লা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, আনোয়ার হোসেন গত বছর ইউটিউব দেখে কালো তরমুজ চাষ শুরু করেন। সে সময় তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন উপজেলার কৃষি কর্মকর্তারা। এবারো তিনি হলুদ তরমুজ চাষ করেছেন। ফলনও ভালো। তার দেখা দেখি ওই এলাকার কৃষকরা এখন উন্নত জাতের হলুদ তরমুজ চাষে ঝুঁকছে। কৃষি সম্প্রসারণ অফিস ওইসব কৃষকদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।

আগামীনিউজ/নাসির