Dr. Neem on Daraz
Victory Day

শুধু বন্ধ স্কুল, বাকি সব খোলা


আগামী নিউজ | স্বপ্না রেজা প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৮, ২০২১, ১১:৪৪ এএম শুধু বন্ধ স্কুল, বাকি সব খোলা

ঢাকাঃ নতুন বছরে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। সারা বিশ্ব কাঁপছে। ভাবছে, প্রথম ঢেউয়ের চেয়েও দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাত ভয়াবহ হবে। ভাবনা অমূলক হয়নি। যেভাবে দ্রুতগতিতে বর্তমানে করোনা ছেয়ে যাচ্ছে মানবদেহ থেকে মানবদেহে এবং নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে তাতে আতঙ্কিত হওয়ারই কথা। বিশ্বের বহু দেশ জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মানবদেহে ভ্যাকসিন পুশ করার পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনযাপনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। অর্থাৎ লকডাউন শুরু হয়েছে অনেক দেশে। এ ধাক্কায় বেঁচে গেলাম করোনার হাত থেকে তা যেন বলার উপায় রাখেনি অতিমারি করোনা।

যা হোক, বাংলাদেশের জনগণের জীবনযাপন দেখলে সেই ভয় অনুভূত হয় না। মাস্ক ছাড়া দিব্যি মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। যদিও জরিমানার ভয়ে কেউ কেউ মাস্ক পরেন। তবে সবাই নন। সোশ্যাল ডিসটেন্স তেমন একটা চোখে পড়ে না বাজারে, লোকালয়ে কিংবা অফিস-আদালতে। এর আগে করোনার টেস্ট নিয়ে জালিয়াতি, মাস্ক ও পিপিই নিয়ে দুর্নীতি, আইসিইউ নিয়ে হাসপাতালগুলোর ব্যবসায়িক ফাঁদ, করোনা উপসর্গ থাকলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি না নেওয়া, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাকেলেঙ্কারি ইত্যাদি ঘটনা জনগণের মন থেকে করোনার ভয়ভীতি কমিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে জায়গা করেছে অনেকে তেমনটাই ভাবছেন। আর তাই বেঁচে থাকার তাড়নায় এবং এ ঘটনাগুলোর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা বেমালুম ভুলে জনগণ কর্মসংস্থানে ফিরেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় করোনা যেন নিতান্তই সাধারণ একটা ভাইরাস, সাধারণ মানুষের কাছে হাঁটে-বাজারে সর্বত্র।

মানুষের সবচেয়ে বড় চাহিদা সুস্থ ও নিরাপদভাবে বেঁচে থাকা। মানুষ স্বপ্ন দেখে বেঁচে থাকার। নির্মম বাস্তবতা হলো, অনেকেই করোনাকালে অর্থনৈতিক মহামন্দার কারণে চাকরি হারিয়েছেন। ফলে চাকরি হারিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্নে অনেকেই অনেক ধরনের অপ্রত্যাশিত কাজ বেছে নিয়েছেন। খবরের কাগজ, কাঁচামাল, সবজি, মাছ ইত্যাদি বিক্রি এবং রিকশা ও অটো চালানোর মতো কাজ অনেকেই বেছে নিয়েছেন। বেঁচে থাকার সংগ্রাম করোনা প্রতিহত করতে পারেনি। যদিও করোনা অনেক জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছে এবং দিচ্ছে আজও।

কঠিন এক সত্য হলো যে, কর্মসংস্থানে মানুষ ফিরলেও আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরতে পারেনি। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতেই বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে এবং অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। যদিও অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার সামর্থ্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেই, ছিল না। অনেক শিক্ষার্থীর কিংবা অভিভাবকের আবার অ্যান্ড্রয়েড ফোনও নেই। আবার যাদের আছে ডেটা কিনে পড়ালেখা করার সামর্থ্য কারো কারো নেই। অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য কারোর আবার ল্যাপটপ নেই। এ অসম্পূর্ণ ব্যবস্থা ও অবস্থার মধ্য দিয়ে প্রায় এক বছর হতে চলল শিক্ষার্থীরা পরিপূর্ণ শিক্ষাগ্রহণ থেকে বিরত। অনেকটা এমন যে, চুলায় তাপ নেই তো ভাত রান্নার দরকার নেই। অথচ খাওয়া যে জরুরি এবং বিকল্প উপায় কী হতে পারে ভাত খাওয়ার সেই চিন্তাচেতনার দেখা মেলে না। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, করোনাকে পাশে রেখে, সঙ্গে রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবন-জীবিকার সব কাজকর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রকল্প বাস্তবায়ন, উদ্বোধন শুরু হলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাকার্যক্রম শুরু হয়নি। শিক্ষাকার্যক্রম কীভাবে অব্যাহত রাখা যায় সেই বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে উপযুক্ত উপায় বের করা সম্ভব হয়নি। বলা ভালো, উপায় বের করার মতো চেতনা জাগ্রত হয়নি। একজন অভিভাবক বেশ হতাশ হয়ে বলছিলেন, ‘বাজার তো চলছে ভালো। না হয় সেখানেই শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হোক।’ সবকিছু চলমান রেখে শুধু শিক্ষাকার্যক্রমের গতিরোধ করা কতটা যুক্তিযুক্ত ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য কল্যাণকর ভেবে দেখা দরকার।

উচ্চতর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বছর লসকে যেমন মেনে নিতে পারছে না, হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে তদ্রপ অতি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীরা। এটা তো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, স্কুল, কোচিং সেন্টার ও শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলাদেশের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা অভ্যস্ত এবং শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের অজ্ঞতা, উদাসীনতাই এ অভ্যস্ততার অন্যতম একটা কারণ। শিক্ষার ক্ষেত্রে অটোপ্রমোশন সমস্যার সমাধান নয়, বরং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনে নতুনমাত্রার সমস্যা সংযোজন বলা যায়। চাকরি কিংবা ব্যবসার ক্ষেত্রে লাফ দিয়ে, লাফিয়ে উচ্চতর আসন বা জায়গায় ঠাঁই নেওয়া যদি না যায়, সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কিংবা আর্থিক কোনো প্রভাব থাকে। এখানে যোগ্যতা, মেধার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চ জায়গায় পৌঁছাতে মেধা ও যোগ্যতা পরীক্ষিত হতে হয় এবং সেটা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত উপায় ও কৌশলে।

সম্প্রতি মাঠপর্যায়ে গিয়ে অপ্রত্যাশিত একটা দৃশ্য চোখে পড়ল। প্রতিবন্ধী শিশু শিক্ষার্থীদের মাদরাসায় ভর্তি করানো হচ্ছে। যেখানে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে শিশুদের, শিক্ষার্থীদের করোনাকালে স্বাস্থ্যঝুঁকি রোধ করার লক্ষ্যে সেখানে মাদরাসাগুলো খোলা রাখা হয়েছে কোন অজুহাতে এমন প্রশ্ন দেখা দেওয়া খুবই স্বাভাবিক। সাধারণভাবে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধী বলা হয়। এই বিশেষ জনগোষ্ঠীকে মূলধারায় নিয়ে আসার উপায় হলো নিয়মিত শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, থেরাপি প্রদান এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সুযোগ ও সহায়তার আওতায় আনা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য বর্তমান সরকার ও দেশের বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বেশ কাজ করছে। গড়ে উঠেছে বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে বিশেষ কারিকুলামের মাধ্যমে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের একাধারে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, ফিজিও ও অকুপেশনাল থেরাপি দেওয়া হয় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক এবং থেরাপিস্টের মাধ্যমে। এই বিশেষ শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও থেরাপি গ্রহণের মাধ্যমে বিশেষ শিক্ষার্থীদের একটা অংশ কিন্তু মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে ইতোমধ্যে, যা আশাব্যঞ্জক। কোভিড-১৯-এ এই বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে বিশেষ শিশুরা রুটিনমাফিক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও থেরাপি গ্রহণ থেকে বিরত থাকায় তাদের আচরণগত সমস্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ঠিক তেমনি সুস্থ মেধা বিকাশ হচ্ছে না। ফলে অভিভাবকরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। অভিভাবকদের এ অসহায়ত্বকে পুঁজি করে করোনাকালে বিশেষ শিশুদের কোনো কোনো মাদরাসায় ভর্তি নেওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্নঅঞ্চলে। এতে দুটি প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এক. মাদরাসার শিক্ষকদের এই বিশেষ শিশুদের শিক্ষা প্রদানের বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে কি না এবং তা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত কি না। দুই. করোনাকালে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কীভাবে এসব মাদরাসা খোলা রাখা হচ্ছে। কেউ কি দেখার নেই! নাকি শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা এসব জেনেও চুপ করে আছেন!

জীবন-জীবিকায়নের জন্য কর্মসংস্থানে ফিরে আসার প্রয়োজনীয়তা আছে সত্য। আরো একটা সত্য যে রয়ে গেল, শিক্ষাকার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে ভবিষ্যতের জন্য যে আশানুরূপ মেধা বিকশিত হবে না। উন্নয়নের জন্য মেধার বিকল্প তো নেই। শিক্ষার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় এতটা হেলাফেলায় এগিয়ে নিলে আদতে ফলাফল কী হতে পারে, ভাবা দরকার। আশা করি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি ভাববেন।

লেখক : কলামিস্ট

আগামীনিউজ/এএইচ